সুব্রত ব্যানার্জী:
শুধু সাম্প্রতিককালে বললে ভুল হবে, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ধর্ষণের বর্বরতার চিত্র নতুন কিছু নয়। ধর্ষণের কারণ, ধরন, প্রকৃতি, সংখ্যা নিয়ে সংবাদপত্রে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এবং বিচার বিশ্লেষণও হয়েছে। সঙ্গত কারণেই আজ আমি ধর্ষণ ও নারীর বিরুদ্ধে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে লেখার চেষ্টা করেছি।
বর্তমানে বাংলাদেশে আমি নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা নিয়েই গবেষণা করছি। একজন অপরাধবিজ্ঞানের ছাত্র, শিক্ষক এবং গবেষক হিসাবে নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা নিয়ে কাজের সময় অপরাধ বিজ্ঞানের বিভিন্ন নারীবাদী তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ষণকে ব্যাখ্যা করেছি, বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্ষণের ঘটনা ও বাংলাদেশী সমাজের বৃহৎ কাঠামো ও সাংস্কৃতি বিবেচনা করেই।
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নারীবাদী লেখক, তাত্ত্বিক, গবেষক, এক্টিভিস্টদের একটি প্রধান আলোচনার বিষয়। আমি যদি স্পষ্ট করে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতাকে দেখি, তাহলে দেখা যায়, ধর্ষণের নারীবাদী মতবাদগুলি উদার থেকে রেডিক্যাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানীকে ব্যাখ্যা করেছে। প্রথমে লিবারেল বা উদারপন্থী নারীবাদী লেখকরা ধর্ষণকে নারীর স্বতন্ত্র স্বাধীনতার প্রতি লৈঙ্গিক হামলা হিসেবে বিবেচনা করেছেন, এবং এই তাত্ত্বিকগণ মূলত ধর্ষণের শিকার নারীদের ব্যক্তিগত ক্ষতির বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
অন্যদিকে রেডিক্যাল নারীবাদী তাত্ত্বিকগণ বিপরীতে দাবি করেন যে ধর্ষণ হচ্ছে নারীর বিরুদ্ধে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও গোষ্ঠী স্বীকৃত এক গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। এছাড়া রেডিক্যাল তাত্ত্বিকরা ধর্ষণকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটি বিস্তৃত ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসাবে চিহ্নিত করে, যা কিনা সমগ্র নারীজাতির উপরই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
আমরা যদি আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা করি তাহলে দেখা যায়, রেডিক্যাল নারীবাদী তাত্ত্বিকরা ধর্ষণকে প্রায়ই নিম্নলিখিত তিনটি বৈশিষ্ট্যের এক বা একাধিক অংশে ভাগ করেন।
প্রথমত, ধর্ষণকে তারা নারীর সার্বভৌমত্বের বঞ্চনা হিসাবে বিবেচনা করেন, বিশেষ করে ধর্ষণ বলতে নারীর যৌনাঙ্গ ও শরীরের উপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বোঝান। ফলস্বরূপ, ধর্ষণকে তারা পুরুষের শোষণের একটি প্রধান হাতিয়ার এবং সমাজে নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি বৈষম্য বজায় রাখার মাধ্যম হিসাবে মনে করেন।
দ্বিতীয়ত, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মনে করে ধর্ষণের মাধ্যমে নারীকে পুরুষের পূর্ণ বশবর্তী করা সম্ভব।
তৃতীয়ত, রেডিক্যাল নারীবাদী তাত্ত্বিকরা মনে করেন ধর্ষণের সংস্কৃতি ঔপনেবেশিক শাসন আমল ও ইতিহাসের শুরু থেকেই নারীর প্রতি নিয়ন্ত্রণ আনার জন্য এক মোক্ষম অস্ত্র হসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আমরা যদি ধর্ষণ মানে নারীর প্রতি পুরুষের ক্ষমতা প্রদর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে রেডিক্যাল নারীবাদী তাত্ত্বিকদের উপরোক্ত মতবাদ বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যায় কিছুদিন আগে বগুড়ায় কিশোরীকে ধর্ষণের পর মা ও কিশোরী মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে ধর্ষকগোষ্ঠী। আবার অর্থবিত্ত আছে বলেই আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে বনানীর একটি আধুনিক হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণ করতে পেরেছে। এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, পুরুষ যখন ক্ষমতা প্রদত্ত হয় তখন সে ধর্ষণকে খুব স্বাভাবিক একটি বিষয় মনে করে। অর্থাৎ ধর্ষকামী তখনই ধর্ষণে প্রবৃত্ত হয় যখন সে মনে করে লৈঙ্গিকভাবে সে ক্ষমতাশীল এবং তার এ ক্ষমতা সমাজে স্বীকৃত এবং নারীর অবস্থান ও পদমর্যাদা তার অনেক নিচের স্তরে।
