বিনা মানসিক চিকিৎসায় আর একটিও অপমৃত্যু নয়

ডা. শিরীন সাবিহা তন্বী:

যদি আপনার শিশুর ডায়রিয়া হয়ে পানিশূন্যতা হয়, আর আপনি তার চিকিৎসা না করান, তাকে ওরস্যালাইন না দেন, তার শরীরের পানিশূন্যতা রোধ না করেন, আর সে মারা যায়, তবে আপনি এই মৃত্যুকে বিনা চিকিৎসায় বা অবহেলায় মৃত্যু বলে মেনে নিচ্ছেন তো?

যদি আপনার বৃদ্ধ পিতা-মাতা হৃদরোগ এ আক্রান্ত হোন, হার্টে ব্লক নিয়ে বসে থাকেন, আর আপনি তাদের চিকিৎসা না করান, তখন যদি তারা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান, তাহলে আপনি এই মৃত্যুতে আপনার অবহেলা বা মাতা পিতার বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু মানতে রাজী তো?

আপনার বয়ো:সন্ধি অতিক্রম করতে থাকা ছেলে বাচ্চাটা, আপনার প্রচণ্ড মেধাবী মেয়েটি যখন ক্যানভাসে তুলির ছোঁয়ায় সারা বিশ্বকে জয় করতে চাইছে, পৃষ্ঠার পরে পৃষ্ঠা জুড়ে লিখছে কবিতা, তুলির আঁচড়ে বা কবিতার শব্দে জুড়ে থাকছে সৃষ্টিশীলতার অমোঘ বিষন্নতা, তাকে নজরে রাখছেন তো!

সৃষ্টিশীলতা আমার কাছে এক ঐশ্বরিক ব্যাপার। পৃথিবীর স্রষ্টা সব ধর্ম এবং বিশ্বাস নির্বিশেষে প্রতিটি প্রাণ সত্তার সর্ব বৃহৎ রহস্য বলে আমি বিশ্বাস করি। আর সৃষ্টিশীল মানুষদের মাঝে সৃষ্টিকর্তা তার নিজের গুণ দিয়েছেন খানিকটা। আর সেই কারণে তাদের ভাবনার ব্যাপ্তি, চিন্তাশীলতা, যাপিত জীবন সাধারণের থেকে আলাদা। সাধারণের মতো খাই দাই ফূর্তি করি, সেল্ফি তুলি মার্কা জীবন তাদের কখনই হয় না।

পৃথিবী নামক একমাত্র জীব বসবাসে উপযোগী গ্রহ, নক্ষত্রপুঞ্জ, গ্যালাক্সী, মানুষ নামক বহুরূপী প্রাণী, মানব জন্ম, ইতিহাস, মানুষের সৃষ্টিশীলতা, মানুষের স্বল্পদৈর্ঘ্য জীবন এবং নিষ্ঠুর অবধারিত পরিণতি – মৃত্যু…ভাবনাগুলো অমূলক তো নয়।

কারো বয়ো:সন্ধির নিয়ন্ত্রণহীন ভাবনাতে এইসব জটিল আর রহস্যময় বিষয় হানা দিলে, কারো মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হলে, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা কেন তাকে রুগী ভাবতে নারাজ?
কারও শারীরিক অসুস্থতা যতোটা সহজবোধ্য এবং গুরুত্ব বহন করে, কারো মানসিক স্বাস্থ্য, যত্ন, সুস্থতাও ততোটাই এবং কখনও কখনও আরও বেশি গুরুত্ব বহন করা উচিত।

বয়ো:সন্ধির হরমোন পরিবর্তনের কারণে জড়িয়ে পরা কোন অসম, অনিয়ন্ত্রিত সম্পর্ক, ড্রাগ, অপরাধ সবটাই মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আবার যৌবনে অস্বাভাবিক সম্পর্ক, প্রতারণার বা ব্যর্থতার শিকার হওয়া, একাকিত্ব সবটাতেই আপনার, আপনার সন্তানের বা কাছের আত্মীয়ের মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হতে পারে। এতোটাই বিঘ্ন ঘটতে পারে যে আপনার সারা জীবনের কষ্ট পরিশ্রম মুহূর্তে ব্যর্থ করে আপনি নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবেন কোনো অভিশপ্ত ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত লাশ হিসেবে বা উঁচু ছাদ থেকে সদ্য ঝাঁপ দেয়া লাশ হিসেবে কিংবা আপনার গোসলখানায় রক্তের স্রোতধারায় ভাসতে দেখবেন আপনার প্রিয় সন্তানকে, না হয় আপনার ওড়না পেঁচানো সন্তানের ঝুলন্ত লাশ দেখার অশরীরী দৃশ্যটা সারা জীবন আপনাকে তাড়িয়ে বেড়াবে।

তাই সময় থাকতে সাবধান হোন। নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের মানসিক সুস্থতার দিকে সদয় নজর দিন। কথা বলুন।হাসুন। মানসিক সুস্থতা এতটুকু বিঘ্নিত হলেই সাইক্রিয়াটিস্ট বা সাইকোলজিস্টের কাছে যান। সাইকোথেরাপি নিন। নিজেকে সুস্থ রাখুন। নিজে বেঁচে থাকুন এবং পরিবারের সদস্যদের বাঁচিয়ে রাখুন।

অন্তত মানসিক অসুস্থতায় চিকিৎসা না পেয়ে বিনা চিকিৎসায় একজনও যেন মারা না যায়। আত্মহত্যা নামক পাপের পথ বেছে না নেয়। সেই ছোট চেষ্টাটুকু তো আমরা সবাই করতে পারি। তাই নয় কি?

#Dr.Sherin Sabiha Tonny

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.