একজন রাজীব ইকুয়েলস টু আমরা সবাই

ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল:

সবাই এতোক্ষণে রাজীবের প্রসঙ্গে জেনে গিয়েছেন এবং সমবেদনা জানাচ্ছেন আহা উহু বলে! কিন্তু এর সমাধান কোথায়? একজন রাজীবকে দিয়েই কি অামরা বুঝতে পারছি না যে, আপনি কিংবা আমি, সুস্থভাবে বের হয়ে সুস্থভাবেই যে ফিরে আসতে পারবো, সেই নিশ্চয়তা নেই!

না, এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়। প্রায়ই রাস্তাতে এধরনের অনেক কিছুই ঘটে থাকে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের বেপরোয়া অাচরণের কারণে। বেপরোয়া ঘটনায় মনে পড়লো, বেশ কয়েক বছর আগে, চাকরি জীবনের শুরুর দিকে। বাসে প্রথম অাসনে বসে খুব ভোরবেলাতে বের হয়েছি অফিসে যাবো বলে। হঠাৎ দুটি বাসের মধ্যে রেস শুরু হয়ে গেল, প্রচণ্ড গতি দুটি বাসেরই। এক পর্যায়ে আমাদের বাসের কন্ডাক্টর অন্য বাস লক্ষ্য করে গালি দিল! আর কই যায়, রেস যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল! এক পর্যায়ে অন্য বাসটি আমাদের বাসের সামনে গতিরোধ করে দাঁড় করিয়ে হাতে মোটা মোটা লাঠি নিয়ে বাসে উঠে কন্ডাক্টরকে প্রথম আসনে আমার ওপর ফেলে বেদম মার!

আমি সত্যিই শিউরে উঠি সেদিনের ঘটনার কথা মনে হলে! আশেপাশে সব মানুষ জমে গিয়ে মজা দেখছে, কেউ এগিয়ে আসছে না। দমাদম লাঠির বাড়ি পড়ছে আমার হাতে, পায়ে! পুরোপুরি বেকায়দা অবস্থায় আমি। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছিলাম সেদিন…

আমি তখন চাকরি করতাম বিখ্যাত এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন নিয়ে কাজ করছি, আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন জেন্ডার স্পেশালিস্ট আমার বস; অফিসে পৌঁছানোর পর আমার ফোলা হাত-পা দেখে এবং বিস্তারিত শুনে উনি সবার সামনে হাস্যরস করলেন বিষয়টি নিয়ে যে, সহিংসতা প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিজেই সহিংসতার শিকার!

রাজীবের ঘটনার সাথে আজকের বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা এইখানে যে, সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বোধকরি এমনই হয়ে থাকেন! কেউ হাস্যরস খুঁজবেন, কেউ বা আফসোস করবেন, কেউ বা ক্ষতিপূরণ দেবার ব্যবস্থা করতে বলবেন, কিংবা আরও কত কিছু! কিন্তু যে ক্ষতি একজন মানুষের সারাটা জীবনকে অসহায়ত্বের মাঝে বন্দি করে ফেলে, টাকায় তার মূল্য আপনি কীভাবে কীসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করবেন? এখানে রাজীব পুরুষ না হয়ে মেয়ে হলে দেখতেন, অারও কত ডাইমেনশন বের হতো আলোচনা-সমালোচনার! কেন মেয়ে হয়ে দরজায় দাঁড়াতে হবে বা কী দরকার ঐ সময়ে বাসে ওঠার বা এরকম আরও হাজারটা তীর ছোঁড়া হতো।

পরিবহন সন্ত্রাস কিন্তু কমছে না, বরং বেড়েই চলেছে। গণপরিবহনে চলছে ভয়াবহ নৈরাজ্য। যাত্রীদের দুর্ভোগ-ভোগান্তির শেষ নেই। বিভিন্ন রুটে যানবাহন সংকট, সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি আদায় এবং পরিবহন কর্মীদের স্বেচ্ছাচারিতায় যাত্রী ভোগান্তি চরমে উঠেছে। কোনো কোনো রুটে দীর্ঘ অপেক্ষার পরও কাংক্ষিত বাসে ওঠা যায় না। বিশেষ করে সকালে অফিস শুরুর আগে এবং বিকালে অফিস ছুটি শেষে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। অসুস্থ, বয়স্ক, নারী ও শিশু যাত্রীদের গন্তব্যে যেতে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়। রাজীবের ক্ষেত্রে কী হয়েছিল বলুন, বাসে জায়গা না পেয়ে তাকে দরজায় দাঁড়াতে হয়েছিল, আর তার চরম মূল্য গুনছে এখন তিনি আর তার পরিবার! পরিবহন সন্ত্রাসের বলি হয়েছে একটি হাত, ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে শরীর থেকে। যাত্রীদের জিম্মি করে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে পরিবহন কোম্পানিগুলো, অথচ যাত্রীদের বসার জায়গা পর্যন্ত দিতে তারা অপারগ!

আমি ভোরবেলা যখন অফিস থেকে বের হতাম আমার মা খুব ভয়ে থাকতেন! এরকম সবাই আসলে ভয়েই থাকেন, কারণ জীবনের নিরাপত্তা আজ কোথায় এসে নেমেছে কেউ তার মাপতেও পারবে না। ঢাকার রাস্তায় বেপরোয়া বাস চলাচল নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়ার যেন কেউ নেই। ট্রাফিক পুলিশের সামনেই দুই বাসের মরণ রেস, ধাক্কাধাক্কি করে রাস্তার মাঝখানে যাত্রী ওঠা-নামা করা, চলন্ত বাসে চালকের মুঠোফোনে কথা বলার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটলেও পুলিশ নির্বিকার।বাসচালকের বেপেরোয়া আচরণে কত মানুষ মারা যাচ্ছেন কিংবা অাহত হচ্ছেন, সেটি কেবল সংখ্যা হয়েই আছে, নেই কোনো ব্যবস্থা, সমাধান! কোনো ধরনের দুর্ঘটনা নিয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা হলে, সরকারের তরফ থেকে অর্থ সাহায্য দিয়ে বিষয়টি একভাবে নিষ্পত্তি করার ভাব ধরা হয়। কিন্তু যার যায়, শুধু সেই বোঝে তার কী গেল, কতটুকু হারালো সে!

কিন্তু আমাদের নেই কোনো ব্যবস্থা নেয়ার আগ্রহ। অামরা যাকে তাকে গাড়ির লাইসেন্স দিয়ে দেই তেমন কোনো পরীক্ষা ছাড়াই! জার্মানিতে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পেতে কঠিন এক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়৷ পাশাপাশি, জার্মানির রাস্তাঘাটে রয়েছে অসংখ্য স্পিড ক্যামেরা৷ কিছু ক্যামেরা আবার মোবাইল, অর্থাৎ হঠাৎ করে কোনো এক রাস্তায় বসিয়ে দেয়া হয়৷ এ সব ক্যামেরার কাজ হচ্ছে আপনি সেই রাস্তায় নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশি গতিতে গাড়ি চালালে আপনার চেহারা এবং গাড়ির নম্বর প্লেটের ছবি তুলে ফেলা৷ এরপর আপনার ঠিকানায় চলে যাবে বিল৷ গাড়ির গতি নির্ধারিত গতির যত বেশি হবে জরিমানার হার ততই বেশি৷ নির্ধারিত সীমার বেশি হলে অনেক সময় লাইসেন্স নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাতিল, এমনকি চালক মানসিকভাবে সুস্থ কিনা সে পরীক্ষাও করা হতে পারে৷ আর আমার সোনার বাংলায় দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেলে মন্ত্রীরাই সাফাই গেয়ে বহুবার বলেছেন যে, `আল্লাহর মাল আল্লায় নিছে!`

আমাদের দেশ হলো ‘উন্নয়নশীল`দেশ, যেখানে স্কুলে কিনা শিক্ষার্থীদের জন্য এস্কেলেটর বানিয়ে দেবার চিন্তাও করা হয়, অন্যদিকে এই শিক্ষার্থীরাই কলেজে আসার সময়ে পরিবহনের অব্যবস্থাপনার জন্য প্রাণ হারায়, হাত হারায়! এমনকি সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে মামলা হবে ৩০৪(খ) ধারায়। এই ধারায় সর্বোচ্চ সাজা তিন বছরের কারাদণ্ড! জাতিসংঘে বাংলাদেশ অঙ্গীকার করেছিল ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার। কিন্তু সংখ্যাটি কেবল বাড়ছেই।

জানি না আরও কতজন মানুষের জীবনের বিনিময়ে কর্তৃপক্ষ মানুষের জীবনের মূল্য বুঝতে পারবেন। জানি না আরও কত শত বছর এই উন্নয়নশীল দেশের মানুষকে অপেক্ষা করতে হবে বাসে আসনে বসে যাত্রা করার জন্য, জানি না এই উন্নয়নশীল দেশের আরও কত বছর লাগবে এটি ভুলিয়ে দিতে যে এক সময় মানুষকে এভাবেও প্রাণ দিতে একভাবে বাধ্য করা হতো! জানি না আরও কতদিন লাগবে একটি সভ্য দেশ হয়ে উঠতে, যেখানে মানুষের প্রাণের মূল্য কোনদিনও টাকা দিয়ে ওজন করা হবে না!

লেখক:
ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল
নৃবিজ্ঞানী, গবেষক ও অনলাইন লেখক
জার্মানি

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.