শেখ তাসলিমা মুন:
কথাগুলো বলে যাচ্ছেন চোখ বন্ধ করে। বড় বড় লিডিং সংবাদপত্র শিরোনাম করে যাচ্ছে শব্দগুলো দিয়ে। জানেন কী কী বলছেন এ শব্দগুলো দিয়ে? ‘সম্ভ্রম’ ‘শ্লীলতা’ ‘মর্যাদা”ইজ্জত’ হানি –এই শব্দগুলো দিয়ে দণ্ডনীয় অপরাধের মাত্রাই আপনারা কমিয়ে ফেলছেন। আর সবচাইতে বেশি করে যেটি প্রমাণ করে যাচ্ছেন সেটি হলো, এই অপরাধে নারীর যা হচ্ছে, তাহলো, ‘সম্ভ্রম’ ‘শ্লীলতা’ ‘মর্যাদা’ ‘ইজ্জত’ হানি! অর্থাৎ নারীকে একাধারে সহিংসতার এক চরম টাইপ দ্বারা শারীরিক মানসিক সকলভাবে ‘হত্যা’ করে জানিয়ে দিচ্ছেন এ অপরাধে তার ‘সম্মান’ ‘সম্ভ্রম’ হানি হয়েছে। সেটি অপরাধ নয়। ইমেজ তুলে ধরছেন যে, সেই নারী সম্ভ্রম হারিয়ে অচ্ছুৎ পরিত্যক্ত হয়েছে। তার নারী হিসেবে তার ‘ইজ্জত’ বলে যা কিছু ছিল, সেটি চলে গেছে।
বুঝতে পারছেন আপনারা যে কী বলছেন এসব শব্দ দিয়ে?
‘সম্ভ্রম’ ‘শ্লীলতা’ ‘মর্যাদা’ ‘ইজ্জত’ শব্দগুলো কি দেখা যায়? ধরা যায়? এগুলো থাকে কোথায়? নারীর দেহের কোথায়? সেটা দিয়ে এতোবড় অপরাধকে কেবল ছোটই করা হয় না, নারীর প্রতি সংঘটিত হওয়া অপরাধকে আইন ও বিচারিকভাবে হালকা করে তোলা হয়।
প্রথমত একজন ইন্ডিভিজিউয়ালের ইন্টিগ্রিটি, তার ব্যক্তিসত্তার উপর হামলা কতোটা ভয়ঙ্কর, সেটি নারীই কেবল নয়, একজন পুরুষকেও জিজ্ঞ্যেস করে দেখতে পারেন। একজন পুরুষ যদি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় এবং ছিনতাইকারীদের দ্বারা অতর্কিত হামলার শিকার হয়, অনুভব করে দেখুন, তাকে জিজ্ঞ্যেস করে দেখুন, সেটি কতোটা ড্যামেজেবল একটি ফ্যাক্টর তার সারা জীবনের জন্য। সারা জীবন অনেককে সে আতঙ্ককে বহন করে যেতে হয়। তার সাথে তুলনা করে দেখুন নারীর শরীরের প্রতি যেটি ঘটে, সেটি তার থেকে কয়েক হাজার গুণ গভীরের এবং ভয়াবহতা বহুমুখী স্তরের।
একটি সরল উদাহরণ মনে পড়ছে। সুইডেনে আমার এক কলিগ সিরিয়ান। ইয়াং মেধাবী। এখানে ব্রট আপ। মেয়েটি আমাদের অথরিটির বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিসগুলোতে ট্রাভেল করে এবং প্রশিক্ষণ দেয়। সে সুবাদে তাকে আন্তঃবিমান ভ্রমণ করতে হয় সকাল বিকাল। মেয়েটি মুসলিম এবং হিজাব পরে। হিজাব নিয়ে আমার অবস্থান পরিষ্কার। সে আলোচনা ভিন্ন। কিন্তু এখানে মেয়েটির বর্ণনা মন দিয়ে শুনছিলাম এক ভিন্ন আঙ্গিকে। সিকিউরিটি রিজনে তাকে হিজাব খুলতে হয়। একবার সময়ের টানাপোড়েনে এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি তাকে সবার সামনে হিজাব খুলতে ইনসিস্ট করে এবং এক পর্যায়ে সে বাধ্য অনুভব করে। সাধারণত সুইডেনে এ ধরনের কাজ করলে আড়ালে করায়। সেদিন সে সময় মেলেনি। মেয়েটি দারুণভাবে আহত হয়। পুলিশকে জানায়। তার অনুভুতিটা এমন, ‘আমার মাথার কাপড়টি নয়, মনে হলো কেউ আমাকে নগ্ন করলো!’
