বাহ্যিক রূপ নয়, আত্মবিশ্বাসই সৌন্দর্যের মূল মাপকাঠি

ডা. ফাহমিদা শিরীন নীলা:

আমি কখনোই কারো বিয়ের পাত্রী দেখতে যাই না। কারণটা খুব সহজ, সব মেয়েকেই আমার সুন্দর লাগে। অনেকেই বলে,’জানিস অমুকের মেয়েটা কী সুন্দর রে’! আবার কেউ আফসোস করে, ‘আহারে, বাপ-মা এতো সুন্দর, মেয়েটা তো সুন্দর হলো না’।

আমি কিন্তু পৃথিবীর সব মেয়ের মধ্যেই সৌন্দর্য খুঁজে পাই। আমার বন্ধু-বান্ধবের সবার মেয়েকেই আমার এক একেকটা ডানাকাটা পরী মনে হয়। একবার জোর করে এক জুনিয়র কলিগ মেয়ে দেখাতে নিয়ে গেল, আমি দেখে বললাম, মেয়ে তো পুরাই অপ্সরী।

মেয়েদের সৌন্দর্য নিয়ে আমি মনে মনে অনেক গবেষণা করেছি। সুন্দর বলতে আসলে কী বোঝায়? খুব ছোটবেলায় মনে হতো, ফর্সা মানেই সুন্দর। উপন্যাসে দুধে আলতা গায়ের রঙয়ের বর্ণনা পড়ে মনে মনে ভাবতাম, ইস্! একদিন ভোরে উঠে যদি আয়নায় দেখতাম, আমার গায়ের রঙ দুধে আলতা হয়ে গেছে!
প্রতিদিন ভোরে উঠেই আগে আয়নার সামনে দাঁড়াতাম। আরও একটু বড় হয়ে চেহারা বোঝা শুরু করলাম। আহা, ঐ আপুটার নাক, চোখ, মুখ কী যে সুন্দর, ঠিক যেন প্রতিমা। বয়স আরও পরিণত হলে, চেহারাও গণ্য হয়ে গেল নিজের কাছে। বুঝতে শুরু করলাম, রঙ-চেহারা আসলে কোন ম্যাটার না, সৌন্দর্যের আসল মাপকাঠি স্মার্টনেস। স্মার্ট মেয়েগুলোকে চেয়ে চেয়ে দেখতাম আর ভাবতাম, কেন যে ওদের মতো স্মার্ট হতে পারলাম না!

বয়স ৩৫ পার হল। জীবনের অনেক শিক্ষার মধ্যে একটা নতুন থিওরী আবিষ্কার করলাম। রঙ, চেহারা, স্মার্টনেস কিছুই কোন ফ্যাক্টর না, সৌন্দর্যের মূল মন্ত্রই হল আত্মবিশ্বাস । এই একটা ছোট্ট কথা বুঝতে আমার ৩৫ বছর লেগে গেল। ছোট্টবেলায় নানীর বাড়ী গেলে সবাই ‘কালনী’ ‘কালনী’ বলে ক্ষেপাতো। মৃত্যুর আগে যেবার আমার নানার সাথে শেষ দেখা হলো, সন্ধ্যেবেলা টিমটিমে হারিকেনের আলোয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঊনি বলেছিলেন,’তোকে ছোটবেলায় কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, লোকে কালো বললে খুব মন খারাপ হতো।

মনে মনে ভাবতাম, শালারা তোরা আমার চোখ দিয়ে দেখ, তারপর বল কেমন লাগে।’ সেদিন চোখ ভিজে উঠেছিল, একবারও মনে হয়নি এ ছোট্ট অনুভূতির ভিতরে ভালবাসাটাই মুখ্য ছিল, মানুষের মন্তব্য নয়। উঠতি বয়সে পাড়ার মোড়ে ছেলেরা ‘কালো’ বলে ইভটিজিং করলে আম্মাকে এসে বলতাম। আম্মা আড়ালে গিয়ে চোখের পানি মুছতেন। বোনেরা মন খারাপ করতো।

কেউ কিন্তু বলেনি, তোর কালো রঙ তোর কোন দুর্বলতা নয়, বরং তোর এই মন খারাপ করাটাই তোর দুর্বলতা। কলেজে উঠার পর আশেপাশের মন্তব্য শুনে সুন্দরী কাজিন পরামর্শ দিল, একটা ভাল দামী রঙ ফর্সাকারী ক্রিম মাখো। মধ্যবিত্ত সংসারে বাবা-মায়ের কাছে আর অতিরিক্ত আবদার করা হয়নি, সস্তা ফেয়ার এন্ড লাভলী মেখেছি মাসের পর মাস। কেউ বলেনি, ফেয়ার এন্ড লাভলী তোর নয়, তোর সমাজের বড় বেশি প্রয়োজন।

কোম্পানির তৈরি ড্রামকে ড্রাম ক্রিম এনে এই সমাজের গায়ে ঘষলেও ফেয়ার হতে পারবে না সমাজটা, লাভলী তো অনেক পরের কথা। বেশিদিন আগের কথা নয়, পোষ্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সের সময়ও একদিন আমার কলিগ রাগ করে বললো, ‘আমি তো আপনার মতো কালো আর মোটা নই।’
আজ মনে মনে তার জন্য এক বালতি সমবেদনা, খানিকটা করুণাও বটে, এতো বড় বড় ডিগ্রীও তাকে শিক্ষিত করতে পারেনি দেখে।

জীবনের তিনভাগের দেড় ভাগ অতিক্রান্ত হবার পর জেনেছি, একমাত্র এবং শুধুমাত্র আত্মবিশ্বাসই মানুষকে তার কাঙ্খিত সৌন্দর্য এনে দিতে পারে। অথচ এই কথাটা অনেক আগেই আমার কাকু আমাকে শেখাতে চেয়েছিলেন। উনি বলতেন, ‘তুই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সবচেয়ে সুন্দরী ভাববি, তারপর নিজের পরিবর্তনটা দেখিস’।

সুতরাং মেয়েরা, অযথা ঘন্টার পর ঘন্টা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের রূপ-সৌন্দর্যের গবেষণা না করে, নিজেকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলো। এই যে অন্যকে দেখে মন খারাপ করে বলো, ‘ইস্, আল্লাহ্ যেন ওকে নিজ হাতে তৈরি করেছেন’।

বিশ্বাস করো, আল্লাহ্ যদি তাকে তৈরি করে থাকে, তাহলে তোমাকেও নিজ হাতেই তৈরি করেছেন। শুধু তুমি তোমার আত্মবিশ্বাসটা তৈরি করো, সৌন্দর্যটা কোন দিক দিয়ে ফুটে উঠবে টেরও পাবে না। আমার কথাটা বিশ্বাস করেই দেখো একটিবার, একবার নিজেকে তৈরি করে ফেলতে পারলে আমার মতো খুব সহজেই বলতে পারবে, ‘আই অ্যাম প্রাউড অফ মাই কমপ্লেক্সশন, আই অ্যাম প্রাউড অফ মাই বিউটি’।

লেখক:
এমবিবিএস; এফসিপিএস; ফিগো ফেলো (ইটালী)
গাইনী কনসালট্যান্ট
পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার
বগুড়া

শেয়ার করুন: