গোড়ায় গলদ রেখে সমস্যার সমাধান সম্ভব না

জহুরা আকসা:

আচ্ছা ইউরোপ-আমেরিকায় যেসব পুরুষ থাকে… তাদের কি সেক্স নেই? এই যে এখানে মেয়েরা যে এতো খোলামেলা কাপড় পরে, তা দেখে কি কখনো কারোর মনে সুড়সুড়ি জাগে না? তাহলে এইসব দেশে ধর্ষণ এতো কম কেন?

না ভাই, ফ্রি সেক্সের দেশ বলে না। এইসব দেশে আপনি চাইলেই যার তার সাথে শুইতে পারবেন না, অবশ্যই তাকে (নারী/মেয়েকে) রাজি থাকতে হবে। শুধু তাই নয়, এই সব দেশের শিশুদের স্কুল থেকেই সেক্স সম্পর্কিত জ্ঞান দেওয়া হয়। তাই এইসব দেশের জনগণ এখানে সেখানে সেক্স খুঁজে বেড়ায় না। রাস্তাঘাটে পথচারির (নারী/মেয়েদের) শরীরে হাতও মারে না। যদি কেউ এই সাহস করে, তাহলে তারা বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা আছে। রাজনৈতিক, ক্ষমতার কিংবা টাকার জোরে কেউ বাঁচতে পারবে না।

আমাদের মতোন দেশগুলির প্রথম সমস্যা হলো, শ্রেণি বৈষম্যমূলক সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থা। একই সাথে আইনের দুর্বলতা বা অপপ্রয়োগ। আমাদের দেশের শিশুরা ছোট থেকেই বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থায় আলাদা আলাদা মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠে। যেই শিক্ষা ব্যবস্থায় সুস্পষ্টভাবে শিশুরা ছোটবেলা থেকে শ্রেণি বিন্যাস শিখে। যেমন, “তুমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ো, তুমি বড়লোক, স্মার্ট”। “তুমি বাংলা মিডিয়ামে পড়ো, তুমি মধ্যবিত্ত, ক্ষেত”। “তুমি সরকারি স্কুলে পড়ো, তুমি কি ফকির? নিশ্চয় বস্তিতে থাকো”? “তুমি মাদ্রাসায় পড়ো? তাহলে তো কোনো কথাযই নাই, তুমি হইলা ফকিন্নির পুত, আর তো কিছু জানোই না”। এইরুপ আরো অনেক বৈষম্য ও ব্যবধান দেখে ও শিখে তারা। এর ফলে যা হয় আর কী, এক শ্রেণির প্রতি অন্য শ্রেণির তাচ্ছিল্য বা অবজ্ঞা শুরু হয়।

আচ্ছা, বলুন তো, যেই দেশে শিশুরা ছোটো থেকেই এইরকম জ্ঞান পায়, সে কী করে মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান দিবে? তাকে আপনি যতই পড়ান, সে টাকাকড়ি, ক্ষমতা ইত্যাদি দিয়েই মানুষকে মূল্যায়ন করবে। আর এই রুপ মানুষরাই পরে চোর হবে, বাটপাড়ি শিখবে, খুনি হবে, রাস্তায় মেয়েদের শরীরে হাত মারবে, আর অন্ধকারে আক্রমণ করবে, সুযোগে ধর্ষক হবে। কারণ সে মানুষকে মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন করবে না, সে মানুষকে মূল্যায়ন করবে টাকা দিয়ে, টাকাই হবে তার কাছে সব।

ছোটোবেলায় একটা সিনেমা দেখে ছিলাম। ‘আবার তোরা মানুষ হ’। যুদ্ধের পরে একদল মুক্তিযোদ্ধা বিপথে চলে গিয়েছিলো, তাদের কথা গল্প নিয়ে তৈরি হয় সিনেমাটি। এক সংবাদপত্রে দেখলাম, এক লেখক লিখেছেন, “পুরুষ, তুমি মানুষ হও”! গত রাতে আমার স্বামী আমায় বললো, আচ্ছা আমরা পুরুষরা কি এতোই খারাপ?

কেন জানি এই কথাটা শুনে খুব খারাপ লাগলো। শুধু আমি না, অনেক মেয়েই আছে, যারা তার বাবা-ভাই-বন্ধুদের অনেক ভালোবাসে, তাদের বিশ্বাস করে।
আমার দেখা কতো মেয়ে সহপাঠীকে ছেলে সহপাঠীরা বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেয়। মেয়েরাও নিশ্চিন্তে তাদের সাথে যাতায়াত করে। তাহলে কি তারাও সব অমানুষ? অনেক নারী তো রাতে পুরুষ কলিগের সাথে নিশ্চিন্তে কাজ করে। তা সেই সব সহকর্মীরা কী সবাই অমানুষ?

ভালবেসে বা বিশ্বাস নিয়ে বিয়ে করে সারা জীবন পার করেছে নারীরা যেসব পুরুষের সাথে, তারাও কি সবাই অমানুষ? এইসব বাদ দিলাম, আমার মেয়েটির বাবা কী? সে কী লিঙ্গভেদে পুরুষ নয়? আরা আমার এই ছেলেটা? সেও একদিন পুরুষই হবে, নাকি?

আসলে জীবনে চলার পথে আমাদের সাথী হিসাবে আমরা অনেক পুরুষ পেয়েছি এরা সকলেই লিঙ্গভেদে পুরুষ হলেও তারা নিজেদের মানুষ বলেই মনে করেছে। কিন্তু আমাদের সেই অভিজ্ঞতায় এমন অনেক পুরুষও ছিলো, যারা আসলে নিজেদের শুধুমাত্র পুরুষই ভাবছে এবং তারা তাদের পুরুষত্ব নিয়ে গর্ব করেছে। এই দলের পুরুষরা কখনও মানবিক হতে পারেনি, কারণ তারা নিজেদের মানুষ ভাবার আগে পুরুষ ভেবেছে। এদের কাছে নারী মানেই উপভোগ্য বস্তু। যাদের বিয়ে করে দাসী বানানো যায়। যাদের একমাত্র কাজ ঘরে বসে বাচ্চা পয়দা করা। এরা স্বামী ছাড়া ঘরের বাইরে গেলে তো ধর্ষণ হবেই। এইরুপ নোংরা আর অবাস্তব চিন্তা নিয়ে তাদের জীবন যাপন ।

যাই হোক এখন মূল কথায় আসি, আমার ছেলেটি/মেয়েটি যদি কখনো খারাপ হয়, আমি না চাইতেও সে দোষ কিছুটা হলেও আমার। উন্নত বিশ্বে যদি কোনো ছেলেমেয়ে অপরাধ করে, তার জন্য তার স্কুলিং, পরিবেশ ও প্রশাসন ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়, এবং সেই অপরাধ যাতে আবার না ঘটে তার জন্য সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করে।

স্কুল আর শিক্ষা আমাদের চরিত্র গঠনে মূল কেন্দ্র, কিন্তু বাংলাদেশে সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ, শুধু ঐ শিক্ষাটা বাদে। আমাদের দেশে মানুষ শিক্ষিত হয় টাকা উপার্জনের জন্য। আমাদের দেশে কেউ যখন মানবিক বা সমাজ বিজ্ঞানে পড়াশোনা করে, তখন তাকে আমরা হেয় করি বলি, “এই ব্যাটা, তুই তো কোথাও চাকরি পাবিনা”। যখন আমরা শিক্ষাকে নয়, টাকা উপার্জনকে গুরুত্ব দিই, যখন আমরা কী করে রাতারাতি বড়লোক হবো সেই চিন্তায় ব্যস্ত থাকি, যখন আমার নিজের শ্রেণির বাইরে অন্য শ্রেণিকে তাচ্ছিল্য করি, তখন সেই দেশের মানুষ খুন করেও নিজের স্ট্যাটাস ঠিক রাখতে বাধ্য হবে। তার কাছে তার সামাজিক মর্যাদা মানবিক মূল্যবোধের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হবে। কারণ তার শিক্ষা তাকে মানবিক হতে শেখায়নি।

এই সমাজে কী কখনো কাউকে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য পুরস্কৃত হতে দেখেছেন? সমাজে যারা ভালো লোক, তাদেরকে তো আমরা সবসময় বোকাচোদা বলি, কি তাই না? আর যত চোর, বাটপার, লম্পট, তারাই তো আমাদের কাছে বুদ্ধিমান, চালাক, চতুর! কি ঠিক না?

যেই সমাজে অর্থবিত্ত, প্রতিপত্তি আর রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। সেই সমাজে আর যাই হোক কখনও কোনো দিন মানুষ্যত্বের চর্চা হতে পারে না। তাই আলাদাভাবে সব পুরুষকে গালাগালি দিয়ে কী হবে? পুরুষরা কি তাদের এই পাপের জন্য একা দায়ী? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি দায়ী নয়? আমাদের মূল্যবোধ, হীন সমাজ ব্যবস্থা কি দায়ী নয়? আমাদের দুর্বল আইন ও প্রশাসন ব্যবস্থা কি দায়ী নয়? আমাদের ক্ষমতার দাম্ভিকতা কি দায়ী নয়? আমাদের ছোটো থেকে বেড়ে ওঠা কি দায়ী নয়? আমাদের মনের ভেতর গড়ে ওঠা পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা ও সমাজ কাঠামো কি দায়ী নয়? যে সমাজ ব্যবস্থায় একজন নারী ছেলেসন্তান গর্ভে ধারণ করে নিজেকে ধন্য মনে করে, সে কি দায়ী নয়? যে বাবা-মা, সমাজ নারীকে সম্মান দিতে পারে না, তাদের ছেলে তো ধর্ষক হবেই, মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয়েও চুপ থাকা শিখবে, আর এটাই স্বাভাবিক।

তাই আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক বলে, আগে অন্যায়কে ঘৃণা করুন, তবেই অপরাধমুক্ত হবেন। মানুষকে মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন করুন, তবেই মানুষ হতে পারবেন। এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ শিক্ষা ব্যবস্থা। একদম গোড়া থেকেই ধরতে হবে। আগায় ধরে বা আগা কেটে কোনো লাভ হবে না। গোড়াকে করতে হবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও বিষমুক্ত। তবেই হবে বিষমুক্ত, ধর্ষক মুক্ত, শোষক মুক্ত, দুর্নীতি মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা। একই সাথে দেশে প্রয়োজন শক্তিশালী প্রশাসন ও আইন ব্যবস্থা।

শেষে বলতে চাই, মানুষ তো সমাজবদ্ধ জীব আর তাই সে জীবনসঙ্গী খুঁজবে। কিন্তু আমরা যদি এইভাবে সবাই ন্যায়-অন্যায় ভুলে অমানুষ হয়ে যাই, তাহলে আমি কাকে বিয়ে করবো? আর কেইবা আমার সন্তানের পিতা হবে? একজন অমানুষ?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.