‘বিয়েটা সেমিস্টার সিস্টেমে চলে না’

সুদীপ্তা ভট্টাচার্য্য রুমকি:

মানুষ একা বাস করতে পারে না,তাই সে সঙ্গ চায়। কিন্তু এখন দেখি কিছু বিবাহিত পুরুষ জনম একা এবং এই জীবনে একাকিত্ব ঘোচার কোনো সম্ভাবনাও বোধ হয় নেই। উনাদের বাবা, মা, আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী, সন্তান, পরিচিত গণ্ডি সব থাকার পরেও উনারা একা।

কৈশোরে একা তাই প্রেম, যৌবনে একা তাই বিয়ে, তাতেও ঘুচে না একাকিত্ব, এরপরে আসে সন্তান। কিন্তু বিধি বাম, একাকিত্ব আর ঘুচলো কই? তখনই প্রয়োজন অনুভব করেন তিনি পরকীয়ার। নিঃসঙ্গতা কাটাতে স্বাগত জানান আরেকজনকে। কারণ তিনি সুখী নন। আর এই নিঃসঙ্গ পুরুষের নিঃসঙ্গতা মোচনের গুরু দায়িত্বে নিয়োজিত আপনাকেই বলছি, আপনিও এক পায়ে খাড়া আসার জন্য!

এরপর আজম খানের “চুপ চুপ চুপ অনামিকা চুপ কথা বলো না, তুমি আমি এখানে কেউ জানে না” এই গানকে জীবনে আদর্শ বানিয়ে আপনাদের এই অনৈতিকতাটা চলে। কিন্তু এই যে উনাকে নিঃসঙ্গতা জন্ম থেকে জেঁকে ধরেছে, তাই তিনি আপনার উপস্থিতিতেও কিছুদিন পর আবারও নিঃসঙ্গতা অনুভব করতে পারেন। তখন যদি তিনি আর ইচ্ছুক
না থাকেন আপনার সাথে সম্পর্ক টানতে বা তা জনসম্মুখে আনতে, তখনই আপনি বোঝেন আপনি ভিকটিম, আপনার সাথে প্রতারণা হয়েছে। কিন্তু আপনি কীভাবে ভিকটিম হোন? আপনি নিজেও তো সঙ্গ দিয়েছেন এই অনৈতিক কাজে। So you are not a victim. You are the partner of this crime.

কোনো মানুষ যখন নিজের স্ত্রীর ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে আপনার সাথে আলোচনায় আসে, বা আপনার তার স্ত্রীর প্রতি করা নেতিবাচক, বিদ্রুপাত্মক মন্ত্যবে নিজে অসম্মানিত বোধ না করে বরং পুলক অনুভব করে আপনার অনধিকার চর্চার বাহার দেখে, তাকে উৎকৃষ্ট ভাবার মতো প্রকৃষ্ট নিকৃষ্ট উদাহরণ আর হয় না বোধ করি! যে মানুষ সততার মুখে লাথি মেরে, ন্যায়পরায়ণতাকে পায়ে পিষে, বিশ্বাসের গলা টিপে হত্যার মাধ্যমে আপনার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, তখন আপনার চোখে পড়েনি তার কার্যক্রম? সেইসব পুরুষের ন্যায়পরায়ণতা, বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কীভাবে?

বিধাতাকে সাক্ষী রেখে কবুলই বলুক আর সাতপাঁকেই ঘুরুক, সেই প্রতিশ্রুতি ভাঙ্গতে যার সময় লাগেনি, সেই ব্যক্তি আপনাকে যদি কোনভাবে কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়েও থাকে, তা ভাঙ্গতে তার সময় লাগবে কেন মনে হলো? আপনার সাথে সম্পর্ক রাখলে মহাপুরুষ, না রাখলে কাপুরুষ! প্রকৃত অর্থে ব্যক্তিটি আসলে অধম পুরুষ, আর অপ্রিয় হলেও সত্য আপনি নিজেও খুব একটা কম নন তার থেকে।

একজন বিবাহিত মানুষের নিঃসঙ্গতা কাটানোর দায়ভার আপনাকে কে দিল? আর দিলেই বা আপনি নেবেন কেন? যতক্ষণ পর্যন্ত তার ডিভোর্স হয়নি ততক্ষণ পর্যন্ত সম্পর্কের ভিত্তিটাই তো অবৈধ, অসামাজিক। এখন অসামাজিক কার্যকলাপের সামাজিক সমাধান চাওয়াটা আদৌ কতোটা সমীচীন?
একে আবার ভালবাসা বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত? ভালবাসা কি এতোই হীন, এতোই নীচ? এটাকে না হয় ভদ্র ভাষায় সময় কাটানোই বলি!
সময় কাটাতে কাটাতে ঐ পুরুষ যদি একঘেঁয়ে বোধ করে আবার নতুন ফাঁদ পাতার চেষ্টা করেন অথবা আপনার সাথে কোন পরিণতিতে যেতে না চান, তখন আপনার মাথায় আসে সেই লোকের স্ত্রীর কথা। এতো ঘটনা যখন ঘটালেন তখন ঐ লোকের বউটির কথা মনে না থাকলেও বিচার নিয়ে ঠিকই বউ এর কাছেই যান। আগে জানতাম কেউ কিছু করলে বিচার নিয়ে মানুষ তার মা-বাবার কাছে যায়, কিন্তু এইধরনের বিশেষ ক্ষেত্রে উনাদের বাপ-মা ইহজগতে বিরাজমান থাকলেও তা জেনে যেহেতু উনারা খুব একটা বিব্রত হবেন না তা বুঝেই যাওয়া হয় তার স্ত্রীর কাছে। ফেইসবুকে বউটিকে নক করা হয়। স্ক্রিনশট পাঠানো হয়। আরেকদিকে সম্পর্কও টেনে নেয়ার চেষ্টা চালানো হয়।

আসলে প্রতারণারই স্ক্রিনশট হয়, বিশ্বাসের নয়। শুধুমাত্র সেই স্ত্রীটিকে মানসিকভাবে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে সেই জিনিসগুলো তাকে দেখানো হয়, অথচ সেই মানুষটি আপনাদের সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। সে আপনাদের দুজনের বিকৃত আচরণের শিকার মাত্র। আসল কথা এধরনের ধোয়া তুলসী পাতার মতো পুরুষের কলিজার জোর নির্ভর করে আপনাদের মতো তাদের প্রতি স্বেচ্ছায় পোষ মানা কেউ মানুক আর না মানুক সরলতার প্রতিমাদের উপর। কারণ ঐসব পুরুষের ধারণা নিজের মান যাওয়ার ভয়ে হলেও আপনারা ব্রডকাস্ট করবেন না কোন কিছুই।
কিন্তু সরল তো আর চিরকাল সরল না থেকে একটু গরলতার আশ্রয় নিতেই পারে। কারণ আপনার তো আর দায়বদ্ধতা নেই ঐ পুরুষের ফেইক আইডি বজায় রাখতে সহায়তা করার। কিন্তু দু:শ্চরিত্র হাজব্যান্ড যার আছে তাকে আপনি নক করে কী আর নতুন তথ্য দিবেন বলুন? এমন অভিজ্ঞতা তার থাকবে ভালভাবেই। আর স্ত্রী এসব দেখেও চুপ করে থাকলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ এধরনের মানসিকতার পুরুষদের স্ত্রীরা মেরুদণ্ডে চেতনানাশক ইনজেকশন লাগিয়ে অচেতন হয়েই বাঁচার চেষ্টা চালান। এক্ষেত্রে চেতনা রাখতে গেলে মানসিকভাবে কোনভাবেই সুস্থ থাকা সম্ভব নয়।

আর এইসব পুরুষের একটা বিষয় খুব চোখে পড়ে, তারা যাকে বিয়ে করে সেই মেয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষিত, সভ্য, ভদ্র স্বভাবের হয়। এই ধরনের মেয়ের দেখা পাওয়ার আগে তারা বিয়ের নাম মুখে আনতে চায় না। যে তার এক ডাকেই সাড়া দেয় তাকে তারা কোনদিনও বিয়ের জন্য উপযুক্ত মনে করে না। কারণ যে আজ তার ডাকে সাড়া দিয়েছে কাল অন্যের ডাকেও দিবে। তাকে রেখে বিশ্ব ভ্রমণের জন্য এক পা বাড়ালে সেও অন্যদিকে দুই পা বাড়াবে। তাই উনাদের পছন্দ উনাদের যথেচ্ছ কার্যকলাপে যেন নিজের নিঃসঙ্গতা অনুভূত হওয়ার রুচিবোধ হারিয়ে ফেলে এমন রুচির মেয়ে। নিঃসঙ্গতার কষাঘাতে জর্জরিত হওয়া অঘটনঘটনপটীয়সী পুরুষদের স্ত্রীরা কিন্তু কখনই নিঃসঙ্গতা অনুভব করেন না! কারণ যেকোনো সময় সম্পর্কটা মাঝ গঙ্গায় ডোবালেও সাঁতরে উঠে উনার বাঁধ ভাঙ্গা প্রেমের উপহারস্বরূপ জীবনে আগত এক,দুই,তিন, সন্তানের সংখ্যা যাই হোক তা একাই সামলাতে হয় উনাদের সহায়তা প্রত্যাশা না করে,তখন আসলে নিঃসঙ্গতার বিলাস করার বদলে তাদের সর্বেসর্বা হয়ে উঠতে হয়।

