আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!

সাবরিনা স. সেঁজুতি:

মেয়ে বলে এ সমাজে ওর জন্ম ছিল অনাকাংখিত, ধর্মীয় বিধিনিষেধ দিয়ে পৃথিবীতে তার আগমন হয়েছিল গোপনে, নিচু স্বরে । নিচু স্বরে তার আগমনকে ছোট করা হচ্ছে বুঝতে পেরে প্রথম যে ধ্বনি তুমি ওর কানে দিয়েছিলে, সেটা অন্য সব মুসলিম পরিবারগুলোর প্রথা অনুসরণ করে আযানের ধ্বনি ছিল না, ছিল বিদ্রোহী কবিতা। মেয়ের নামও রেখেছিলে তাই বিদ্রোহী-র প্রতিশব্দে।

আমি বলেছিলাম, “মেয়ের নাম আমার নামের সাথে মিলিয়ে রাখতে হবে। আর এ ব্যাপারে আমি আপোষহীন, তবে নামের অাদ্যাক্ষরের সাথে মিল না করে অর্থের সাথে মিলিয়ে রাখলেও চলবে”। তাই তোমার নামের অাদ্যাক্ষর আর আমার নামের অর্থের সাথে মিলিয়ে তুমি মেয়ের নাম দিলে দ্রোহী । কোনরকম দ্বিধা ছাড়া সে নামে-ই তুমি তাকে পরিচয় করিয়ে দিলে পৃথিবীতে,  কিন্তু নামটা ধর্ম সম্মত হলো কী হলো না, সে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে আমাকে অনেকবার অনেক জায়গায়, আমি অবশ্য তাতে মোটেও অপ্রস্তুত হইনি। তুমি ইচ্ছে করেই মেয়ের নামের সাথে আমাদের নামের কোনো টাইটেল জুড়ে দিলে না, তুমি চেয়েছিলে সে বড় হোক তার নিজের পরিচয়ে, কোনো বংশ পরিচয় কিংবা অন্ধ গোড়ামির স্পর্শ ছাড়া।

মেয়ে আমার তোমার মন মতোই হয়েছে, সবাই বলে, “বাবার মেয়ে”। যুক্তিতে, শক্তিতে, বুদ্ধিতে সে সম্পূর্ণা, কিন্তু মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা তার বুদ্ধি এবং শক্তিকেও ছাড়িয়ে যায়। মেয়েকে আত্ননির্ভরশীল করে গড়ে তোলার জন্য তুমি ছোটবেলা থেকেই তাকে দিয়েছো আত্ম-রক্ষার সকল প্রশিক্ষণ। মা হিসেবে আমার যে তাকে একটা ফুটফুটে মেয়ের সাজে দেখতে ইচ্ছে করে না, তা নয় । তবু তার দৃঢ় সবল আত্মবিশ্বাসী রূপটাও আমার খুব ভালো লাগে।

তবে সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে ওর আবৃত্তি। আমি জানালার পাশে বসি, আর কী সুন্দর করে আবৃত্তি করে, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি। দ্রোহী প্রায়ই একটা কথা বলতো আমাকে, “মা একদিন যদি আমাকে খুঁজে না পাও, তবে বুঝবে আমি সাগর পাড়ে গিয়েছি একটু বিশুদ্ধ বাতাসের খোঁজে। তুমি তখন ভয় পেও না মা, আমি ফিরে আসবো, তোমার জন্য ছোট্ট একটা চিরকুট ছেড়ে যাবো যাতে কেঁদে তুমি চোখ না ভাসাও, খুঁজে নিও।“

কাল রাত থেকে আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজছি সেই চিরকুট, কই পাচ্ছি নাতো! কোথাও নেই। দু’দুটো রাত চলে গেল, দ্রোহীর কোনো খবর নেই, হারিয়ে যাবার মেয়ে তো সে নয়! ফোনটা বন্ধ, সকল বন্ধু বান্ধবীর বাসায় ফোন দেয়া হয়েছে, কোথাও নেই । তুমি তোমার চেনাজানা সকলের সাথে যোগাযোগ করলে, কক্সবাজারে লোক পাঠালে, সব জায়গায় খোঁজ নেয়া হলো, এমন কোনো মাধ্যম নাই যা দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করোনি তুমি, তবু কোনো খোঁজ পেলে না!

তাহলে মেয়েটা আমাদের কোথায় গেল? তোমার মাথা সব সময়ই অনেক ঠাণ্ডা বলেই জানতাম আমি, কিন্তু এবার তোমার অস্থিরতা আমকে ভাবিয়ে তুলেছে। দু’ রাত তুমি চোখের পাতা একবারের জন্যও এক করোনি । আমি একটু পর পর ওর ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়াচ্ছি । এই জানালাটা দিয়ে অনেক দূর দেখা যায়, যদি দেখি হেঁটে আসছে মেয়ে আমার, সেই আশায় । নাহ! কোনো খবর নেই । কই গেল, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।

১৯ বছরের মেয়ে আমার ইউনিভার্সিটি থেকে হয় টিউশনি করাতে যায়, না হয় যায় ওর বন্ধুর বাসায়। সাধারণত সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ ঘরে ফিরে আসে । যেদিন দেরী হয়, ফোন দিয়ে জানিয়ে দেয়। গত দুই দিন ধরে না তার কোনো ফোন এসেছে, না তার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে! কীভাবে সম্ভব?

দ্রোহীর শেষ যে খবর আমরা পেয়েছি তা হলো, বন্ধুর বাসা থেকে সে বের হয়েছিল। তাও দু’দিন আগের কথা।  ওর খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু, প্রায়ই যায় ওদের বাসায় ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষ করে। সেদিনও গিয়েছিল, কিন্তু ঐ বাসা থেকে বের হবার পর আর কোনো খবর কেউ দিতে পারছে না। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে জলজ্যান্ত মেয়ে আমার। পুলিশ, গোয়েন্দা, সাংবাদিক এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তুমি যাওনি। তাহলে মেয়ে আমার কোথায়?

আজও প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আমি জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম, রাস্তা অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। রাস্তার পাশের ল্যাম্প পোস্টের লাইটটাও দুদিন ধরে নষ্ট। আজও বোধ করি জ্বলবে না।

নাহ! হঠাতই লাইটটা জ্বলে উঠলো। মনে মনে ভাবলাম, তবে ঠিক হয়েছে। কিন্তু রাস্তা দিয়ে কত মানুষ যায়, আমার মেয়ে তো ফিরে আসে না। দু:শ্চিন্তা করতে করতে যখন আবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল, তখন মনে হলো, চেনা একটা ছায়া খুব দূরে দেখা যাচ্ছে। মনে হলো সে ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে। সত্যি-ই কি ও, নাকি এবারও আমার কল্পনা আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে! না এবার আরেকটু স্পষ্ট হলো , হ্যাঁ দ্রোহী-ই তো! আমি চিৎকার দিলাম তোমার নাম ধরে। তুমি দৌড়ে আসলে। আমি বললাম, দেখো তো। তুমি একবার দেখেই দরজার দিকে ছুটে গেলে। আমিও তোমার পেছনে ছুটলাম।

দরজা খুলে তুমি দাঁড়িয়ে, মেয়ে তোমার সামনে। সারা গায়ে শুকনো কাদা আর রক্ত। আমি ভয় পেলাম। কথা বলার ভাষা হারালাম। দেখলাম তোমাদের মুখেও কোনো কথা নেই। তুমি মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কী বুঝলে জানি না, মেয়েকে হাত ধরে ঘরে ঢুকালে।  বাথরুমে নিয়ে গেলে টেনে, ঝর্ণার নিচে দাঁড় করিয়ে ঝর্ণাটা ছেড়ে দিয়ে, দরজা চাপিয়ে বের হয়ে আসলে। আমাকে বললে, যাও মেয়ের কাপড়, গামছা এসব নিয়ে আসো।

আমি কোনো প্রশ্ন করলাম না , তোমার হিম শীতল কন্ঠস্বর শুনে আমি বুঝলাম, আজ কোনো প্রশ্ন নয়। আমি তোমার কথা মতো কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম বাথ্রুমের দরজার সামনে। শুনতে পেলাম তুমি ফোনে কাউকে বলছো, “দোস্ত আমি খুবই দুঃখিত, হ্যাঁ , ফিরে এসেছে, এক বান্ধবীর সাথে গিয়েছিল, না না ঠিক আছে, তোকে অনেক ধন্যবাদ, বলে কথা শেষ করলে।“

আমি খুব বুঝলাম, কিছু লুকাচ্ছো তুমি। প্রায় এক ঘন্টা আমি দরজার সামনে ঠায় দাঁড়ানো কাপড় হাতে। মেয়ে দরজা খুলে চিৎকার দিয়ে বলে না, “ও মা কই গেলা, আমাকে গামছাটা একটু দাও না”। আমিও দরজায় টোকা দেই না। হঠাৎ খুট করে দরজাটা খুলে মেয়ে বললো, দাও মা। আমি এগিয়ে দিলাম। মেয়ে আবার দরজা লাগিয়ে দিল। তুমি কাছে এসে বললে, “তুমি এখনো দাঁড়িয়ে, যাও। মেয়েকে এক মগ গরম কফি দাও। সাথে নাস্তা।“

আমি গেলাম রান্না ঘরে, চিন্তা করার কোন শক্তি-ই পাচ্ছি না। আমার মনে যে ভয় ঢুকেছে, আমি চাইছি সেটা যেন সত্যি না হয়।

হালকা কিছু নাস্তা আর কফির মগ নিয়ে আমি মেয়ের ঘরে যেয়ে দেখি মেয়ে বসে আছে চুপচাপ, আর তুমি দরজার কাছে দাঁড়ানো।  আমি মেয়ের সামনে কফি এগিয়ে দিলাম। মেয়ে আমার কফির মগটা হাতে নিয়ে আলতো একটা চুমুক দিয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে বললো, বাবা আমি ঠিক করেছি তো? তুমি বললে, হ্যাঁ, একদম ঠিক করেছো। আমার দীর্ঘশ্বাস, বুঝলাম,আমার সারা জীবনের ভয় আজ আর শুধু ভয় নয়, বাস্তবতা।

তুমি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলে, কয়জন ছিল, মেয়ে বললো, ৫ জন। তুমি আবার জিজ্ঞাসা করলে, কোথায়? মেয়ে এবার পুরো ঘটনা গড়গড় করে বলতে লাগলো।

“আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম, মনে হয় রুমালে কিছু ছিল, যেটা দিয়ে ওরা আমার মুখ চেপে ধরেছিল। তখন প্রায় সন্ধ্যা, রাত নামি নামি, আমি ভাবছিলাম মা-কে ফোন দিয়ে বলি যে দেরি হচ্ছে, চিন্তা না করতে’, রিকশা পাচ্ছিলাম না বলে হাঁটতে শুরু করলাম ।

একটা নিরিবিলি গলি, অর্ধেক কনস্ট্রাকশন হওয়া বিল্ডিং। আমি দ্রুতই হাঁটছিলাম, ওরা ঐ বিল্ডিংয়েই ছিল বোধ করি। হয়তো অনেকদিন ধরেই চোখ রাখছিল আমার উপর। যখন জ্ঞান ফিরলো, দেখি আমি এক অন্ধকার ঘরে। কেউ আমার চোখে মুখে পানি দিচ্ছে, আর বলছে  “ধুর শালা! মাগী মইরা গেল নাকি, এমন খাসা মাল… “। বোধ করি আমার জ্ঞান ফেরা আর আশ-পাশ নিরব হবার অপেক্ষায় ছিল ওরা। যে ঘরটায় আমাকে আটকে রেখেছিল, সেটা কোনো পুরাতন গুদাম ঘর মনে হচ্ছিলো, ঘর ভর্তি নানা পরিত্যক্ত জিনিস। জ্ঞান ফিরতেই চোখে পড়লো, এক পাশে মাটি খোড়ার শাবল, কোদাল, এসব পড়ে আছে। আমি এক মিনিটও দেরি করিনি বাবা, প্রথমেই তলপেটে লাথি বসালাম। কোঁৎ করে উঠলো হারামিটা। ব্যস দৌড়ে গেলাম শাবলটা তুলে নিতে। শাবল হাতে পেতেই …… একে একে সব কটাকে… । রক্তে ভেসে গেল ঘর, আমার কাপড়।

আস্তে করে ঘরটা থেকে বের হলাম, বের হয়ে দেখি অনেক রাত, আর আমি আটকা পড়েছি  এক গোরস্থানে। তাই আরও রাত হবার অপেক্ষায় রইলাম, তারপর কোদাল আর শাবল নিয়ে আবার বের হলাম । খুঁজে বের করলাম পাঁচটা নতুন কবর। আকাশে চাঁদ ছিল বলে রক্ষা। সারা রাত লেগে গেল, নতুন করে খুঁড়ে পাঁচটাকে পাঁচ কবরে পুততে। ভোর রাতের দিকে আবার ঐ ঘরে ঢুকে বসলাম, মেঝেতে রক্তের ছড়াছড়ি।

আলো ঘরে ঢুকতেই বুঝতে পারলাম, এটা গোরস্থানের পরিত্যক্ত কোনো ঘর। কিন্তু ততক্ষণে বাইরে লোকজনের গলা শুনতে পেলাম। তাই তখন আর কিছু করা গেল না , সারাদিন চুপ করে ঐ ঘরেই পড়েছিলাম  সন্ধ্যা নামার অপেক্ষায়। আবার রাত নামলো গোরস্থানে। আস্তে করে ঘর থেকে বের হলাম পানির খোঁজে। বুঝলাম গোরস্থানের এদিকটায় লোক সমাগম কম, সিকিউরিটি বলে যারা আছে তারাও খুব একটা আসে না। সুযোগটা কাজে লাগালাম। ধীরে ধীরে যোগাড় করলাম মেঝে পরিষ্কার করার সকল সরঞ্জাম। সারা রাত ধরে পরিষ্কার করলাম পরিত্যক্ত ঘরটা। সকালের আলো ফুটতেই আবার লুকিয়ে পড়লাম সেখানে সন্ধ্যার অপেক্ষায়।

সন্ধ্যা নামতেই বের হয়েছি মা। ফোনটা হারামিগুলা কই ফেলেছে খুঁজে পাইনি। তাই তোমাকে ফোন দিতে পারিনি।“

আমি মেয়ের পাশে বসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলাম। তুমি শুধু বললে, “এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলার প্রয়োজন নাই । বাকিটা আমি দেখছি। রাতের খাবারের ব্যবস্থাও আমি-ই করবো। তোমরা দুজন এ ঘরেই থাকো, ঘুম আসলে ঘুমাও, কারও ফোন ধরার দরকার নাই, দরজা খোলারও দরকার নাই”।

দ্রোহী বিছানায় শুয়ে পড়লো, আমি ওর টেবিলে রাখা সঞ্চিতা হাতে নিয়ে ওর পাশেই শুলাম। নিচু স্বরে বিদ্রোহী কবিতা পড়তে লাগলাম ।

“ ………আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,

মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,

আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর……!”

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.