গোধূলি খান:
সামাজিক মিডিয়াতে কিছুদিন এদের নিয়ে তুলকালাম চলেছে। টেলিভিশনের পর্দায় তাদের প্রচারিত অনুষ্ঠান দেখে অনেকে রাগ করেছেন, অনেকে কষ্ট পেয়েছেন, অনেকে পাত্তা দেননি। অনেকে আন্দোলন করছে।
আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, এদের নিয়ে ভাবার কিছু নেই। নেই তাদের নিয়ে কথা বলার। নেই এদের নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট করার। কারণ ওরা যা করেছে তার জন্য টাকা পেয়েছে। টাকার বিনিময়ে এরা কথা ও কাজ করে চলেছে। মোশাররফ করিম, যা বলেছিলেন তা শুধুমাত্র একটা ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের এক পর্বের অংশ মাত্র। তার জন্য উনি টাকা পেয়েছেন। পার্শ্ববর্তী দেশের এক অনুষ্ঠানের অনুকরণে করা, কয়েক পর্বের প্রথম পর্ব ছিল পোশাক নিয়ে।
এখানে উল্লেখ্য যে, সে দেশের শিল্পীরা সময়ে সময়ে তাদের দেশে ঘটে চলা অনিয়মের প্রতিবাদ করে অর্থপ্রাপ্তি ছাড়া। নাগরিক দায়িত্ব পালন করে অন্যায়ের প্রতিকার চেয়ে। আমাদের দেশের শিল্পীরা সে ক্ষেত্রে যোজন যোজন দূরে।
এ অনুষ্ঠানে মোশাররফ করিম পোশাক ও ধর্ষণ নিয়ে খুব সুন্দর কথা বলেছিলেন অনুষ্ঠানে। কিন্তু একদল প্রবল পোশাকানুভূতি সম্পন্ন মানুষের চাপে উনি মাফ চেয়েছেন, তাতেও দোষের কিছু নেই। এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত বা মতামত হলে তার পক্ষে বা বিপক্ষে থাকার কথা আসে। নিজের জীবন অনেক মূল্যবান, অযথা একদল কাঠমোল্লার হাতে প্রাণ দেবার কোনো কারণ দেখি না। উনি দীর্ঘজীবী হোন এবং রোমান্টিক ভাঁড়ের অভিনয় করে আমাদের আনন্দ দিক। আমাদের জাতীয় জীবনে আনন্দের উপলক্ষ বড্ড কম।
আসি সম্প্রতি প্রচার হওয়া আরেকটি জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে। নায়িকা পূর্ণিমার ও সিনেমার খল চরিত্রের অভিনেতা মিশা সওদাগর ছিল সেই অনুষ্ঠানের মূল পাত্র-পাত্রী। পূর্ণিমা ও মিশা সওদাগরের আলোচনার বিষয় ছিল ধর্ষণ। খুবই সেন্সেটিভ একটা বিষয়, বর্তমানে আমাদের জাতীয় জীবনের খুব কঠিন একটা সমস্যা। ধর্ষণ বেড়ে গেছে আশংকাজনক হারে। প্রতিদিনই খবরের কাগজ খুললে পাওয়া যায় একটি দুটি ধর্ষণের ঘটনা, দেড় বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা, কেউ আজ নিরাপদ না ধর্ষকদের হাত থেকে। আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্ষণের কারণে একটা জীবন শুধু না, পুরো পরিবারের উপর নেমে আসে অমানিশার মেঘ। পদে পদে নিগৃহীত হয় ধর্ষিতা ও তার পরিবার।
