যে নক্ষত্র নিভে গিয়েও আলো ছড়ায়

মলি জেনান:

“নারী যখন ফিকশন লেখে তখন তার একটি কক্ষ আর কিছু অর্থ খুব প্রয়োজন।”
এই বিখ্যাত উক্তিটি যাঁর, তিনি ভার্জিনিয়া উলফ, ঊনিশ শতকের অন্যতম ব্রিটিশ আধুনিকতাবাদী ও নারীবাদী লেখক।

“নারীরা শেকসপীয়র লিখতে পারে না” এই বক্তব্যের তাৎপর্য খুঁজতে গিয়ে সেই সময় লেখিকা একটি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছিলেন- শিল্প, সাহিত্যে, উপন্যাসে কেন নরীরা পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে? এই প্রশ্নের উত্তর ও তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে ছিলেন। নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই, সামাজিক বিধি-নিষেধের বেড়া ডিঙ্গিয়ে টিকে থাকবার মত পরিবেশ নেই। এমনকি তার নিজের একটি কামরাও নেই যেখানে সে নিজের মত করে সাহিত্য চর্চা করবে। তার তৎকালীন সমাজ বিশ্লেষণধর্মী বই ‘নিজের একটি কামরা(A Room of One’s Own)’ নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মনুষদের অবশ্য পাঠ্য।

১৮৮২ সালের ১৫ জানুয়ারি ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন এই ক্ষণজন্মা লেখক। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালে লন্ডন লিটারেসি সোসাইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখক এবং তৎকালীন ব্লুমস্বারি গোষ্ঠির সম্মানিত সদস্য ছিলেন ভার্জিনিয়া। লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা। মিসেস ডলওয়ে, টু দ্য লাইটহাউস, জেকবস্ রুম, ওরলানডো, দ্য ওয়েভস্ তার প্রখ্যাত উপন্যাস।

৫৯ বছরের জীবনে উলফ বেশ কয়েকবার ডিপোলার ডিজঅর্ডারে ভুগেন। দীর্ঘ দিন বিষন্নতায় ভুগার ফলে তার বেঁচে থাকবার তিব্রতা কমে যায়, তিনি নিজের হাতেই তুলেনেন নিজেকে ধংশের দায়িত্ব। ২৮ মার্চ ১৯৪১ সালে উলফ তার নিজের ওভারকোটের পকেটে নুড়ি পাথর বোঝাই করে হেঁটে নেমে গিয়েছিলেন খরস্রোতা পাথুরে ওউজ নদীতে। আর কখনো ফিরে আসেননি, টুপ করে ডুবে গিয়েছিলেন পাথরের টুকরোর মতন। ১৮ই এপ্রিল নদীতে তার দেহাংশ পাওয়া যায়।

শেষবার নিজের ঘর ছেড়ে যাবার অাগে প্রিয়তম স্বামীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে যান ভার্জিনিয়া। এই শেষ চিঠিটিই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পড়া সুইসাইড নোটগুলোর একটি। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী এই সুইসাইডাল নোটটিও সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে এক অমর সাহিত্য।

পাঠকদের জন্য সেই বিখ্যাত সুইসাইডাল নোটটি-

“প্রিয়তম,
আমি বুঝতে পারছি, আমি আবারও পাগল হয়ে যাচ্ছি। বুঝতে পারছি এবার হয়তো আমাদের এই কঠিন সময় অতিক্রান্ত হবে না। আমি নানা রকম স্বর শুনতে পাচ্ছি, কিছুতেই মনঃসংযোগ করতে পারছি না। তাই যা সবচেয়ে ভালো মনে হচ্ছে, তাই করতে যাচ্ছি আমি।

তুমি আমাকে যতটুকু সম্ভব সুখি করেছো। তুমি সে সবই করেছো, যা যা একটি মানুষের পক্ষে করা সম্ভব। আমার মনে হয় না দুজন মানুষ মিলে আমাদের চেয়ে বেশি সুখি হতে পারতো, যতদিন না এই ভয়ঙ্কর রোগটা দেখা দেয়। আমি আর এর সাথে যুদ্ধ করতে পারছি না। আমি জানি আমি তোমার জীবনটা নষ্ট করে ফেলছি, আমি না থাকলেই তুমি তোমার কাজে মনোযোগী হতে পারবে এবং তুমি সফল হবে, আমি জানি তা।

দেখ এই চিঠিটাও আমি ঠিকভাবে লিখতে পারছি না, আমি পড়তে পারি না। আমি সর্বার্থে বলতে চাই, আমার জীবনের সকল সুখের জন্য আমি তোমার কাছে ঋণি। তুমি আমার সঙ্গে চরম সহিষ্ণু থেকেছো, অসাধারণ সহৃদয় আচরণ করেছো- এ সত্য সকলেই জানে। কেউ যদি আমাকে বাঁচাতে পারতো সে হতে তুমিই। তুমি এতো ভালো আমি তোমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করতে পারি না।

আমার মনে হয় না আমাদের দুজনের চেয়ে বেশি সুখি আর কেউ হতে পারবে।”

আজ ২৮ মার্চ এই বিখ্যাত লেখকের মৃত্যুদিনে তাঁর জন্য গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.