কিন্তু ঐসব পুরুষের জীবনে আসলে প্রেষণা চক্রের ন্যায় আবর্তিত হয় প্রেমের চক্র। একটি প্রেমের পর বিশ্রাম নিয়ে আবার এরা নতুন করে প্রেমের অভাব বোধ করে। যার ফলস্বরূপ কোনো কারণ ছাড়াই একধরনের অস্বস্তিতে ভোগে নতুন প্রেমের জন্য তাড়িত হয় এবং উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এরা বিভিন্ন ধরনের হীন আচরণ করে থাকে। পরিশেষে উদ্দেশ্য সফল হলে বিশ্রাম গ্রহন করে। পরবর্তীতে আবার একই প্রেমের চক্রের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে থাকে। অর্থাৎ যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ এ ভয়াবহ আঁশ।

নিজের এই জঘন্য কাজের জাস্টিফিকেশন দেবার জন্য যে মেয়ের জীবনে স্তুতি করতে করতে হাজব্যান্ড হিসাবে প্রবেশ করেছিল, সেই একই মেয়েকে ধিক্কার দিতে দিতে সম্পর্কটাকে অস্বীকার করতে চায় বা নতুন সম্পর্কে জড়ায়।মেয়েটি বিয়ের আগে যা ছিল, বিয়ের পরেও তাই থাকে, কিন্তু এইসব পুরুষের এই মধ্যবর্তী সময়টাতে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তীত হয়ে যায়।সেই পরিবর্তনের দায়ভারও তারা তাদের স্ত্রীর উপর চাপিয়ে নিজে সাধু সাজতে চায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি ঐসব লোকের স্ত্রীরাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের প্রেমেরই ফসল হয়।যাকে দেখে সে প্রেমের ইতি টানার মনস্থ করে।তার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রেমকেই সে বিয়ের রূপ দেয়।সে হাজারটা প্রতিশ্রুতি দিয়েই সেই বিবাহিত সম্পর্কে যায়। কিন্তু বিয়েটা শুধু প্রেম দিয়েই টেকে না তাতে অনেক দায়িত্ব, কর্তব্য পালন করতে হয়। কিন্তু তা পালনের আগেই তারা হাঁপিয়ে যায়।

স্ত্রীর সামনে নিজের স্বরূপটা যখন উন্মোচিত হয়ে যায়, তখন ফাঁকা বুলিগুলো যে আসলেই কতটা ফাঁকা ছিল প্রেমিক প্রবরের, তা স্ত্রী রূপে এসে প্রেমিকার কাছে ভালভাবেই ধরা পড়ে। তখন স্ত্রীর কাঁধে দায়িত্ব এসে পড়ে পতির পিতা, মাতা, ভগ্নি, ভ্রাতার মনোরঞ্জনের, আর আপনার উপর দায়িত্ব এসে পড়ে উনার মনোরঞ্জনের। Just like “Herem Khana” you know.

আগেকার দিনের জমিদার বাড়িতে যা চলতো আর কী! জমিদারি চলে গেলেও তার এই সকল নিকৃষ্ট ঐতিহ্য ঠিকই রয়ে গেছে। ভালো কিছু ধরে রাখার যোগ্যতা না থাকলেও এই বিকৃত আচরণগুলো একই মানসিকতার কিছু যোগ্য উত্তরসূরিরা এখনো বেশ ভালমতোই ধরে রেখেছে।

যেসকল পুরুষ এই ধরনের মানসিকতা পোষণ করেন আপনাদেরকেই বলছি, আপনারা বিয়ের মতো একটা সম্পর্কে পারতে জড়াবেন না। আপনি যদি অসামাজিক জীবন যাপনে স্বতঃস্ফূর্ত হোন, তবে সামাজিক বিবাহের বাইরে অবস্থান করুন। একটা নিরপেক্ষ মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে যাবেন না। তখন আপনার সাংসারিক পক্ষাঘাতগ্রস্ততার জন্য ইচ্ছাকৃত নিঃসঙ্গতার নাটকের কোনো প্রয়োজন হবে না।

বিয়েটা তো কোনো সেমিস্টার সিস্টেম এ চলে না যে এক সেমিস্টার সংসার করে ভালো লাগছে না, তাই ডিপার্টমেন্ট চেঞ্জ করার মতো বউ চেঞ্জ করবেন। বিবাহিত অবস্থায় কোনো আচরণের পূর্বে অবশ্যই নিজের স্ত্রী, সন্তানের মান -সম্মান নিয়ে চিন্তা করা উচিত। আপনার যথেচ্ছ আচরণে আপনার স্ত্রী শুধু নয়, আপনার সন্তানও চরমভাবে অসম্মানিত হয়। তাদের কপালে কলঙ্কের তিলক দয়া করে একটু কম লাগাবেন।

So be careful…

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.