এধরনের একটি বিষয় নিয়ে আলাপচারিতা চালায় পূর্ণিমা ও মিশা সওদাগর। তাদের আলোচনা দেখে আমার মনে হয়েছিল, ধর্ষণ নিয়ে এরা কেউ পাশের দেশের কোন অনুষ্ঠান দেখেনি বা অনুষ্ঠানের প্রযোজক ও পরিচালক অনুকরণে স্ক্রিপ্ট বানিয়ে উঠতে পারেনি। না পারার কারণে ওদের দুজনের উপর ছেড়ে দেয় বিষয়টি। আর তাতেই বের হয়ে আসে, এদের শিক্ষা, মন-মানসিকতা। বিষয়ের গভীরতা বোঝার মতো মন এদের গড়ে ওঠেনি। তাদের নিজস্ব চিন্তার পরিধি বা ম্যাচুউরিটির লেভেল এ অনুষ্ঠানে প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়। পূর্ণিমার হেসে গড়িয়ে পড়া বা মিশার ব্যাপক আনন্দ নিয়ে আলোচনায়, বারবার মনে হচ্ছিল ধর্ষণ খুব মুখোরোচক বিষয়। দেখে শুনে একবারও মনে হয়নি তাদের মধ্যে বিবেকের কিছু বাকি আছে। তারা সেলুলয়েডের বাইরের আসল জীবন নিয়ে ওয়াকিবহাল নন। তারা রুপালী জগতে বসবাস করছে। বাস্তবের কঠিনতা স্পর্শ করেনি।
আরেকভাবেও ভাবা যায়, আমাদের সমাজে ধর্ষণ একদল পুরুষের কাছে উপভোগ্য বিষয়, তারা আলাপ করতেও উপভোগ করে, এবিষয়ে নিউজ পড়তেও উত্তেজিত বোধ করে। শক্তি প্রদর্শনের জন্য শারীরিকভাবে দুর্বলকে আঘাত করে নিজের পৌরষ জাহির করার দলের। ধর্ষণ হলো নারীর উপর করা সবচেয়ে অমানবিক, ন্যাক্কারজনক, ঘৃণিত আঘাত। আর এই ধর্ষণ নিয়ে হাসি-তামাশা করার মতো মানসিকতা কতোটা অমানবিক তা বোঝার মতো ক্ষমতা নেই দেখলাম পূর্ণিমা, মিশা ও টিভি চ্যানেলটির পরবর্তী বক্তব্যে। অনেকটা চাপে পড়ে মাফ চাওয়া, কারণ পূর্ণিমা লিখেছে, “আমি যদি কারো মনে আঘাত দিয়ে থাকি…” এতো কিছুর পরেও “যদি” বলায় মনে হল উনি কষ্ট দেয়ার মতো কিছু বলেননি, কেউ যদি পেয়ে থাকে”!
আমাদের দেশের বর্তমানের রূপালী জগতের মানুষরা অর্থ ও ক্যারিয়ারের স্বার্থে সবকিছু করে। তারা নিজেদের দূরাকাশের তারা ভাবে। মাটির মানুষের জীবনবোধ, বেদনা, কষ্ট তাদের স্পর্শ করে না। আমাদের জাতীয় সমস্যা কী বা একটা দেশের বর্তমান পরিস্থিত কী? কোনকিছুর খবরই তারা রাখে না যদি না তা ক্যারিয়ার-সম্পর্কিত হয়।
মিশা ও পূর্ণিমার আলাপচারিতায় প্রমাণ হয়, আমাদের সমাজের একদল পরিচালক মানুষের জন্য সিনেমার গল্প লেখে না। তাদের ফিল্মি ফর্মুলায় ধর্ষণের দৃশ্য আসে তা গল্পের প্রয়োজনে না। বরং ধর্ষণ, যৌনতাকে কেন্দ্র করে চিত্রনাট্য লেখা হয়। আর ইভটিজিং তো সিনেমায় প্রেমের মূলমন্ত্র।
“সিনেমা জগতের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা সুন্দর করে ধর্ষণের মাধ্যমে বিনোদন দেয়ার দায়িত্ব দীর্ঘদিন ধরে পালন করে আসছে। ফলে যৌন অপরাধ যে বড় ধরনের অপরাধ তা একদল মানুষের কাছে বিস্ময়ের বিষয় হয়ে দেখা দেয়, এক্ষেত্রে জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ বড় উদাহরণ। সিনেমায় ধর্ষণের এহেন চিত্রায়ন যৌন অপরাধ স্বাভাবিক করে ফেলে। এ অবস্থার পরিবর্তন আসা অতি জরুরি, সিনেমা জগতের জড়িতরা এবিষয় নিয়ে ভাববেন আশাকরি।