সায়ন্তনী ত্বিষা:
নানুকে আমি ছোটবেলায় ডাকতাম ‘আসল নানু’। কারণ নানুর অনেকগুলো বোন, যাদের সবাইকেই আমার নানু ডাকতে হয়। তাই নিজের নানুকে আলাদা করে বোঝানোর জন্য ২-৩ বছর বয়সে তাকে ডেকে বসেছিলাম ‘আসল নানু’। এখনও মনে আছে এটা শোনার পর নানুর চেহারাটা কেমন হয়েছিল। গর্বে আর খুশিতে ডগমগ হয়ে গেছিল নানু।
তখন ঠিক বুঝতে পারিনি এতে এতো খুশি হওয়ার কি আছে। কিন্তু আমার ধারণা আমি এখন বুঝি। ক’দিন আগে স্টিভেন স্পিলবার্গের নতুন একটা সিনেমা দেখছিলাম। সেখানে একটা সংলাপ ছিল- ‘Reality is the only thing that is real’ যার অর্থ- ‘বাস্তবতাই একমাত্র বাস্তব বা আসল’। আমি একটু ভিন্ন মত পোষণ করি। কারণ বাস্তবতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে যাবতীয় নকল। নকল মানুষ, নকল সম্পর্ক, নকল অনুভুতি, নকল ব্যবহার। কিন্তু কিভাবে যেন সেই ছোট্টবেলায় ঠিক চিনে নিয়েছিলাম সবচেয়ে আসল মানুষটাকে।
ছোটবেলায় নানুর সাথেই থাকতাম। আর দেখেছি নানুর ঢাকা ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারের বাসায় প্রতিদিন বিকেলে ছায়ানটের এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী এসে রিহার্সেল করত। সারাদিন আমি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন ওরা আসবে, কখন নানু হারমোনিয়াম নিয়ে বসবে আর শুরু হবে গান। নানুকে নিয়ে আমার প্রথম কয়েকটা স্মৃতির মধ্যে এটা একটা।
আরেকটু বড় হয়ে আমি যখন ছায়ানটে নাচ শেখা শুরু করলাম, তখন নাচের ক্লাস শেষ হলেই দৌড়ে চলে যেতাম নানুর গানের ক্লাসে। সবচেয়ে পেছনের বেঞ্চে বসে বসে শিখে ফেলার চেষ্টা করতাম গানগুলো।
নানুর মধ্যে কিন্তু একটা ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পাই’ ধরনের বিষয় আছে। স্পাইদের যেমন দ্বৈত জীবন থাকে, নানুরও তেমন। একদিকে ছায়ানট, আরেকদিকে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন সময় নানু আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে কলাভবনে নানুর ডিপার্টমেন্টে। সেখানেও দেখেছি একঝাঁক ঝলমলে তরুণ-তরুণী নানুকে সবসময় ঘিরে রেখেছে। কলাভবনের নাম কেন কলাভবন তা নিয়ে প্রবল কৌতুহল ছিল আমার। সেই কলা যে আসলে ‘banana’ না, সেটাও নানুর কাছ থেকেই জেনেছি ছোটবেলায়।
প্রথমদিককার আরেকটা স্মৃতি হলো- বারান্দায় পাখি, গাছ, লতা-পাতা দেখিয়ে দেখিয়ে আমাকে খাইয়ে দেয়া। মা-বাবা ঠিক জানতো না কিভাবে একটা বাচ্চাকে খাওয়াতে হয়। তাই ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যেতো আমাকে একটা রুটি খাওয়াতে। কিন্তু নানু জানতো ঠিক কী বললে, কী করলে আমি মুখ হাঁ করবো, আর টপ করে আমার মুখে খাবার পুরে দিতে পারবে নানু। নানুর কোল থেকেই আমি চিনেছি টিয়া পাখি, চড়ুই পাখি, টুনটুনি, মৌমাছি, মৌচাক, দোলনচাঁপা, কুড়চি, বেলি আর আরও কতো কিছু।