একবার ভাবুন, একটি মেয়ে বাসে করে তার কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছে। বা বৈশাখী মেলায় গেছে। কিংবা একটি কনসার্টে। একদল হায়েনা তার কামিজের ভেতর হাত প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। তার পোশাকের অনুষঙ্গ খুলে নিয়েছে। এটি কী ভয়ঙ্কর পর্যায়ের অপরাধ! এটি কি কেবল ‘সম্ভ্রম’ ভঙ্গ? তাই মনে হয়? এটি তার শরীরের প্রতি বেআইনি ট্রেসপাস কেবল নয়, তার মনের অণু-পরমাণু পর্যন্ত ব্যবচ্ছেদ করা। তাকে ফালা ফালা করা। তাকে একটি বিশাল জনসমুদ্রে ওপেন খুবলে খাওয়া। তার সাথে ‘সম্ভ্রমের’ সম্পর্ক খুবই সামান্য। এটি খুনের থেকেও ভয়ঙ্কর একটি ফৌজদারি অপরাধ। একটি মানুষের সবচাইতে নিজস্ব এবং ব্যক্তিগত তার শরীর। তার উপর হামলা। তার ইনার-আউটার, এক্সটারনাল-ইন্টারনাল সকল এরিয়ায় তাকে ফালা ফালা করা। ওপেন করা। ব্যবচ্ছেদ করা। তার একান্ত আপন অংশগুলো দলিত মথিত করা। এই অপরাধকে অনুমান করার চেষ্টা করুন।
একটি মেয়েও কি আছে আমাদের পৃথিবীতে, ভিড়ের ভেতর যার নিতম্ব খামচে ধরেনি সহযাত্রী? কোনো একটি ভিড়ও আমাদের নারীদের, কিশোরীদের, তরুণীদের নিস্তার দিয়েছে?
সেবার ১৬ ডিসেম্বর সাভার স্মৃতিসৌধে ঢুকতে যেভাবে মলেস্ট হতে হয়েছিল এই আমাকে, সে দুঃসহতা নিয়েই দিনরাত্রি কাটিয়ে যেতে হয় আমাকে। বিশবিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে ট্রেনের দরোজায় একদল হায়েনার মাংস খুবলে নেওয়া। মাসের পর মাস হাঁটতে পারিনি। একে বলবেন না ‘শ্লীলতা’ সম্ভ্রম’হানি। একে বলুন ‘অপরাধ’! ক্রাইম! আইনি ধারায় তার বিচার চান।
একটি নারীর প্রতি হওয়া অপরাধকে অপরাধ বলতে শিখুন। একটি বায়বীয় শব্দ দিয়ে নারীর প্রতি সংঘটিত অপরাধকে হালকা করে আবার সেই নারীকে সামাজিকভাবে ‘হেয়’ ‘সম্মানহীন’ উপাধি দেওয়ার দুঃসাহস দেখাবেন না আর!
অপরাধকে অপরাধ বলুন! বলতে শিখুন! অভ্যেস করুন! নইলে যতবার বলবেন এ শব্দগুলো নিজেও সেইসব গুরুতর ভয়ঙ্কর অপরাধের অংশীদার হবেন!