আসলে সুক্ষভাবে দেখলে দেখা যায়, সমাজের মধ্য নিহিত থাকা এই গোষ্ঠীগত ক্ষমতা সে অপব্যবহার করে এবং এক্ষেত্রে ক্ষমতাবান ‘পুরুষতান্ত্রিক’ সমাজ তাকে এই সুযোগে সহযোগিতা করতে পিছপা হয় না। আপনারা যদি একটু গভীরভাবে দেখেন তাহলে দেখা যায় বনানী রেইন্ট্রি হোটেলের কর্তৃপক্ষও আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলেকে ধর্ষণ সংঘটনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে।
অপরদিকে ধর্ষণের ক্ষেত্রে নারীবাদী তাত্ত্বিকরা বলেছেন অনেকক্ষেত্রেই ধর্ষণ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে উক্ত নারীর সাথে সম্ভাব্য ধর্ষকের কয়েক ধাপে পরিচয় হয়ে থাকতে পারে। সংবাদ মাধ্যমে আমরা প্রায়ই দেখি যে ধর্ষক পূর্বপরিচিত।
নারীবাদী তাত্ত্বিকরা বলেছেন, নারীদের একটা স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহনশীলতার পরিচয় দেওয়া অথবা এড়িয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি। আমরা যদি আমাদের দেশে লক্ষ্য করি তাহলে অনেকক্ষেত্রেই কিশোরীদের প্রায়ই উত্যক্ত করা হয় রাস্তা ঘাটে, বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে। কোনো অনাকাঙ্খিত দোষারোপের ভয়ে নারীরা সাধারণত এই ধরনের যৌন হয়রানী বেশীরভাগ সময়ই সহ্য করে যায়। এক্ষেত্রে পরিবার-পরিজনও ভুক্তভোগী নারীকে পরামর্শ দেয় প্রতিবাদ না করার জন্য, কারণ নারীকে যৌন হয়রানী করা হয়েছে এই সংবাদ জানাজানি হলে আমাদের সমাজে আশ্চর্যজনকভাবে দোষারোপ করা হয় ভুক্তভুগী নারীকে, অথচ অভিযুক্ত পুরুষ বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়, নারীকে দেখলে উল্টো তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়।
নারীবাদীরা নারীদের এই ধরনের আচরণকে সংজ্ঞায়িত করেছেন “সহনশীল প্রতিক্রিয়া” হিসাবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই “সহনশীল প্রতিক্রিয়ার” ফলে সম্ভাব্য অপরাধী নিজেদের বেশী শক্তিশালী মনে করে এবং ভবিষ্যতে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটন করতে সাহস পায়। এক্ষেত্রে নারীবাদী তাত্ত্বিকরা অপরাধীর সাথে প্রথম পরিচয় থেকে শুরু করে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে নারীদেরকে ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য শক্তভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন।
আমরা যদি হবিগঞ্জে কিশোরী বিউটি আক্তারের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটিই বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যায়, বিউটিকে দিনের পর দিন উত্যক্ত করা হয়েছে। সমাজ এ ঘটনা দেখেও নিশ্চুপ থেকেছে এবং এর ফলে ধর্ষক বিউটিকে এক মাস আটকে রেখে ধর্ষণের সাহস দেখিয়েছে। ধর্ষণের শিকার বিউটি চেয়েছিল তার সহনশীল প্রতিক্রিয়ার” আবরণ থেকে বের হয়ে আসতে, যার সুবাদে ধর্ষণের পর সে ও তার পরিবার ধর্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করে। কিন্তু এখানেও দেখা যায় দীর্ঘদীন ধরে আইন প্রনয়ন স্ংস্থা বা সমাজের কেউ অপরাধীকে ধরতে এগিয়ে আসেনি বা কেউ প্রতিবাদ করেনি। ফলস্বরুপ ধর্ষক নিজেকে আরো শক্তিশালী মনে করে, প্রাণভয়ে নানাবাড়িতে পালিয়ে থাকা বিউটিকে পুনরায় ধর্ষণপূর্বক হত্যা করতে পিছপা হয়নি।
শুধু বিউটি নয়, সাম্প্রতিককালে যৌন হয়রানী মেনে নেওয়ার এই সহনশীল সংস্কৃতির কারণে অনেক নারীকে ধর্ষণের শিকার ও জীবন দিতে হয়েছে।
ধর্ষণের পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভুগী নারী বা তার পরিবার সামাজিকতার ভয়ে বিষয়টি গোপন রাখতে বাধ্য হয়। অনেক ধর্ষনের ঘটনায় এজন্য প্রকাশ্যে আসে না এবং পুলেশের কাছে রিপোর্টেড হয় না। অভিযোগ করতে আসলেও অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষিতা ও তার পরিবারকে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানো হয়। বনানীর ধর্ষণের ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী সাহস করে তা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু, এক্ষেত্রেও পুরুষশাসিত সমাজের অনেকে প্রশ্ন করেছে মেয়ে দুটো রাতে হোটেলে গেল কেন? তাদের জন্মদিনের পার্টিতে যাওয়ার কি প্রয়োজন ছিল?
আমার বক্তব্য হচ্ছে নারীদের যেকোনো জায়গায় যে কোন সময়ে যাওয়ার অধিকার আছে। একজন নারী রাতে কোথাও গিয়েছে বলেই তাকে ধর্ষনের শিকার হতে হবে? মানূষ হিসাবে আমাদের মূল্যবোধ বা বিবেক এতটা সংকীর্ন হয়ে গেছে? একটু গভীরভাবে যদি দেখি, সমাজে আসলে নারীদের ভয় কাদের নিয়ে? রাতে কাদের ভয়ে নারীরা বাইরে যেতে পারে না? শুধু রাতে বলব না ধর্ষন দিন দুপুরে, লোকালয়ে, জনসম্মুখেও অহরহ সংঘটিত হচ্ছে।
এক্ষেত্রে নারীবাদীদের সাথে মিল রেখেই বলবো, নারীর মধ্যে ধর্ষণের ভয়ের যে সংস্কৃতি বিরাজ করছে তা একমাত্র পুরুষের জন্যই। নারীর ভয় বন্য পশুকে নিয়ে নয়, বরঞ্চ পুরুষরুপী পশুকে নিয়ে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাঠামো ও মননকে নিয়ে।
ধর্ষণের সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করতে গেলে আমার কাছে অনেক সময় শুধু ধর্ষণের বৃহত্তর সামাজিক এবং মতাদর্শগত শিকড় এবং কাঠামো উল্লেখই মুখ্য মনে হয় না, বরঞ্চ ধর্ষণের যৌন সহিংসতার প্রকৃতি ও ধরন বুঝতে হলে অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব এবং ভিকটিম নারীর উপর ধর্ষণের প্রভাব বোঝা জরুরি মনে হয়।
যদিও নারীর উপর যৌন অত্যাচার করার সময় অপরাধীরা ধর্ষণের অভিপ্রায়গুলির মধ্যে পার্থক্য রাখে, তারপরও আমার মনে জিজ্ঞাসা আসে, পুরুষেরা কেন নারীর প্রতি প্রতিশোধ নিতে বা নারীর ক্ষতি করতে ধর্ষণকেই বেছে নেয়? এ প্রশ্নের জবাব দিতে গেলে দেখা যায় অনেক পুরুষ যারা নারীর ক্ষতি করতে চায়, সেক্ষেত্রে ধর্ষণের মাধ্যমে সে নারীর উপর প্রভাব বিস্তার ও প্রতিশোধ নেওয়াকেই উত্তম মনে করে। কারণ নারীবাদীদের মতে, ধর্ষণের ফলে একজন নারী যে দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তা অপূরণীয়।
এক্ষেত্রে কাহিল (২০০১) বলেছেন, ধর্ষণের ফলে যে আঘাত নারী সহ্য করে, তা তার মুখমণ্ডলে সরাসরি আঘাত করার সমতুল্য। এছাড়া ধর্ষণের শিকার নারী যারা বেঁচে থাকেন তাদের যৌনতা ও যৌনাঙ্গ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ধর্ষণের পরের মাস এবং বছরগুলিতে তাদের এই শারীরিক কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। এক্ষেত্রে ম্যাকনিন বলেছেন ধর্ষণের প্রকৃতি সহিংস হোক আর নাই হোক, নারী মানসিক ও শারীরিকভাবে যে ক্ষতির সম্মুখীন হয় সেই ক্ষতি বুঝতে হলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রাজনীতি আর সংস্কৃতি বোঝা অত্যাবশ্যকীয়।
তনুর কথা মনে আছে? তনু নামটির প্রতিশব্দ কি জানেন? তনু মানে শরীর! হ্যাঁ, তনুর শরীরই তার প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার ধর্ষণ ও হত্যার সময়। ধর্ষণের পর তার শরীরকে নিশংসভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছিল ধর্ষক।
কীভাবে একটি ধর্ষণ শুধু নারীর উপর বিরুপ যৌন অত্যাচার সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং তার প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী সেটা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাঠামো দেখলেই বোধগম্য হয়। এই ধরনের যৌনতা দ্বারা আমাদের নারীদের যে কী ক্ষতি করা হয়েছে তা শুধু একজন ভুক্তভোগীই বলতে পারবেন।
নারীবাদী শেফার বলেছেন, একজন ধর্ষক যে কারণেই নারীকে ধর্ষণ করুক না কেন, একজন ধর্ষিতা সারা জীবন মনে করেন তিনি একজন মানুষ নন, তিনি এমন একজন যে কিনা আত্মমর্যাদাহীন, অস্তিত্বহীন, অনুভূতিহীন, সম্মানহীন কেউ। ধর্ষণ একজন নারীকে নৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়। হ্যাম্পটন (১৯৯৯) এই বিষয়টিকে দেখেছেন “মোরাল ইনজ়ুরি” হিসাবে। এ প্রেক্ষিতে যদি আলোচনা করি তাহলে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় লাখ লাখ মা-বোনকে পাকিস্তানি সেনারা ধর্ষণের মাধ্যমে শুধু আমাদের মা-বোনের মনোবল নয়, সমগ্র বাঙ্গালী জাতির মনোবল ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিল। বিজয় শেষে সেসব বীরাঙ্গনা নারীরা বছরের পর বছর মানসিক ট্রমা নিয়ে বেঁচে ছিলেন আবং আছেন এখনও।
প্রায়শই বিভিন্ন গবেষণা ও সংবাদ মাধ্যমে দেখা যায়, আমাদের সমাজে ধর্ষণের শিকার নারীরা কিভাবে তাদের এই “মোরাল ইনজ়ুরির” সাথে যুদ্ধ করে আছেন। যারা পারছেন না, তারা আত্মহত্যা করছেন। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় গাজীপুরে শিশুকন্যার ধর্ষণের বিচার না পেয়ে লজ্জায়, দুঃক্ষে, ক্ষোভে কী নির্মমভাবে রেললাইনের ট্রেনের চাকার আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।
সর্বশেষে, আইনী নারীবাদী বা লিগ্যাল ফেমিনিজম তাত্ত্বিক জেন কিম বলেছেন, ধর্ষকদের গ্রেফতার না করা, বিচার ও শাস্তি ঠিকমতো না হওয়ার কারণে ধর্ষণের হার বৃদ্ধি পায়। এছাড়া বিভিন্ন আইনে নারীদের সমান অধিকার নিশ্চিন্ত না হওয়ার কারণে নারীদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
আইনী নারীবাদীদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ঐতিহাসিকভাবেই পুরুষশাষিত সমাজ আইন ও বিচারব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি করেন যেন সেটা নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক হয় এবং নারীদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আইন তৈরি করছে পুরুষ, বিচার করছে পুরুষ, আইন পাশও করছে পুরুষ। আমরা যদি আমাদের দেশের নারী নির্যাতন রোধে প্রণিত আইনগুলো দেখি সেখানে স্পষ্ট দেখা যায় দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যপ্রণালী, সাক্ষ্য আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে এখনও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং আইনগুলো নারীদের সুরক্ষা করার জন্য অপ্রতুল।
যে দেশে বিবাহিত নারী স্বামী দ্বারা ধর্ষিত হওয়া অপরাধ নয়, যে দেশে নারী ধর্ষিত হলে বিচারব্যবস্থার সামনে তাকে প্রমাণ করতে হয় ধর্ষণে নারীর সায় ছিল না, যে দেশের দণ্ডবিধিতে নারীর যৌনাঙ্গে পুরুষের যৌনাঙ্গের অনুপ্রবেশকেই একমাত্র ধর্ষণ বলা হয়, তার শরীর বা শরীরের যে কোনো অঙ্গে যৌন আচরণ ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির মধ্য সজ্ঞায়িত করা হয় না, যে দেশে অহরহ ধর্ষকের জামিন হয়, এবং ধর্ষক জামিনে মুক্তি পেয়ে সেই ধর্ষিতাকেই পুনরায় ধর্ষণ করে, যেখানে পুলিশের কাছে একটা ধর্ষণের অভিযোগ করতে হলে উল্টো নারীকেই দোষারোপ করে হেনস্থা করা হয়, যে দেশের সাক্ষ্য আইনের বিশ্লেষণের ফলে সমাজ শুধু ধর্ষণের শিকার নারীর দিকে আঙুল তুলে তা-ই নয়, ওই নারীকেই ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট” দ্বারা প্রমাণ করতে হয় তিনি ধর্ষণের শিকার, সেই দেশে ধর্ষণের নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র নিছক কোনো উপহাস নয়।
***লেখক: সুব্রত ব্যানার্জী,
মাস্টার্স স্টুডেন্ট ও টিচিং এসিস্টেন্ট, ক্রিমিনোলজী বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অফ অটোয়া, কানাডা এবং সহকারী অধ্যাপক,
ক্রিমিনোলজী এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল, বাংলাদেশ।
ইমেইল: [email protected]