পৃথুলারা বেঁচে থাকবে যুগ যুগ ধরে

আনন্দ কুটুম:

নির্জা ভানোটের কথা মনে আছে? ভারতীয় একজন বিমানবালা। পাকিস্তানে যখন তাদের বিমান সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয় তখন, তিনি নিজের জীবন থেকে এয়ার বাসের অন্য যাত্রীদের জীবনকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন। তাঁর বদৌলতে কিছু যাত্রী বেঁচেও গিয়েছিলেন, শুধু সন্ত্রাসীর গুলি কেড়ে নিয়েছিলো, এই ক্ষনজন্মা বিমানবালার প্রাণ।

এভারেস্ট বিজয়ী ওয়াসফিয়া নাজনীন যখন দুঃখ করে বলেন যে, “ঢাকার শহরে একজন মেয়ের একা হাঁটা থেকেও এভারেস্ট জয় করা অনেক সহজ”। আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না তাঁর কথার নেপথ্যে কত বেশি কষ্ট লুকিয়ে আছে।

এ সমাজে যখন প্রতিটি মেয়েকে একটার পর একটা শেকলে বেঁধে রাখার মহা উৎসব চলে, তখন পৃথুলা রাশিদ সকল শেকল ছিঁড়ে ডানা মেলে আকাশে উড়াল দিয়েছিলো। একজন ভাই হিসেবে, একজন সন্তান হিসেবে আমি জানি এটা নিতান্তই সহজ কাজ নয়।
শুনলাম, বিমান যখন দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হলো তখন আমাদের নির্জা ভানোট (পৃথুলা রাশিদ)ও মনে করেছিলেন, নিজে বাঁচা থেকে কিছু মানুষকে বাঁচানো বেশি জরুরি।

পৃথুলা মরে গেছে। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তিনি নেপালি কিছু যাত্রীকে এয়ারক্র্যাফট থেকে বের করার শেষ চেষ্টা করে গিয়েছেন। শুনেছি, তারই প্রচেষ্টায় প্রায় ৭-৮ জন নেপালি যাত্রী বাইরে বের হয়ে আসার সুযোগ পেয়েছেন।

আমি এমন অনেক উদ্ধার কর্মীর গল্প পড়েছি টুইন টাওয়ার আক্রমণের পরে। এমন অনেক মহৎ প্রাণ দেখেছি রানা প্লাজা ধসে পড়ার পরে, যারা আক্রান্ত মানুষকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেদের জীবনই বিলিয়ে দিয়েছেন।

অনেকেই হয়তো জানেন যে, গত ২৫ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ঢাকায় আসার সময় আমাদের বাস এক্সিডেন্ট হয় এবং বাস চালক ঘটনাস্থলেই মারা যান। ঠিক সেদিন আমিও এভাবেই ভেবেছিলাম যে, নিজের বাঁচাটা জরুরি, কিন্তু ঐ গর্ভবতী মা যিনি তাঁর অনাগত সন্তানের মুখ দেখার জন্য অপেক্ষায় আছেন, ঐ যে নাবালক শিশু ছেলেটি, ঐ যে বৃদ্ধ চাচা, যিনি রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছেন, তাদের প্রত্যেকের জীবনই মূল্যবান। এই মানুষগুলোর লাশ মাড়িয়ে আমি বাঁচতে পারি না। বাঁচা উচিৎ নয়।

পৃথিবীতে এমন একই চরিত্রের কিছু মানুষ থাকেন। হয়তো কারো সাথেই কারো কখনো দেখা হয় না। কিন্তু এদের অবদান, জীবন বোধগুলো খুবই কাছাকাছি। অবশ্যই নির্জা ভানোট বা পৃথুলার মতো এতো বড় সেক্রিফাইস আমাকে করতে হয়নি। অবশ্যই আমি তাদের কাতারভুক্ত নই। আমি স্রেফ তাদের মতো হতে চেয়েছি। (অপরাধ মার্জনা হোক)।

পৃথিবীতে একজন ভালো মানুষ বেঁচে থাকা অব্দি পৃথিবী ধ্বংস হবে না। পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে যুগে যুগে এমন কিছু মানুষ আসবেই। কেউ হয়তো জন্মাবে আফ্রিকার ঘন জঙ্গলে, কেউ জন্মাবে ওয়াশিংটন ডিসির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে, আবার কেউ জন্মাবে বাংলাদেশের মতো অখ্যাত কোনো গ্রামের ছনের ঘরে। কিন্তু এরা জন্মাবেই।

পৃথুলারা নিঃশেষ হয়ে যাবে না। তাঁরা বারবার ফিরে আসবেই। তাদের মুছে দেওয়া যাবে না। পৃথুলাকে নিয়ে যারা নোংরামি শুরু করেছে, তাদের জন্য করুণা হয়। তাদের প্রতি ঘৃণা হয়। তারা কখনোই জীবনের সেই সৌন্দর্যের দেখা পাবে না যা পৃথুলারা দেখেছেন। নির্জা ভানোটেরা দেখেছেন।

সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি। পৃথুলাকে অপমান করা মানে আমার আপনার বোনকে অপমান করা। পৃথুলাকে অপমান করা মানে আমার বোনের স্বপ্নকে অপমান করা। সেই সাথে অপমান করা তাঁর অবদানকে। তিনি মানবের তরেই তো জীবন দিয়েছে।

পৃথুলারা বেঁচে রবে আমাদের মনে। পৃথুলারা বেঁচে রবে আমার, আপনার সন্তানের স্বপ্ন হয়ে। পৃথুলারা বেঁচে রবে আমার/ আপনার কন্যার চোখের পাতায়। পৃথুলারা বেঁচে রবে প্রতিটি মেয়ের উজ্জীবিত রক্ত কণিকায়। এদের মুছে দেওয়া যাবে না। যাবে না!!

শেয়ার করুন: