দখিনা জানালাটি এভাবে বন্ধ করেন না প্লিজ!

নাসরিন শাপলা:

২০০১-২০০২ সালের কথা। আমি তখন আমার প্রথম সন্তান ফারিনকে নিয়ে প্রেগন্যান্ট। শারীরিকভাবে প্রচণ্ড অসুস্থ থাকতাম। প্রেগন্যন্সির কারণে মর্নিং সিকনেসের সিম্পটমগুলো ছিলো প্রকট। আর সাধারণত অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সিম্পটমগুলো প্রথম তিনমাস থাকলেও, সেটা আমার ক্ষেত্রে ছিলো পুরো ন’মাস। তার ওপর মেয়ের বাবাকে তখন তার প্রফেশনের কারণে দেশের বাইরে বাইরে থাকতে হচ্ছে।

মানসিকভাবে আমি তখন যেমন একা, তেমনি দুর্বল। এই সময়টাতে বাসায় একটি দৈনিক পত্রিকা আসতো, খুব সম্ভবত ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’। পত্রিকাটির বিশেষত্ব ছিলো, এর প্রথম পাতা জুড়ে প্রতিদিন থাকতো খুন, জখম, রক্তাক্ত লাশ আর বীভৎস সব ছবি। ছবিগুলো দেখে আমার আরো বেশি অসুস্থ আর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত লাগতো। চোখ বন্ধ করলেই সেই বীভৎস দৃশ্যগুলো আমার সামনে ভেসে উঠতো। অনেক অনুরোধের পরেও আমি বাসায় দৈনিক পত্রিকাটির নিয়মিত আসাটা বন্ধ করাতে পারিনি। শেষে ভয়ে নিজেকেই অধিকাংশ সময় নিজের ঘরে বন্দী করে রাখতাম, পাছে আমাকে সেই বীভৎস দৃশ্যগুলো আবার দেখতে হয়!

আজকাল ফেসবুকে আসলেও আমার ১৭ বছর আগের সেই বিপর্যস্ত অনুভূতিটি হয়। স্ক্রল করতে করতে আঙ্গুল ব্যথা হয়ে যায়, তবুও কাঁটাছেঁড়া রক্তাক্ত দেহ, মৃতদেহ আর ধর্ষকের চেহারা থেকে মুক্তি মেলে না। ফেসবুকে আমরা সবাই অ্যাকটিভিস্ট, ভালোমন্দের বিবেচনাবোধহীন সাংবাদিক, সবাই আমরা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া বিচারক।

তবুও উৎসুক মন আমার। কখনো মনের সব শক্তি এক করে যদি কোনো ছবিতে ক্লিক করে আসল ঘটনা জানার চেষ্টা করি, তবে আসল ঘটনা জানার আগেই কমেন্টের কদর্যতা দেখে আমার গা গুলিয়ে ওঠে। কী অশ্লীল, কী কদর্য, কী নিষ্ঠুর সব মন্তব্য। সেখানে আপাতদৃষ্টে ভদ্র-অভদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত মুখগুলো আলাদা করা দুষ্কর হয়ে যায়। এ কোন অসুস্থ মানসিকতার জাতিতে পরিণত হলাম আমরা?

ফেসবুক একটা সময় আমার কাছে ছিলো একটি দখিনা জানালার মতো। ফেসবুক মানে আমার কাছে ছিলো মানুষের ঝলমলে আনন্দমাখা মুখ, বিদেশে বসে দেশের আত্নীয়-বন্ধুদের মিলন মেলা দেখে আনন্দ আর আফসোসের মিশেল অনুভূতিতে মাখামাখি হওয়া, অনেক সুন্দর সুন্দর মন ভালো করা লেখা পড়া।

আমার কাছে ফেসবুক ছিলো ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া কোনো বন্ধুকে হঠাৎ খুঁজে পাওয়ার আনন্দ, পাশের বাসার ছোট্ট যে ছেলেটিকে একসময় কোলে নিয়ে আদর করতাম, হঠাৎ তাকেই বর সেজে পাশে টুকটুকে সুন্দর বউ নিয়ে লাজুক লাজুক হাসতে দেখা। ফেসবুক মানে আমার কাছে ছিলো স্মৃতির ভাণ্ডার, যে কিনা বেশ দিনক্ষণ দেখে জানিয়ে দেয় গত বছরগুলোতে কী কী করেছিলাম, এই দিনে কোথায় ছিলাম, আমার বাচ্চা দুটো কতো ছোট্ট ছিলো, আর মনে করিয়ে দেয় সময়গুলো কিভাবে দৌড়ে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে হাতের ফাঁক গলে।

শুধু সময় নয়, আজকাল মনে হয় যা কিছু সুন্দর, যা কিছু আশাব্যাঞ্জক তার পুরোটা না হলেও অনেকখানিই,হাতের ফাঁক গলে গলে পড়ে যাচ্ছে। এখন হয়তো চুঁইয়ে পড়ছে বলে আমরা বুঝতে পারছি না। শুধু ভয় হয়, একসময় হয়তো দেখবো নিজের অজান্তেই যা কিছু ভালো তার সবটুকুই চুঁইয়ে পড়তে দিয়ে, শুধু নষ্ট সময়টুকু অঞ্জলীতে ধরে বসে আছি। তখন বোধহয় আমরা কেউই আর নিজের ঘরের দুয়ার বন্ধ করেও এর দায় এড়াতে পারবো না।

তাই অনুরোধ করছি সবাইকে, ফেসবুকে কি পোষ্ট করছি, কি বলছি, কোন রুচিবোধের ছাপ রেখে যাচ্ছি, সেটা একবার না হয় ভেবে দেখি। শুধু একবার। প্লিজ।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.