অন্ধকারেই আমার জন্ম!

সাবরিনা স. সেঁজুতি:

হঠাৎ খুট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি রাত প্রায় দুটো। পাশেই আমার মেয়ে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত, তার মুখের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হলো, মনে হলো একটা ছোট্ট পরী শুয়ে আছে আমার পাশে। আবার কীসের যেন শব্দ হলো, এবার মনে হলো পাশের ঘর থেকে আসছে শব্দটা। এসব ক্ষেত্রে আমি খুবই ভীতু প্রকৃতির মানুষ, খুব প্রয়োজন না হলে সূর্য ওঠার আগে আমি কখনই বিছানা ছাড়ি না। ঘর থেকে বের হবার তো প্রশ্নই উঠে না।

আমার ঘরের এক পাশে লিভিং স্পেস বা লাউঞ্জ, অন্যদিকে আমার মেয়ের বেডরুম, মেয়ে ছোটো বলে বেডরুমটা মূলত খেলাঘরে পরিণত হয়েছে, রাতে সে আমাদের সাথেই ঘুমায়। এক রাত সে পাশের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছিল, আমি নিজের ঘরে সারারাত কান খাড়া করে জেগে ছিলাম, ভোর রাতের দিকে নিজেকে আর সামলাতে পারিনি, ঘুমের বাচ্চা কোলে করে নিজের ঘরে নিয়ে এসে একসাথে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলাম। শব্দটা মনে হচ্ছে সেই খেলাঘর থেকেই আসছে। রাতে, অন্ধকারের মধ্যে একা আমি ওঘরে কখনই পা রাখি না, কারণ ঐ ঘরের এক পাশে কোনো দেয়াল নাই, পুরোটাই কাঁচের জানালা। সেই জানালা দিয়ে রাতের নির্জন রাস্তা স্পষ্ট দেখা যায়।

আকাশে চাঁদ থাকলে, চাঁদের আলোতে ঘর ভেসে যায়।
অন্য যেকোনো দিন হলে আমি মেয়ের বাবাকে ডেকে তুলতাম, কিংবা দেশে থাকলে অবশ্যই ভাবতাম ঘরে চোর ঢুকেছে, চোর চোর বলে হাউ কাউ শুরু করে দিতাম, কিন্তু আজ সেরকম কিছুই করলাম না। করতে ইচ্ছে হলো না।

কৌতূহল দানা বেঁধেছে মনে, মনে হচ্ছে কেউ যেন পাশের রুমে যেতে বলছে। আবার একটা খুট শব্দ। নাহ! চোখ থেকে ঘুম পুরোপুরি উধাও হয়ে গেল এবার। বিছানা থেকে নামলাম। আমি সাধারণত স্যান্ডেল ছাড়া কাঠের ফ্লোরে হাঁটতে পারি না, মনে হয় পিছলে যাচ্ছি, তাই অন্ধকারে পা দিয়ে স্যান্ডেল খুঁজতে লাগলাম। প্রতিদিনই স্যান্ডেলটা খাটের কাছে রেখে বিছানায় উঠি, কিন্তু কোনদিনই ঘুম ভাঙ্গার পর সহজে তা খুঁজে পাই না। আজ অবশ্য চট করেই স্যান্ডেলটা খুঁজে পেলাম।

আমি ছাড়া বাসার সবার ঘুম সবসময়ই খুব গভীর এবং তারা চট করে ঘুমিয়েও পড়তে পারে, মাঝে মাঝে ভাবি কী সৌভাগ্য এদের, বিছানায় গা এলিয়ে দিলো কি না দিলো, ঘুমিয়ে পড়লো। আর আমি এপাশ-ওপাশ করতে থাকি, গল্পের বই পড়ি, মোবাইল টিপাটিপি করি, তারপর ধীরে ধীরে ঘুম এলেও, যখন তখন খুট খাট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে ঘরের দরজা খুললাম। ঘর থেকে বের হয়ে পাশের ঘর, মানে মেয়ের ঘরের দরজায় কান পেতে একটু বোঝার চেষ্টা করলাম আসলেই কোনো শব্দ হচ্ছে কিনা। এবার একদম পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, মনে হচ্ছে বাবুর খেলনাগুলো নিয়ে কেউ খেলছে।

