উপমা মাহবুব:
এক ঝকঝকে বিকেলে ওদের সঙ্গে দেখা। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত তারা দুরন্ত গতিতে মাঠ কাঁপাচ্ছিল। অসাধারণ নৈপুণ্যে একটা ফুটবলকে নিয়ে যাচ্ছিল এ মাথা থেকে ও মাথা। সেই ছোট্ট মেয়েদের এখন ভীষণ মন খারাপ। কারো কারো চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। তারা যে আজ বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল খেলায় হেরে গেছে।
বলছি কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত গ্রাম বাঁশজানীর বালিকা ফুটবলারদের কথা। তাদের নিষ্পাপ কিন্তু বিবর্ণ মুখ, লিকলিকে শরীর স্পষ্ট আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল জন্মগতভাবে কী ভীষণ রকমের অপুষ্টি আর অবহেলার শিকার এই কন্যা শিশুরা। জুতোহীন পা, বেণীবাঁধা শুষ্ক চুল আর আর রুক্ষ ত্বকের এই মেয়েরা যেন দারিদ্র্যের মুর্ত প্রতীক।
আমি ভাবছিলাম – আসলেই কি তারা হেরে গেছে? মন বললো – মোটেই না, বরং ওদের জয়যাত্রা সবে তো শুরু হলো।
কুড়িগ্রাম জেলাসদর থেকে ৪৩ কিলোমিটার দূরের সীমান্তঘেঁষা দারিদ্র্যপীড়িত গ্রাম বাঁশজানী। সেখানকার মানুষ কৃষিজীবী, তারা দু’বেলা পেট পুরে খেতে পারেন না। জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত নিম্ন। যোগাযোগসহ অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি সেবাব্যবস্থার যথেষ্ট প্রাপ্যতা নেই। বাঁশজানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থাও করুণ। ভঙ্গুর অবকাঠামো, অপ্রতুল শিক্ষা সামগ্রীর স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য ফুটবল খেলা প্র্যাকটিস করার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, সরঞ্জামাদি তো স্বপ্নমাত্র। অথচ প্রত্যন্ত গ্রামের সেই স্কুলটিতেই তৈরি হয়েছে একটি দুর্দান্ত ফুটবল টিম, তাও আবার প্রাথমিক শ্রেণীতে পড়ুয়া বালিকাদের নিয়ে!
এই মেয়েরা ভেঙ্গেছে রক্ষণশীল পরিবার এবং স্থানীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাঁধা। তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে সেইসব মৌলবাদী গোষ্ঠিকে, যারা টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ধর্মের নামে মেয়েদের ফুটবল খেলার বিরোধিতা করে মিছিল করেছিল। শুধু কী তাই, এই দলটির মধ্যে রয়েছে ছিটমহলের পাঁচটি মেয়ে।
আমি অবাক হয়ে ভাবি, কতোটা অদম্য হলে, দুটো দেশের রাজনীতির টানাপোড়েনে পিষ্ট জনপদের শিশুরা, তাও আবার কন্যাশিশুরা সব বাঁধা পেরিয়ে ঢাকা শহরে পাড়ি জমাতে পারে জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল খেলার জন্য। অথচ কিছুদিন আগেও তাদের পরিবারের বাংলাদেশ নামের জনপদেই অভিগম্যতা ছিল না।
তাই বলি, প্রান্তিক জনপদের দরিদ্রতম পরিবারের যে বালিকারা এতোটা বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে কয়েক হাজার স্কুলের অংশগ্রহণে আয়োজিত টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল পর্যন্ত আসতে পারে তাদের জন্য একটা হার মানে পরাজয় নয়। বরং আরও বড় লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে কিছুটা থমকে দাঁড়ানো মাত্র। আর তাদেরকে ঘিরে দাঁড়ানো মানুষগুলোও আমাকে মুগ্ধ করেছে। স্কুলের শিক্ষক, কুড়িগ্রাম ফুটবল ফেডারেশনের তরুণ উৎসাহি কর্মীসহ শুভানুধ্যায়ীরা সেই সুদূর উত্তরের জনপদ থেকে ঢাকায় এসেছেন এই কন্যা শিশুদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য। এঁরা আছেন বলেই এই মেয়েরা এগিয়ে চলেছে, এগিয়ে চলবে নিশ্চয়ই।
একটি গল্প শুনেছিলাম সাহিত্যিক আনিসুল হকের মুখে। ময়মনসিংহের দারিদ্র্যকবলিত প্রান্তিক জনপদ কলসিন্দুরের কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বালিকা ফুটবলাররা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে বিজয়ী হয়ে সারাদেশের মানুষের নজর কাড়ে। সেসময় আনিসুল হক তাদের নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করার জন্য একটি দল নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের গ্রামে। সেখানে পুরো একটি দিন তাঁরা খেলোয়াড়দের সঙ্গে সময় কাটান। শুটিং করেন। কাজ শেষে তাদের ইচ্ছে হলো এই ক্ষুদে খেলোয়াড়দের কিছু উপহার দেওয়ার।
আনিসুল হক খেলোয়াড়দের বললেন তাদের কাছে কিছু চাইতে, তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন তাদের ইচ্ছা পূরণের। উত্তরে মেয়েরা বলেছিল, ‘আমরা একবেলা ভালভাবে পেটপুরে খেতে চাই।’ আনিসুল হক অবাক হলেন, তিনি তাদের বললেন আরও ভালো কিছু চাইতে। তারা তখন বললো, ‘তাহলে আমাদের পাশাপাশি আমাদের পরিবারের সকলের জন্য একবেলা ভালভাবে পেট পুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন’।
সেই প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরা এখন জাতীয় দলে খেলে। মাত্র কিছুদিন আগেই তারা চার জাতি ফুটবল টুর্নামেন্ট জয় করে পুরো জাতির জন্য গর্ব বয়ে এনেছে। এটি ছাড়াও তাদের ঝুলিতে রয়েছে আরও অনেকগুলো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট জয়ের সাফল্য। বাঁশজানীর মেয়েরাও কলসিন্দুরের মেয়েদের পথেই হাঁটছে। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে তৃতীয় স্থান অর্জন করে তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরষ্কার গ্রহণ করেছে। দলটির অধিনায়ক স্বরলিকা পেয়েছে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি। আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশে নারীর অগ্রযাত্রার সাফল্য বয়ে আনার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিচ্ছে কলসিন্দুর, বাঁশজানীর মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট ছোট মেয়ে শিশুরা। কী ভীষণ দারুণ একটা ব্যাপার!
তবু মনে শংকা জাগে যে বাঁশজানীর বালিকা ফুটবলারদের সবার জীবন একই রকম হবে না। সমাজের সুবিধাভোগী পরিবারে জন্ম নিয়েও কত নারী প্রতিদিন পিছিয়ে পড়ছেন, হারিয়ে যাচ্ছেন, আর ওরা তো সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অংশ। তারপরও আশায় বুক বেঁধে আছি যে ওরা প্রত্যেকেই এগিয়ে যাবে।
সরকার, ফুটবল ফেডারেশনসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছ থেকে নিজেদের দক্ষতাকে আরও শাণিত করার জন্য পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাবে। যারা সামনের বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে পারবে না, তারাও সমাজে মাথা উঁচু করে চলবে।
আসুন সবাই ওদের আর্শীবাদ করি, বাড়িয়ে দেই সহযোগিতার হাত। নারীর অগ্রযাত্রার আলো বাঁশজানীর মেয়েদের মতো সাহসী প্রজন্মের হাত ধরে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়ুক। ভালো থেকো মেয়েরা। সব বাঁধা পেরিয়ে ফুটবল পায়ে ছুটে চল তীব্র গতিতে। পেরিয়ে যাও দেশ ছেড়ে দেশান্তরের পথ।
লেখক: উন্নয়নকর্মী।