একবার বাবা আমাকে খাওয়াতে না পেরে বিরক্ত হয়ে এতো জোরে চড় মেরেছিল যে গাল কেটে রক্ত বের হয়ে গিয়েছিল। রক্ত দেখে ভয় পেয়ে প্রথম যেই কথাটা বলেছিল বাবা সেটা হলো- ‘তোর নানুকে বলিস না’। আমি তক্ষুণি দৌড়ে গিয়ে নানুর কোলে উঠে নালিশ করে দিয়েছিলাম বাবার নামে। পৃথিবীর সবকিছু থেকে লুকিয়ে যাওয়ার পরম আরামের জায়গা ছিল আমার নানু। এখনও আছে। যখনই জীবনটা একটু বে-আরামের হয়ে যায়, তখনই দৌড়ে যাই নানুর কাছে, আর লুকিয়ে পড়ি পুরো পৃথিবী থেকে।
ছোটবেলা থেকেই আমি যখনই কোনো বই পড়তাম, সেই বইয়ের রাজকন্যার চেহারাটা আমার কল্পনায় সবসময় একই রকম হতো। রূপালী চুলের গোল মুখের মায়াবী চোখের সাদা জামা পরা রাজকন্যা, যার আবার কপালে একটা টুকটুকে লাল টিপ। আমার কাছে বিষয়টা কখনও অস্বাভাবিক লাগেনি। কখনও ঠিক চিন্তাও করিনি আমার কল্পনার রাজকন্যারা কেন এমন হয় দেখতে! অনেক বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি কেন আমার রাজকন্যাদের রূপালী চুল, পরণে সাদা কাপড়, কপালে লাল টিপ। কারণ, এই চেহারাটা আমার নানুর। তার মুখ থেকেই আমার জীবনের প্রথম গল্প শোনা। তার মুখের দিকেই হা করে তাকিয়ে থেকে শুনেছি পাথরবতী রাজকন্যা, শঙ্খকুমার, ডালিমকুমারদের গল্প। আমার আসল নানু শুধু আমার আসল নানুই না, সে আমার আসল রাজকন্যাও। আর আমার আসল রাজকন্যা গল্পের রাজকন্যাদের চেয়েও দুর্ধর্ষ আর মায়াবী। আমার আসল রাজকন্যা সারা জীবন সাংস্কৃতিক আন্দোলন করে গেছে। যুদ্ধ করে গেছে বাংলাদেশের মানুষকে শাশ্বত বাঙালি করে গড়ে তোলার জন্য। বাধা বিপত্তির মাঝেও যেন আমাদের শেকড়টা শক্ত থাকে, সেটাই চেয়েছে।
ছোটবেলায় দেখা নানুর সাথে এখনকার নানুর পার্থক্য অনেক। নানু এখন ঘনঘন অসুস্থ হয়ে পড়ে, বাইরে যাওয়া একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। এখন আর একদমই রিকশায় উঠতে পারে না। বাইরে বেরুলে একটা লাঠি হাতে নিয়ে বের হয়। কিশমিশ খেতে পারে না। খাওয়ায় অনেক ধরণের বিধি নিষেধ মেনে চলতে হয়। কিন্তু গত প্রায় ৩ দশকে যেই জিনিসটা একেবারেই বদলায়নি সেটা হলো- পড়ার টেবিলে ঘাড় গুঁজে কাগজে কলম ঘষে ঘষে দিন রাত লেখালিখি।
আর কতো লিখবে নানু? চলো আমরা মেক্সিকো বেড়াতে যাই। আজ তোমার পঁচাশি বছর। আর মাত্র ১৫ বছর, তারপর ইংল্যান্ডের রাণী তোমাকে ফোন করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে। আর মাত্র ১৫ বছর পরে আমি বলবো, আমার আসল রাজকন্যার বয়স এখন ১০০।
লেখাটি বিশিষ্ট সংস্কৃতিজন, ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা খাতুনের ৮৫ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লিখেছেন তাঁরই নাতনী সায়ন্তনী ত্বিষা। সনজীদা খাতুনের জন্মদিনে তাঁকে উইমেন চ্যাপ্টারের পক্ষ থেকে অসংখ্য অভিনন্দন। তিনি আরও অনেক অনেক বছর বেঁচে থাকুন আমাদের মাঝে, আমাদের মাথার ওপর বটবৃক্ষ হয়ে, সেই কামনাই করছি”।