কী অদ্ভুত! কে খেলবে এতো রাতে এই ঘরে? ঢুকবেই বা কিভাবে? জানালা দিয়ে ঢুকলো নাকি কেউ? এই বিদেশের বাড়িগুলোতে সিকিউরিটি সিস্টেম বলতে নাই, দরজার লক যেমন দুর্বল, তেমনই জানালাগুলো, যে কেউ চাইলেই টুপ করে ঢুকে পড়তে পারে। গাড়ি পর্যন্ত এরা রাস্তায় ফেলে রাখে সারারাত। আমি দরজার নব ঘুরালাম, দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই চোখ পড়লো জানালার দিকে, ওমা কী সুন্দর চাঁদ, পূর্ণিমা নাকি! অপূর্ব দৃশ্য! হঠাৎ মনে হলো গল্পের বইয়ে ঢুকে পড়েছি, পূর্ণিমা রাত, বকুল ফুলের সুবাস! আহা! কিন্তু, এই বিদেশ বিভূঁইয়ে বকুলের ফুল আসবে কোথা থেকে? তখনই ঘরের মধ্যে অন্য কারও উপস্থিতি অনুভব করলাম।

ঘরের একপাশে মেয়ের আলমারি, অন্য পাশে বিছানা। বিছানা ভর্তি মেয়ের যাবতীয় খেলনা, শুধু বিছানা জুড়েই খেলনা নয়, খাটের পাশে কোনার দিকে খেলনার স্তুপ হয়ে থাকে সব সময়, সেদিকে চোখ পড়তেই দেখি, শুভ্র এক জামা গায়ে আমার মেয়ের বয়সি এক মেয়ে মেঝেতে বসে খেলনা দিয়ে রান্নাবাটি খেলছে। আবারও কড়া বকুলের সুবাস নাকে লাগলো, এবার মনে হচ্ছে মেয়েটির গা থেকেই বকুল ফুলের সুবাস আসছে।

আমি মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলাম, মেয়েটা মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো, তাকিয়ে খুবই পরিচিত ভঙ্গীতে বললো, “ও তুমি? জানো এই পাতিলের ঢাকনাটা খুঁজে পাচ্ছি না, কমলা রঙের ঢাকনা, তুমি দেখেছো?” ঠিক যেভাবে আমার মেয়ে আমাকে বলে।

আমি আরো এগিয়ে গেলাম, ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম মেয়েটার মুখ, কিন্তু জোছনায় খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি না তাকে। মেয়েটা আবার জিজ্ঞাসা করলো, “কী হলো, বলো না, তুমি দেখেছো?” আমি খুবই স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেবার চেষ্টা করলাম, “না, দেখিনি তো, তবে এখানেই কোথাও আছে, খুঁজে দেখো”।

আমি মেয়েটার পাশে বিছানায় বসলাম, মনে হলো আমি কোনো ঘোরের মধ্যে আছি। ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছি না মেয়েটাকে, আবার বোকার মতো ঘরের বাতিও দিচ্ছি না। বাতি জ্বালাবার কথা যে মাথায় আসেনি তা না, মনে হচ্ছে বাতিটা দিলেই বাচ্চা মেয়েটা হারিয়ে যাবে।

মেয়েটা আমার পায়ের কাছে বসে বসে তার হাঁড়ির ঢাকনা খুঁজছে। হঠাৎ আমার পায়ে ভেজা ভেজা কী যেন লাগলো, আমি ভাবলাম, পানি ফেলেছে নাকি কেউ এখানে? তবে এই শীতে পানি তো এতো উষ্ণ হবার কথা নয়? আমি হাত দিলাম পায়ের তলায়, হাত ভিজে গেল, ভালো করে দেখার জন্য হাতটা জানালার কাছে এগিয়ে ধরলাম, ওমা এতো দেখি রক্ত! আমার কি পা কাটলো নাকি? কীভাবে? আমি আবার নিচে তাকিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করছি, ইশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে জায়গাটা, মেয়েটার জামার নিচের অংশটা রক্ত দিয়ে মাখামাখি, একদম টকটকে লাল রক্ত! আমি তাড়াতাড়ি বাচ্চাটার জামা তুলে বোঝার চেষ্টা করলাম ওর কোথাও কেটেছে কিনা, জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছে? কোথাও ব্যথা পেয়েছো? কেউ মেরেছে? বুঝতে পারছিলাম না কী করবো!

মেয়েটি শান্ত কন্ঠে বললো, “তুমি ভয় পেও না, এখন আর ব্যথা নাই। তবে সেদিন খুব লেগেছিল”।
ভয় পাবো না মানে, তিন সাড়ে তিন বছরের একটা শিশুর জামা রক্তে মাখামাখি, আর আমি ভয় পাবো না? “কী হয়েছে আমাকে বল তো সোনা”।

মেয়েটা নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে চলল, “সেদিন মা ছিল রান্না ঘরে, আমি একাই বারান্দায় বসে আমার হাঁড়ি-পাতিল দিয়ে খেলছিলাম, বাবাও বাড়িতে নেই। আমার ছোট ভাই বিছানায় ঘুমাচ্ছে। আমার খেলার মাঝেই পাশের বাড়ির চাচ্চু আসলো হঠাৎ, এসে আমাকে বললো, সে নাকি খুব সুন্দর একটা পুতুল এনেছে আমার জন্য, আমি বললাম, কই? সে বললো, চলো, তোমাকে নিয়ে যাই, বলেই আমাকে কোলে তুলে নিলো, কোলে করে নিয়ে গেল এক্কেবারে বকুল তলায়।

আমাদের বাসা বেশ খানিকটা দূরে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, চাচ্চু, পুতুল কোথায়? কিন্তু চাচ্চু আমাকে পুতুল দিলো না, জানো? খুব মারলো, কী হলো জানি না জোর করে আমার গায়ের কাপড় খুলে নিল, আমাকে খুব ব্যথা দিল, বলেই মেয়েটি দুপায়ের মাঝখানে হাত দিয়ে দেখালো, এই যে এখানে। তারপর আমার কিছু মনে নেই।

চোখ মেলে দেখি আমি সুন্দর একটা জামা পরে মা-র পাশে বসে আছি, আর আমার মা ছোট একটা বাচ্চার পাশে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে। ওরা বাচ্চাটাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। অনেক লোক এসেছিল সেদিন সেখানে, সেই বকুল তলায়। পুলিশও এসেছিল। আশে পাশের সব পাড়া থেকে লোক এসে ভিড় জমিয়েছিল। মা-র সাথে সাথে আমার বাবাও খুব কাঁদছিল। পুলিশ মায়ের পাশে শুয়ে থাকা বাচ্চাটিকে দেখে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, “শিশু ধর্ষণ এবং খুনের কেইস মনে হচ্ছে। প্রথমে ধর্ষণ তারপর গলা টিপে শ্বাসরোধ করে মেরেছে, দেখছো না জিভটা একটু বেরিয়ে পড়েছে”।

পাড়াপড়শিরা খুব আহা-উহু করেছিল। আমার মা চিৎকার করে শুধু কাঁদছিল আর কাঁদছিল। মায়ের কান্না দেখে খুব খারাপ লাগছিল আমার, জানো? আমি আর দেখতে পারছিলাম না, তাই ওখান থেকে চলে এসেছি। এখন আমি একেক দিন একেক মায়ের কাছে যাই, অন্ধকারে, নীরবে, আজ যেমন এসেছি তোমার কাছে।“

আমার মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগলো, বাচ্চাটার স্বরের অনুরণন হলো যেন আমার কন্ঠে -’অন্ধকারে!’ বাচ্চা মেয়েটি বললো, “হ্যাঁ অন্ধকারেই। অন্ধকারেই যে আমার জন্ম, এক অন্ধকার সমাজে – যে সমাজের অন্ধকার আমাকে গিলে খেয়েছে। এখন আমি চাইলেও আলোতে বের হতে পারি না।“

এতো ছোট বাচ্চা এতো গুছিয়ে কথা বলছে কীভাবে? আমি টের পেলাম আমার গাল বেয়ে পানি পড়ছে, তারপর আর কিছু মনে নেই। ভোরবেলা দেখি আমি মেয়ের ঘরের বিছানায় শুয়ে আছি, মেয়ের বাবা এসে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কখন এসেছো এই ঘরে? দেখো তো কী আলো ঢুকছে ঘরে, জানালার পর্দা টেনে দেই? আমি ধরফর করে উঠলাম। দেখি খাটের কোনায় এখনো কে যেন বসে খেলছে, আমি এগিয়ে গিয়ে দেখি, আমার মেয়ে। মেয়ে বললো, “মা তুমি আমার কমলা রঙের ঢাকনাটা দেখেছো?”

শেয়ার করুন: