ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:
একটা করে ধর্ষণ,হত্যা – সহিংসতার খবর – একজন করে তনু, রিশা, রূপা, পূজা, খাদিজা, বিউটির শিরোনাম হওয়া। কলমে – কীবোর্ডে ঝড় বয়ে যাওয়া, ব্যানার – ফেস্টুন হাতে রাজপথে প্রতিবাদ সভা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরাধী গ্রেপ্তার, আবার কখনো বা অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে।
তারপর? আবারো নতুন কোনো নাম খবরের শিরোনামে – এ যেন এক বিভীষিকাময় বলয়!
কীভাবে নিস্তার পাবে আড়াই মাসের শিশু থেকে শুরু করে মাতৃসম নারীরা? যতক্ষণ নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলাবে, ধর্মের দোহাই দিয়ে, পারিবারিক সম্মান ক্ষুণ্ণ – অক্ষুণ্ণ হবার দায়ভার মেয়েদের ঘাড়ে চাপিয়ে, ধান-চাল- খুদ ছিটিয়ে এ সমাজব্যবস্থা ধর্ষক পুষবে ততক্ষণ কী করে মিলবে রেহাই?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ যে কোনো খবরের লিংকের নিচে মন্তব্যগুলোতে একটু চোখ বুলালেই বোঝা যায়, আমাদের চারপাশে এখনো কত মানুষ কুশিক্ষা আর বিকৃতির অন্ধকারে নিমজ্জিত। যাদের কীবোর্ডে উঠে আসে জঘন্যতম অশ্লীলতা – তাদের মানসিক বিকৃতি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা ভাবনার বিষয়।
ধর্ষণের কারণ হিসেবে মেয়েদের পোশাক, চলাফেরা, চরিত্র আরো কত কিছুকেই না দায়ী করে আসছে সমাজ! ধর্ম ব্যবসায়ীদের ফতোয়াবাজি তো চলছেই যুগে যুগে।
বহু নারী আছে যারা সংসারে ধর্ষক পিতা-পুত্র- স্বামীর অপরাধ লোকলজ্জার ভয়ে আড়াল করে জীবন পার করে , ভিকটিম ব্লেমিং করে অপরাধ ধামাচাপা দিয়ে থাকে।
একইভাবে দেখছি, মিডিয়াকর্মীরা সংঘবদ্ধ দলের লোকের অপকর্ম ঢাকতে। যে মুহূর্তে দেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, সচেতনতা তৈরিতে মিডিয়ার এগিয়ে আসা জরুরি, ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে টক শোতে বসে ধর্ষণের মতো একটি বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করা চলচ্চিত্রের প্রতিষ্ঠিত দুই অভিনেতার (যাদের মধ্যে একজন আবার নারী!) কতোটা দায়িত্বহীন, স্থূল এবং অমানবিক ভাবা যায়!
টেলিভিশন চ্যানেলের মতো গণমাধ্যমে অনুষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত কারো মনেই “সিনেমায় কয়বার ধর্ষণ করেছেন? ” বা “কার সাথে ধর্ষণ দৃশ্য করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন?” – প্রশ্নগুলো এবং এর উত্তরের অসংবেদনশীলতা নিয়ে প্রশ্ন জাগলো না!
অন্যদিকে ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী নয় – এই অতি সাধারণ সত্যটা উচ্চারণ করে আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা পড়লেন রোষানলে! গালিগালাজ আর তোপের মুখে, নিরাপত্তার স্বার্থে ক্ষমা চেয়ে বসলেন তিনি! মুক্তিযুদ্ধ থেকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন – আমাদের সংস্কৃতি কর্মীদের কী দৃপ্ত পদচারণা আমরা দেখেছি। তাঁরাই তো পারেন সবচেয়ে সহজে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছুতে! কী পারতাম আর কী করছি আমরা! সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব তো আছেই উপরন্তু মাছ ঢাকতে সদাসর্বদা শাকের আঁটি নিয়ে প্রস্তুত!
সৎ ও সত্যভাষণে আমাদের সাহসের দীনতা প্রকট হয়ে উঠছে দিন দিন।
অনেকদিন আগে কলকাতার একটি বাংলা ছবি দেখেছিলাম – ধর্ষকের সাথে বিয়ে হয় ধর্ষণের শিকার মেয়েটির। ধর্ষক স্বামী মহোদয় কিছুতেই তাকে মেনে নেয় না! আদর্শ (!) ঘরণী হয়ে মেয়েটি শ্বশুরবাড়ির সকলের মন জয় করে এবং সিনেমা জুড়ে অক্লান্ত চেষ্টার পর পরিশেষে অমানুষকে মানুষ (!) বানাতে সক্ষম হয় – তাই সে অপরাজিতা! অর্থাৎ সকল অপকর্মের দায়ভার মেয়েটিকেই নিতে হলো!! ধর্ষকের সাথে বিয়ে, ঘর করা আবার তার হৃদয় জয় করার কাহিনী!
আমাদের এখানেও ভুরিভুরি উদাহরণ আছে। নায়িকার সামনে নায়ক গরুর দুধ দোয়াচ্ছে – অশ্লীল এবং আপত্তিকর সব সংলাপ – এগুলো আমদের দেশের চলচ্চিত্রেরই দৃশ্য!
অথচ জনসচেতনতা সৃষ্টিতে চলচ্চিত্র অন্যতম শক্তিশালী এক মাধ্যম। সম্প্রতি দেখা ” মাটির প্রজার দেশে ” ছবিটি সেকথা মনে করিয়ে দিলো আবারো। সন্তানসমেত যৌনপল্লী থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা একটি মেয়েকে সমাজ কীভাবে পতিতা সাব্যস্ত করে ফতোয়া জারি করে এবং চরম বিপর্যয়ে পাশে এসে যিনি হাতটি ধরেন তিনি একজন মসজিদের ইমাম, মানুষ হিসেবে মানবতাই যার প্রকৃত ধর্ম।
সমাজের সকল শ্রেণিপেশার মানুষেরা যে যার অবস্থান থেকে সংবেদনশীলতার পরিচয় দেবেন, দায়িত্বশীল বার্তা দেবেন – এই তো কাম্য।
ধর্ষক পুরুষই ধর্ষণের শিকার নারীকে পতিতা প্রমাণে সদা তৎপর। তাই তো এদেশে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে মুখ লুকিয়ে, পরিচয় গোপন করে চলতে হয়! শালিশে তার জন্য দোররা মারার ব্যবস্থা নেয়া হয়! একঘরে কিংবা ভিটেছাড়া হতে হয়!
যুগে যুগে ধর্ষকামী পুরুষ কখনো বিকৃত কল্পনায়, কখনো মোক্ষম সুযোগ পেয়ে বাস্তবে- ধর্ষণ করে এসেছে নারীকে শারীরিক – মানসিক এমনকি সামাজিকভাবে। ওদের পৈশাচিকতার কাছে নিরাপদ নয় আমাদের নবজাতক কন্যাশিশুটি পর্যন্ত। কন্যাশিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাবা – মা – পরিবারের সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
প্রতিটি ধর্ষকের বিচার হোক দ্রুত বিচার আইনে, জিরো টলারেন্সে। শাস্তি হোক দৃষ্টান্তমূলক।
আর পথেঘাটে ওড়না সামলে চলার চাইতে বরং আত্মরক্ষার কৌশলে প্রশিক্ষিত হোক মেয়েগুলো।