এবার তোমরা খুন করো …

তামান্না ইসলাম:

ভেবেছিলাম ধর্ষণ নিয়ে আর লিখবো না। সত্যি কথা বলতে কী ধর্ষণের খবরগুলো পড়তেও খুব খারাপ লাগে, আর লিখতে গেলেও খুব অসহায় লাগে। আজকাল তো ফেসবুক, পত্রিকা খুললেই শুধু ধর্ষণের খবর। মাঝে মাঝে চেষ্টা করি চোখ বুঁজে থাকতে। উট পাখির মতো বালিতে মাথা গুঁজে ভাবতে সব ঠিক আছে, চারিদিকে কোন ঝড় নেই। কিন্তু মানুষ বলেই হয়তো সবসময় মাথা গুঁজে থাকতে পারি না।

গত কয়েক দিন ধরে একটার পর একটা দুঃসংবাদ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অবিচলের ভান করে থাকা আমার মনে এমন অস্থিরতার ঢেউ তুলছে যে সেটা কোনভাবেই ভুলে থাকতে পারছি না। বিউটি মেয়েটার ঠিক কী অপরাধ ছিল? সে মেয়ে, এইতো! সে একজন দরিদ্র দিন মজুরের কিশোরী মেয়ে, শুধু এইটুকুই তো মানুষ হিসাবে তার অপরাধ। তার শরীরে বিধাতা জন্মের সময় একটা যোনি দিয়ে দেওয়ার আগে তাকে তো কেউ জিজ্ঞাসা করেনি। এই মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছে যে ক্ষমতাশালী পুরুষ, সে ধরেই নিয়েছে সমাজ, রাষ্ট্র সবাই তাকে এই অধিকার দিয়েছে।

সে তো পুরুষ, তাই সে মানুষ। আর যোনিধারী প্রাণীটি শুধুই তার ভোগের সামগ্রী। নির্যাতিত মেয়েটি বিচার চেয়েছে, প্রতিবাদ করেছে, সেই অপরাধে তাকে অকালে প্রাণ হারাতে হলো। এই ঘটনাটি সমাজের সকল ক্ষমতাহীন মেয়ে এবং তাদের অসহায় বাবা, মাকে কী মেসেজ দিল? তাদেরকে জানিয়ে দিল, যদি তুমি ধর্ষণের শিকার হও, যদি তোমার মেয়ে, মা, বোন ধর্ষিত হয়, তবে প্রাণের মায়া থাকলে ক্ষমতাশালী পুরুষদের বিরুদ্ধে লড়তে যেও না। টুঁ শব্দটুকুও করো না। জীবনের চেয়ে বড় তো আর কিছু নেই।

এখন যদি সেই ক্ষমতাশালী পুরুষটির কোন বিচারও হয়, বিউটি কী ফিরে আসবে? যে দেশে একটা ছিঁচকে চুরির অপরাধে উত্তেজিত জনতা একটা ছোট্ট কিশোরকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দেয়, সেই জনতার সমস্ত উত্তেজনা কেন জেগে উঠে না একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে? নাকি অসহায়ের উপরে হাতের সুখ মেটানোর মধ্যেই আমাদের সব উত্তেজনা সীমিত?

বিউটির মৃত্যুর ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই চোখে পড়লো আরেকটি খবর। ত্রিশ বছরের মায়ের ঊনত্রিশ বছরের পরকীয়া প্রেমিক সাত বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। একবার, দুবার নয়, টানা তিন বছর। প্রতিদিন। মেয়েটির বয়স দশ। বাবা দেশে থাকে না, বাবা-মায়ের সম্পর্ক ভালো না। এই শিশুটির কাছে এই আঙ্কেল একজন পিতৃস্থানীয় চরিত্র। আঙ্কেল তাকে অনেক আদর করে, অনেক ভালোবাসে। তাই এই নতুন আদর আদর খেলা যখন শুরু হয়, ব্যথা পেলেও সে চুপ করে ছিল, তাকে তো আঙ্কেল নিষেধ করেছে কাউকে বলতে। মায়ের প্রেমিক, মায়ের সাথেও কিন্তু আছে তার শারীরিক সম্পর্ক। কিন্তু এই অমানুষের তাতে মন ভরেনি। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, মেয়েটি ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার আগেই প্রথম অভুলাইজেশনে প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। যেহেতু ঋতুস্রাব হয়নি, কেউ কিছু বুঝতেও পারেনি। দশ বছর বয়সে প্রি-ম্যাচিউর একটা সন্তানের মা হয়ে যায় সে।

এই মেয়েটির সম্পর্কে জানতে পেরে ভয়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল। কোথায় যাবে আমাদের শিশুরা? কাকে বিশ্বাস করবে বাবা, মায়েরা? ঘটনাচক্রে এখানে মেয়েটির মাও দোষী, কিন্তু সেটা ভিন্ন ধরনের দোষ। এমনও হতে পারতো যে ওই লোকের সাথে তার কোনো অবৈধ সম্পর্ক নেই, লোকটি শুধুই তাদের উপকারী প্রতিবেশী। নিজের সাথে শারীরিক সম্পর্ক থাকার কারণেই হয়তো মেয়েকে নিয়ে কোনো সন্দেহ আরও তার মাথায় আসেনি। এই সব ঘটনার পর মা, বাবারা কীভাবে রাতে শান্তিতে ঘুমাবে?

অসম্ভব ভারি মনটা নিয়ে সারাদিন ভাবছি ‘আহারে মেয়েটি, নিজেই এখনো শিশু। পুতুল খেলার বয়স।’ এর মধ্যেই জানতে পারলাম ২২ মাস বয়সী শিশু ধর্ষণের খবর। আমার চোখে খালি কতগুলো পশু ভাসে। তারপরেও আমি দৃশ্যটা কল্পনা করতে পারি না। গা গুলিয়ে ওঠে। নিজে মেয়ে বলেই হয়তো ঘটনাটা ভাবতে গেলেই তীব্র ব্যথায় আমার মনের সাথে শরীর ও মুচড়ে ওঠে। আহারে সেই ছোট্ট যোনি, যার অস্তিত্ব সেই শিশুটির নিজের কাছেও জানা নেই। না জানি কী পাশবিক যন্ত্রণা তাকে সহ্য করতে হয়েছে!

কীভাবে ঠেকাবো আমরা এগুলো? ক্ষমতার লম্বা হাতকে সরিয়ে আইনের আশ্রয়ে কিছু কি আদৌ হবে? আমরা জানি না। এই ছোট্ট, অবুঝ শিশুগুলোর জন্য অবশ্যই মা, বাবা ছাড়া আর কেউ কোনো কিছু করতে পারবে না। লজ্জা শরম, সংস্কৃতি সব দূরে সরিয়ে রেখে সচেতনতা বাড়াতে হবে, কাউকেই বিশ্বাস করা যাবে না। তবে বিউটিদের মতো মেয়েদের বলছি, দরকার হলে খুন করো, সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আঘাত করো। তোমরা হয়তো জানো না, আইন কিন্তু তোমাদের সেই অধিকার দিয়েছে। আইন অনুযায়ী, “আপনি যদি নারী হোন এবং আপনাকে যদি কেউ ধর্ষণ করতে আসে”, বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১০০ ধারা অনুযায়ী যদি কাউকে খুন করা হয়, তবে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না।

সুতরাং, আর কোনো ভয় নয়। ধর্ষণের জবাব দাও দরকার হলে জীবন নিয়ে। দু’একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন হলে এদের দুঃসাহস কমতে বাধ্য। নিজের নিরাপত্তার ভার নিজের হাতে তুলে নাও।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.