নাদিন শান্তা মুরশিদ:
প্রফেসর জাফর ইকবালকে আমি চিনি তাঁর বই পড়ে। আমরা যখন ছোট, জন্মদিনে উপহার পেয়েছিলাম তাঁর বই। আমার মতে বই হলো পৃথিবীর সেরা উপহার। সেই বই পেয়ে আমি তো মহাখুশী। ওই প্রথম বাংলায় সায়েন্স ফিকশন পড়লাম। কী আশা করেছিলাম জানি না, কিন্তু এতো ভালো লাগবে সেটা আশা করিনি। আমার জন্মদিন গ্রীষ্মকালে, মানে তখন গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। সেই ছুটির অনেকটাই কাটালাম জাফর ইকবালের বইগুলো পড়ে।
তবে ওই শেষ। তাঁর সায়েন্স ফিকশন তারপর আর পড়া হয়নি। আমি এমনই। যাই করি জান দিয়ে করি, তবে শেষ হয়ে গেলে শেষ, পেছনে আর ফিরে তাকাই না। কিন্তু তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা থেকেই গেলো। নানা বিষয়ে নানা রকম কথা তিনি বললেন পরবর্তীতে। সব কথার সাথে মত মিলেনি, এখনো মিলে না। সেটাই স্বাভাবিক। তার মানে এই না যে আমি তাঁর প্রতি বৈরীভাবাপন্ন বা তাঁর শত্রু।
আমরা যারা শিক্ষাপ্রদানের গুরুকাজে জড়িত, আমরা তো শুধু পড়াই না, আমরা গবেষণাও করি, এবং সেটা নিয়ে লেখালেখি করি নানা রকম প্রকাশনায়। আমাদের কাজই হলো সবকিছুর ক্রিটিকাল এনালাইসিস করা। তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা-সমালোচনা বিশ্লেষণ করা। আমাদের বিশ্লেষণে মাঝে-মধ্যে ভুল হতে পারে, সমালোচনা অস্পষ্ট বা অসম্পূর্ণ হতে পারে, আরো কিছু বলার বাকি থেকে যেতে পারে। সেটা নিয়ে আরেক বিশ্লেষক দশটা কথা বলতে পারেন, এবং বলবেনও। এটাই “স্কলারলি” ব্যবহার। এভাবেই কথা এগোয়, তত্ত্ব অগ্রসর হয়, জ্ঞানের পরিধি বাড়ে।
কিন্তু আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে এসে পড়েছি যেখানে অনেকেই আর কথা বা তত্ত্বকে এগোতে দিতে চান না। তাঁরা কারা আমরা জানি, সেই আলাপ করে সময় নষ্ট না করি। বরং একটু ভাবি এটা কেন হচ্ছে। কয়েকটা কারণ তুলে ধরলাম (এটা সম্পূর্ণ তালিকা নয়)।
১) আমরা গাধা গরু হয়ে থাকলে এক অংশের মানুষের অনেক লাভ। আমাদেরকে যা ইচ্ছা বোঝানো যায়। তাঁদের পক্ষে কামলা খাটানো যায়। তাঁরা লাভবান হন। যদিও ভুল করে আমরা ভাবতে পারি যে আমরাও লাভবান হচ্ছি।
২) আস্তিক বনাম নাস্তিক এই আলাপকে আমরা যদি মনে করি আসলে “সেকুলারিজম” বনাম ধর্মের আলাপ, আমরা সহজেই আমাদের সমাজের মানুষ কে দুই ভাগে ভাগ করতে পারব। সেকুলারদেরকে নাস্তিক বানিয়ে ধার্মিক মানুষদেরকে নাস্তিকদের ঘেন্না করা শেখানো সহজ। এবং সহজ ভাবেই মানুষ শিখে যায় নিজের চিন্তাধারাকে প্রাধান্য দাওয়া মানে অন্যের চিন্তাধারাকে অবৈধ মনে করা।
মানুষ কেটে দুই ভাগ করার রাজনীতি পুরনো, বহুল প্রচলিত। যুগ যুগ ধরে আমরা এই রাজনীতি দ্বারাই শাসিত। আমরা নিজেরাই যখন এহেন রাজনীতির প্রচার ও প্রসারে সামিল হই, নিজেদের পায়েই কুড়ালটা মারি তখন। মনে করতে পারি যে কুড়াল মারছি অন্য কাউকে, আরেকজনের বিশ্বাসের প্রতি নিন্দা জানিয়ে। কিন্তু ওটা আসলে নিজেরই পা।
৩) পুরনো গল্প। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ তাঁর এক ভাষণে বলেছিলেন, যে সব ছাত্র “C” পায় তাঁরাও রাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। তার মানে, যারা খারাপ ছাত্র উনি তাঁদেরও বাহবা দেন। (https://www.usatoday.com/story/news/nation-now/2015/05/17/george-w-bush-c-students-president-graduation/27488795/)।
কিন্তু কেন?
বুশ চেয়েছিলেন আমজনতা তাঁকে পছন্দ করুক, সে কারণেই এ ধরনের কথা তিনি বলেছিলেন। তাঁর দেশের মানুষ কেমন তিনি জানতেন, জানতেন কি ধরনের রাজনৈতিক যন্ত্র দিয়ে এই জনগণ তৈরি হয়েছে। বুশ এবং তাঁর সতীর্থরাই এমন দেশ, এমন জনগণ তৈরি করে রেখেছেন। ছাগল বানাতে চান তাঁরা, শিয়াল না। ছাগল মনিবের সব কথা শোনে, ওদিকে শিয়াল চালাক চতুর।
একই ধরনের যন্ত্র দ্বারা আমাদেরও তৈরি করা হয়েছে, হচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের কেলেঙ্কারি এই যন্ত্রের একটি অংশ মাত্র।
প্রফেসর জাফর ইকবালের ছুরিকাঘাতের কারণটাও তাই। আমরা যেন মুখবন্ধ রাখতে শিখি। মুখ খুলে অপ্রিয় কথা বলার সাহস যেন না যোগাই। কে কী করবো, কার কী করা উচিত, এসব নিয়ে এখন ভাবছি না। ভাবছি, আমি, আমরা… কি ছাগলই থেকে যাবো?
নাদিন শান্তা মুরশিদ, সহকারী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি আট বাফালো