সাদিয়া রহমান:
মোশাররফ করিমেরা ক্ষমা চান। অন্যদিকে বিউটির লাশ গড়াগড়ি দেয় সবুজ বাংলার কার্পেটের মতো সবুজ ঘাসে। তনুসহ আরও অনেক নাম না জানা তনুর ঘটনা চাপা পড়ে যায় মানুষের কর্মব্যস্ততায়, আত্মকেন্দ্রিকতায়। তনু, বিউটি, পূজা সবার জন্য সবার মনে সমবেদনা আছে। আর প্রকৃত অনূভুতি লিও তলস্তয় খ্যাত “ডেথ অফ ইভান ইলিচে”র মতো “যাক বাবা! আমার সাথে তো আর হয় নাই!” সারস পাখির মতো বালিতে মাথা ডুবিয়ে ভাবতে থাকা আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না! ফলাফল যা হওয়ার কথা ছিলো তাই হচ্ছে। মাঠে,ঘাটে,বাসে,বাজারে এমন কোনো জায়গা নাই যেখানে মেয়েদের ওপর হামলে পড়ছে না ধর্ষকামী মানুষেরা।
এমন একটা সমাজে আমরা বাস করছি যেইখানে ধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, ধর্ষকের মাথা উঁচু করে সমাজে চলাটাই গর্বের, এবং ধর্ষণ এবং ধর্ষককে জায়েজ করতে সদা সচেষ্ট ভালুকভাগ মানুষ (সিংহভাগ বলাটা আর পোষায় না)। এই যে অসুস্থ একটা সমাজ তা কি একদিনে হয়েছে? নাকি আস্ত একটা প্রজন্মকে গোড়া থেকে ভুল শিক্ষা, ভুল দৃষ্টান্ত স্থাপনের ফলাফলে আজকে সমাজের এই চিত্র দাঁড়িয়েছে?
বিগত কয়েক সপ্তাহ এমন একটা দিন নাই যেদিন ঢাকা শহরে মেয়েদের বাসে হেনস্থা হওয়ার নতুন খবর আসেনি। বিগত কয়েক সপ্তাহে এমন কোন দিন নাই যেই দিন তুচ্ছ কারণে রাস্তায় হেনস্থা হওয়ার খবর চোখে পড়ে নাই। ঢাকার বাইরে যে বাংলাদেশের একটা অংশ আছে, সেই অংশগুলো থেকেও উঠে এসেছে দিনের আলোয় এবং রাতের আঁধারে হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনা।
গ্রামাঞ্চলেও যেনো ধর্ষণের মহোৎসব চলছে। এবং একটা নির্দিষ্ট মহল যারা সংখ্যায় অনেক বেশি, তারা নানান ভাবে প্রতিটা ঘটনাতেই এখনো চোখ বন্ধ করে মেয়েদের চলন, বলন, পোশাকের দোহাই দিয়ে চলেছেন। সেইসব মানুষ মেয়েদের পোশাকের বাইরে পৃথিবীর খোঁজ রাখে কিনা জানা নাই। যদি রাখতো তবে হয়তো ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া এক প্রদর্শনীর কথা তারা জানতে পারতো। যেখানে ধর্ষণের শিকার এমন আঠারো জনের পোশাক তাদের জবানবন্দীসহ দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে রাখা হয়। এই প্রদর্শনী মূলত ক্যান্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর “তুমি কি পরে ছিলে” নামক একটি প্রজেক্ট থেকে অনুপ্রাণিত ছিলো। প্রদর্শনীটি মূলত এই ধারণা ভাঙ্গতেই আয়োজন করা হয়েছে যে, ধর্ষণের জন্য অথবা যেকোনো ধরনের যৌন হয়রানির জন্যই পোশাক দায়ী।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এই প্রদর্শনীতে একটা বাচ্চার লাল জামা থেকে শুরু করে পুলিশের ইউনিফর্ম এবং জিন্স টীশার্ট ও ছিলো। যা থেকে এইটা অন্তত স্পষ্ট হয় যে ধর্ষণ বা যেকোন যৌন হয়রানির জন্যই পোশাক কখনই দায়ী না।
প্রদর্শনীটি সেই দেশের দর্শকদের মাঝে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিলো। তারা নতুন আংগিকে তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবতে বসেছিলো তারপর। আমাদের মানসিকতা এখন কোনো প্রদর্শনী দিয়ে পরিবর্তন করা সম্ভব কিনা জানা নাই। তবে শিকড়ে না গেলে এই সমস্যা সমাধানের কোনো রাস্তা আদৌ এখন আর বের করা সম্ভব না।
আমাদের দেশে একদম ছোটবেলা থেকেই কিছু অদ্ভুত শিক্ষা নিয়ে বাচ্চারা বড় হয় যা পরবর্তীতে তাদের কাজ, অভিব্যক্তি, প্রতিক্রিয়া সব কিছুর ওপরেই একটা বিরূপ প্রভাব ফেলে। প্রথমত আমাদের ছেলেরা শিখে “মেয়েমানুষ মায়ের জাত, তাই মেয়ে মানুষকে সম্মান করতে হবে”। যেনো মেয়ে মানুষ একটা আলাদা ক্যাটাগরি এবং শুধু মায়েরা মেয়ে বলেই মেয়েদের সম্মান করতে হবে।
মেয়েরা শুধু যে মা হয়, তা তো না; তারা প্রেমিকা হয়, বউ হয়। তাই সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা যদি লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে প্রথম থেকে সাম্যবাদী শিক্ষাই দিতে হবে। লক্ষ্য যদি হয়ে থাকে, “আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই” তবে শিক্ষাও ভেদাভেদহীনভাবেই দিতে হবে। যখনই বলা হয়, “মেয়েদের”কে সম্মান করতে হয়, তখন তাদের মনে এমন চিন্তা আসতে পারে মেয়েরা বিশেষ কী যে তাদের আলাদাভাবে সম্মান করতে হবে? বিশেষ ব্যবহার কেনো করতে হবে?
আমরা মেয়েদের সম্মান দিবো এই জিনিসটা তাহলে হয়তো স্বাভাবিক না, বরং এটা হয়তো মেয়েদের প্রতি ছেলেদের করা কোনো অনুগ্রহ। তাই প্রথম থেকেই এই শিক্ষা দেয়া উচিত “মানুষ”কে সম্মান করতে হবে।
খেলনা নির্বাচন এবং খেলার মাঠের ভেদাভেদ মনন তৈরিতে একটা বিশাল ভূমিকা পালন করে। অভিভাবকেরা অনেক সময় ছেলে বাচ্চাকে হয়তো পিস্তলের মতো ধ্বংসাত্মক খেলনা নিয়ে খেলতে দিলেও মেয়ে বাচ্চাকে বলেন যে, অমুক খেলনা মেয়েদের জন্য নয়। কিন্তু এই বিভাজনগুলো দিয়ে ছোটবেলা থেকে অবচেতনভাবেই তাদের উভয়ের মধ্যেই এই ধারনা জন্মায় ছেলেরা ধ্বংসাত্মক হতেই পারে, কিন্তু মেয়েদের সবসময় সুশীল হতে হয়। ছেলেরা ভাংলেও মেয়েদের গড়তে জানতে হয়। সামান্য খেলনা দিয়েও তাদের মাঝে দুই রকমের ক্ষতিকর মানসিকতা তৈরি করা দেয়া হয়।
সবচেয়ে ভয়ংকর যেই ঘটনাটা এইখানে ঘটে সেটি হলো, বাচ্চা বয়সে তাদের অসম্মতিতে অন্যের কোলে যেতে বাধ্য করা। অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, এইখান থেকে সে এমন শিক্ষা পেতে পারে যে জোরপূর্বক সম্মতি আদায় করাটা অস্বাভাবিক কিছু না। অথবা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু ঘটার মাঝে অপ্রাকৃতিক কিছু নেই।
ছোটো থেকে “লজ্জা নারীর ভূষণ” এই জাতীয় প্রবাদ্গুলো শুনে বড় হলেও ছেলেমেয়ে উভয়েই নির্লজ্জতাকেই পৌরুষ ভেবে বড় হয়। আর নির্লজ্জতা থেকেই জন্মায় থেকে শক্তির অপব্যবহারের একটা প্রবণতা। কেননা তারা জানে যাই হয়ে যাক লজ্জা করে থাকাই একজন মেয়ের সম্মানের পরিচায়ক।
এগুলো মোটামুটি ফাঁস হওয়া প্রশ্নের মতোন একটা ছঁক একে দেয় কোমলমতি শিশুদের মনে। এর বাইরে যখনই কিছু ঘটে তার উত্তর আর প্রতিক্রিয়া হয় কুমিরের খাঁজকাটা লেজের গল্পের মতন। প্রেক্ষাপট যাই হোক, ঘটনা যতো লঘু বা গুরুতরই হোক না কেনো, ভাংগা রেকর্ড বাজতে থাকে “পোশাক” “সন্ধ্যা” “একা” “কী দরকার” “ঘর” “বাহির” “প্রলুব্ধ” হেন-তেন আরও নানা কিছু।
এই কারণেই প্রতিটা মানুষকেই ছোট থেকেই সঠিক সাম্যের শিক্ষা দেয়াটা খুব জরুরি। তাদের জানতে হবে সম্মানের মানদণ্ড সবার জন্য এক। সম্মতি এবং প্রত্যাখানের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিটা মানব সন্তানের জন্মগত অধিকার। সম্মান প্রতিটা মানুষের প্রাপ্য। জুলুম সবক্ষেত্রেই অন্যায়।
“পুরুষতন্ত্র” “বিচারহীনতার সংস্কৃতি”, র্যাডিকাল ফেমিনিজম” এইসব গালভরা কথা বুঝার মতোন অবস্থা বেশিরভাগ মানুষেরই নাই। যুক্ত অক্ষর যুক্ত কোনো শব্দ উচ্চারণ করলেও তাই সবার মনে আঘাত লেগে যায়। অন্যদিকে লাশের স্তুপ ভারী হতে থাকে।
বিচারবিভাগ যদি কঠোর হয়ে কয়েকটা শাস্তি বাস্তবায়ন করে, তবে একটা ভীতি জন্মাবে, তবু মানসিকতার সমস্যাটা বীজ হয়ে ভিতরেই থেকে যাবে। তাই এবার দরকার একদম ঢেলে গোঁড়া থেকে নতুন করে সাজানো। সময় লাগবে অনেক। তবু একটা মানসিকভাবে সুস্থ সমাজ চাইলে সেটাই এখন দীর্ঘমেয়াদী, কিন্তু সূদুরপ্রসারী উপায়।