ধর্ষণই যখন আনন্দের উৎস

শাশ্বতী বিপ্লব:

মন খারাপেরা ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে আমার উপর। যতই ভাবি আর লিখবো না এসব নিয়ে, শুনেও শুনবো না, দেখেও দেখবোনা, আমার কি এসে যায় এসবে? ততই কষ্টের, অপমানের, অসম্মানের বোধ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। আমি নিজের অজান্তেই ঝাপসা চোখ নিয়ে লিখতে বসে যাই। ক্ষোভ আর দুঃখরা অক্ষর হয়ে উঠতে থাকে একা একাই।

পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে ভেতরে ভেতরে আমি ১৩ বছরের এক বালিকা হয়ে উঠি। যে বালিকাকে ধর্ষণ করছে তারই প্রায় সমবয়সী তিন কিশোর। মোবাইলে ধারন করে রাখছে সেই উল্লাস, আবার ধর্ষণ করার অস্ত্র হিসেবে।

একবার নয়, দু’বার নয়, তিন তিনবার। আমার গা গুলাতে থাকে, নিঃসীম অসহায়বোধে ডুবে যেতে থাকি আমি। ভাবতে থাকি, ওরা কি সত্যি সত্যিই এই ভিডিওগুলো প্রচার করে দেবে? জানিয়ে দেবে সবাইকে? দিলে তখন কী হবে? আমার মা, বাবা, ভাইবোনেরা তখন কী করবে? আমিই বা কী করবো তখন? কেমন করে এই বিপদ থেকে বাঁচবো আমি?

মাত্র ১৩ বছর বয়সেই আমি বুঝে নিতে থাকি, আমার এই শরীর একটা মাংসপিণ্ড ছাড়া কিছু নয়। পুরুষ, সে যে বয়সেরই হোক না কেন, বিকৃত লালসা নিয়ে যেকোনো সময় হামলে পড়তে পারে আমার উপর। আরো বুঝে নিতে থাকি, আমার শরীর এবং সেই শরীরের “সতীত্ব” সবচেয়ে দামী। এমনকি আমার জীবনের চেয়েও। তাই আমাকে সামাজিক অপমানের ভয় দেখিয়ে বারবার ধর্ষণ করা সম্ভব হয়। আমি নিজে নিজেই শিখে যেতে থাকি , আমার শরীরই আমার সবচেয়ে বড় শত্রু।

অন্যদিকে ভেতরে ভেতরে আমি ১৪,১৫, ১৬ বছরের কিশোরদের মা হয়ে উঠতে থাকি। সহজলভ্য প্রযুক্তির চোরাগলিতে ঘুরে ঘুরে যৌন নিপীড়ক, ধর্ষক হয়ে উঠছে আমাদের সন্তানেরা। আমি আতংকিত বোধ করতে থাকি। আমার শরীর অসাড় হয়ে আসতে থাকে। আমাদের শিশু, কিশোর, তরুণ নির্বিশেষে সবার হাতের মুঠোয় পৌঁছে গেছে অবাধ ইন্টারনেট। যার ব্যবহারের উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই ওদের জন্য বিকল্প কোনো বিনোদনের ব্যবস্থাও। কী করে বাঁচাবো আমাদের প্রজন্মকে এই ধ্বংসের হাত থেকে?

ধর্ষণের শিকার মেয়েটির চাইতে মাত্র এক, দুই ও তিন বছরের বড় এই কিশোররা। যারা বিশ্বস্ত খেলার সাথী হতে পারতো, স্নেহবান বড় ভাই হতে পারতো, এমনকি চাইলে মেয়েটির প্রণয়প্রার্থীও হতে পারতো। মনে মনে ভালোলাগা তৈরি হওয়ার, কারো প্রতি নির্মল টান অনুভব করার এইতো বয়স। অথচ ওদের কিশোর মস্তিষ্ক ও মননে খেলা নয়, স্নেহ নয়, প্রেম নয়, জায়গা করে নিয়েছে কদর্য, বিকৃত যৌনক্ষুধা। ধর্ষণকেই বেছে নিয়েছে আনন্দের উৎস হিসেবে! এটা মোটেও হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। এর জের টানতে হবে আমাদের বহুদূর।

পৃথিবীটাকে যখন মাত্র জানতে শুরু করেছে আমাদের সন্তানেরা, ভালোবাসতে শুরু করেছে জীবনটাকে, তখনই বিকৃতিরা, ঘৃণারা কেন ওদের জীবন চেনাতে আসে? আমি কারো উপর রাগ করতে পারি না। এর দায় আমারও। শুধু এক তীব্র অসহায়বোধে তলিয়ে যেতে থাকি।

(রাঙামাটিতে ১৩ বছরের কিশোরীকে ধর্ষণের পর ভিডিও ধারণ করে সেটি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে আরো দুবার ধর্ষণ করেছে ১৪, ১৫ এবং ১৬ বছর বযসী তিন কিশোর)

শেয়ার করুন: