বালিশ খেলা: সচেতনে অবচেতন পুরুষের নারীকে ‘পাস করা’ উপহাস

কামরুন নাহার রুমা:

বিয়ের পর প্রথমবারের মতো সাংবাদিক স্বামীর সাথে ঢাকা প্রেসক্লাবের বনভোজনে গেলাম সেদিন। এতোদিন যে কোনো বনভোজনে গিয়েছি ‘সিঙ্গেল স্ট্যাটাস’ নিয়ে। এই প্রথম কোথাও গেলাম ডাবল মানে বিয়ের পর জামাইসহ। চারপাশ থেকে অনেকেই ভাবী ভাবী ডেকে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন; অবশেষে ভাবী হলাম, তাই অনেকেই অভিনন্দনও জানাচ্ছেন।

সবকিছুই স্বাভাবিক লাগছিলো, ভালও লাগছিলো আবার অনেক কিছুই নতুন নতুন লাগছিল। বাইরে গরম থাকায় ওনার সাথে কনভেনশন হলে ফ্যানের নিচে গিয়ে বসলাম। বসে গল্প করছি- এমন সময় মাইকে ঘোষণা এলো, এবার রয়েছে নারীদের জন্য মজার খেলা ‘বালিশ খেলা’, যেখানে বিজয়ী পাবেন আকর্ষণীয় পুরস্কার, আর পুরুষদের জন্য হাউজি খেলা।
পাশ থেকেই কেউ একজন ডেকে বললেন, ভাবী চলেন। আমি যেতে চাচ্ছিলাম না, কিন্তু উনি (আমার পার্টনার) বললেন, যাও। খুব অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসলাম। কম করে হলেও ৮০ জন ভাবী বসেছিলাম বালিশ খেলতে। আমি খুব মন দিয়ে সবাইকে একবার দেখলাম; আমার মতো কয়েকজন ছাড়া বাকি সবারই দেখলাম বেশ আগ্রহ খেলায়।

আমি ছোটবেলা থেকে নানান বনভোজন বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে নারীদের জন্য বালিশ খেলা ছাড়া অন্য কোনো খেলা দেখিনি । মাঝে মাঝে মিউজিক চেয়ার বা চোখ বেঁধে হাড়িভাঙ্গা খেলা দেখেছি। ছোটবেলায় মজা পেতাম। কিন্তু বড় হবার পর যখন খেলাটার পেছনের রাজনীতিটা বুঝলাম, তখনই আর এর প্রতি আমার কোনো আগ্রহ কাজ করতো না।

আমি সেদিন বালিশ খেলতে বসেছিলাম একটা অভিজ্ঞতা নেবার জন্য – ‘হাউ ডাস ইট ফিল একচুয়ালি’ একটা ব্যাপার আর কী! বসার পর আমি কখন এই খেলা থেকে বের হবো তার অপেক্ষা করছিলাম, কারণ ইতিমধ্যে এই খেলা নিয়ে সমস্যা শুরু হয়ে গিয়েছিলো (নিয়ম কানুন সংক্রান্ত)। মিউজিক যখন আমার কাছে এসে থেমে গেল, আমি যেন মুক্তি পেলাম এবং খুব খুশি মনে বের হয়ে এলাম।

বালিশ খেলাটা মূলত নারীদের অংশগ্রহণে খেলা; আমি কোনো পুরুষকে আজ অব্দি বালিশ খেলতে দেখিনি। এই খেলার মূল খেলোয়াড় মিউজিক কন্ট্রোলার (আমার মতে); আরও মজার ব্যাপার মিউজিক কন্ট্রোল করে একজন পুরুষ । তাই এটা পুরোপুরি নারীদের অংশগ্রহণে খেলা তাও নয়। বসে বসে বালিশ পাস করা ছাড়া নারীদের এই বালিশ খেলায় কোনো কাজ নেই। সেই খেলার বিজয়ী নির্ধারিত হয় যিনি মিউজিক নিয়ন্ত্রণ করছেন তার হাতে। খেলা বলতে যা বুঝায় শারিরিক এবং মানসিক (বুদ্ধি বা মেধা ভিত্তিক) অংশগ্রহণ তার কোনোটাই এই খেলায় নেই শুধুমাত্র বসে থাকা ছাড়া। বসে থেকে বালিশ পাস করা কোন কঠিন শারীরিক কাজ নয়। সবচেয়ে সহজ কাজের একটা ।

এই বালিশ খেলা কবে, কখন, কীভাবে নারীকুলের জন্য জাতীয় খেলা হয়ে গেলো সেটার কোনো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আমার জানা নেই ঠিকই, তবে এটা যে পুরুষদের দ্বারা নির্ধারিত, সে ব্যাপারে আমার ধারণা কারো কোনো সন্দেহ নাই। নারীরা শারীরিকভাবে দুর্বল, কম বুদ্ধি আর মেধাসম্পন্ন, এটা মাথায় রেখেই এই খেলাটা ‘ভাবীদের খেলা হয়ে গেছে’।

আমার সাথে সবাই একমত হবেন না আমি জানি। পক্ষান্তরে হাউজি পুরোটাই বুদ্ধিভিত্তিক (অনেকাংশে) খেলা এবং পুরুষের জন্য খেলা; যদিও অনেক নারীকেও অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। পুরুষরা মেধাবী, তারা মেধার খেলা খেলবে, তারা হাউজি খেলবে, আর নারীরা খেলবে বালিশ। ঘর সংসার আর বিছানা বালিশ থেকে এখানেও নারীর মুক্তি নেই ।

‘আকর্ষণীয় পুরষ্কার’ কথাটার মধ্যে এক ধরনের হাতছানি এবং প্রাপ্তি আছে। এ দেশে যে নারী সংসার সামলানোর মতো একটা কঠিন কাজ করার পরও কারো কাছ থেকে ন্যূনতম ধন্যবাদ পায় না, সে যদি কোনো একটা খেলায় অংশগ্রহণ করে কিছু একটা পেয়ে যায়, তাহলে সেটা তার জন্য বিরাট প্রাপ্তি। প্রাপ্তির এই ব্যাপারটা মনস্তাত্বিকভাবে নারীকে বালিশ খেলতে উদ্বুদ্ধ করে। তাই কোনো কিছু না ভেবেই নারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে বালিশ খেলায় অংশগ্রহণ করে। এর পেছনে তাঁকে কোণঠাসা করার এবং দুর্বল প্রমাণের হাতিয়ার লুকানো আছে, তা তাঁর মাথায়ও আসে না।

নারী একসময় চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকতো। নারী সেই দেয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছে অনেক আগেই; দৌড়ে বাস ধরে তাতে দাঁড়িয়ে থেকে কর্মস্থলে পৌঁছায় এখন নারী। সে চাকরি তো করেই, সেই সাথে করে সংসার। যে দেশের নারী সাতটি মহাদেশের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করে, সে দেশে তাঁর জন্য বালিশ খেলা আর কতোদিন!

শেয়ার করুন: