আমাদের মেয়েদের রগ কেটে পঙ্গু করে দিবেন? দ্যান!

ফারজানা শারমীন সুরভি:

আমরা তীব্র গরমে সিদ্ধ হইতে হইতে এবং ভিড়ে পিষ্ট হইতে হইতে বাসে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। আমরা গণরুমে থাকি। নেতাদের মাইর খাই। হলের ডাইনিং-এর কুৎসিত খাবার খেয়ে বেঁচে থাকি। আমরা নাক-মুখ ওড়না দিয়ে চেপে কলা ভবনের ময়লা উপচানো বাথরুমে যাই। সামান্য কিছু টাকার টিউশনির জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ঢাকার এ মাথা থেকে ও মাথা দৌঁড়ায়ে বেড়াই। সস্তায় দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য লাইন দিয়ে ডাকসুর ক্যান্টিনে দাঁড়ায়ে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। আমাদের পিতা-মাতারা মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং হতদরিদ্র। তারা পেশায় দিনমজুর, কৃষক, ছাপোষা চাকুরিজীবি, গৃহিণী আর যতো হাবিজাবি। আমাদের গায়ে বুলেট ছুঁড়তে তাই আপনাদের দুইবার চিন্তা করতে হয় না।

আমাদের প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রেম করে শুকনা বাদাম চিবিয়ে। আমাদের বেলা বোসরা ঘণ্টার পরে ঘণ্টা ধরে লাইব্রেরিতে বইয়ের পাতা উলটে যায় সরকার ও জনগণের সেবক হবে বলে।

আমাদের বেলা বোসদের প্রেমিকেরা সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে পড়তে পড়তে স্বপ্ন দেখে, বিসিএস অফিসার হলেই বেলা বোসের পরিবার কন্যাকে আর লাভজনক ‘এরেঞ্জড’ বিয়ের জন্য চাপ দেবে না। করপোরেট কোম্পানি চোখ টিপে জানায়ে দেয়, আমরা ক্ষ্যাত। ইংরেজি পারি না। বাংলা মাধ্যম থেকে উঠে আসছি আমরা। পড়েছি গ্রামের ভাঙ্গাচোরা স্কুলে, মফস্বলের স্কুলে, জেলা স্কুলে কিংবা ঢাকার কোনো স্কুলে। চাঁদনি চকের গজ কাপড়ের জামা গায়ে দিয়ে, ফুটপাতের শার্ট গায়ে দিয়ে আমরা দিন দিন আরো ক্ষ্যাত হইতে থাকি। তারপরেও এই শুয়োরের বাচ্চাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখায়ে আমরাই জি আর ই তে ভালো স্কোর করি।টোফেল দেই। আইএলটিএস দেই। বিদেশে আসি স্কলারশিপ নিয়ে। অমানুষিক পরিশ্রম করে পি এইচ ডি করি। গবেষণা করি। ফটর ফটর করে ইংরেজি বলি। বিদেশী পত্রিকাতে আমাদের নাম ছাপা হয়।

আমরা সরকারি চাকরির সব স্তর পার হয়ে দেখি, আমাদের এইসব সংগ্রামে আমাদের পা আসলে দৌড় শুরু করার আগেই আপনারা কষে বেঁধে ফেলছেন। কোটার নাম দিয়ে দলীয় নিয়োগটাই সরকারি চাকরিতে প্রথা। ছাপান্ন ভাগ গুড় খেয়ে ফেলে পিঁপড়ায়। আমরা কোটা নিয়ে আন্দোলন করলে আপনারা আমাদের “ম্যাধাবী” বলে মুখ ভেংচি দেন। আমাদের রাজাকার বলে গালি দেন। আমরা আপনাদের মিনমিন করে বলি, কোটা কিছু কমায়ে দিতে।তখন আমাদের জানায়ে দেন, স্বাধীনতার অনেক দেনা জমে আছে। আমাদের এখন ঋণ শোধের সময়। আমরা ঋণ শুধতে গিয়ে কেউ বেকার থাকি। একসময় সিলিং ফ্যানে ঝুলে মরে যাই। মরার পরেও আপনারা আমাদের নিয়ে হাসেন। বলেন, আমাদের সরকারের চাকর হওয়ার এতো লোভ!

অথচ আপনারা ভুলে যান, রাষ্ট্রযন্ত্র চালাইতে গেলে-সুশাসন আনতে গেলে মেধাবী সরকারি চাকরের কোনো বিকল্প নাই। আমাদের কেউ কেউ অতিমানবীয় মুখস্থ বিদ্যার জোরে আর কপালের কুদরতে খাল-বিল-নদী-নালা-প্রণালীর নাম জপতে জপতে সরকারি চাকরির গুড়ের ভাগ পায়। আপনাদের সেবায় নিবেদিত হয়।

আমরা কেউ কেউ বেসরকারি চাকরি খুঁজতে গিয়ে দেখি, বংশ পরিচয় ছাড়া সেইখানেও ভাত নাই। আমাদের মামা নাই। চাচা নাই । টাকা নাই। নেতার চামচা হওয়ার মতো মাজার জোর নাই।সরকারি গুন্ডা হওয়ার মতো তেজ নাই। আমরা ব্রাত্য জনগণ। কিন্তু আমাদের আছে দীর্ঘ জীবন সংগ্রামের ইতিহাস। আমাদের পায়ের রগ কেটে আন্দোলন আপনারা থামাইতে পারবেন না।

মাঠে ময়দানে জামাতি সাপের বাচ্চারা তক্কে তক্কে আছে আন্দোলন বাগায়ে নেয়ার জন্য। অন্যান্য আন্দোলনের মতো এই আন্দোলনও হয়তো রাজনীতির বাঘ-ভাল্লুকেরা খেয়ে দিবে। সিসিফাসের মতো করে আমরা আন্দোলন ঠেলে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাবো। আর তারপরে আপনারা লাত্থি মেরে আমাদেরকে আমাদের আসল জায়গা দেখায়ে দিবেন। তারপরেও আমাদের আন্দোলন আপনারা থামাইতে পারবেন না। শোষিতের চিৎকারে আপনার কানের পর্দা ফেটে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘামে ভেজা, রক্তে ভেজা ছেলে-মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকান একবার! সত্যি করে বলেন তো, এই দুই পয়সার ছেলে-মেয়েগুলোর মুষ্টিবদ্ধ চোয়াল দেখে কি আজকে আপনার কলিজা কাঁপতেসে না? কাঁপবেই তো! শোষকের কলিজা না?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.