আহমদ শফী এবং পুরুষতন্ত্রের হেফাজত

সীনা আক্তার :

সম্প্রতি ইউটিউবে প্রচারিত হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীর নারীবিরোধী বক্তব্যের মূল বিষয় হচ্ছে, নারীর শিক্ষা; অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ এবং জনসমক্ষে নারীর বিচরণ বন্ধ করা। এই বক্তব্য হেফাজতের নারী সংশ্লিষ্ট দাবীর ব্যাখ্যা বলা যেতে পারে। স্পষ্টতই আহমদ শফীর এই বক্তব্য নারীদের জন্য অবমাননাকর এবং বৈষম্যমূলক যা সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনকে ব্যাহত করতে পারে। সবচেয়ে আপত্তিকর বিষয় হচ্ছে, তিনি এসব বক্তব্যে ধর্মের নামে পুরুষতান্ত্রিক মতবাদ, রীতি-নীতি প্রচার করছেন যা রীতিমত অসততা এবং সহজ সরল মানুষের সাথে এক ধরনের প্রতারণা।

আহমদ শফী মনে করেন, মেয়েদের চতুর্থ/পঞ্চম শ্রেণীর অধিক পড়াশোনার দরকার নেই; নারীর উচ্চশিক্ষা মানে টাকার অপচয়…! নারী ঘরের বাইরে যাবে না, এবং ঘরের বাইরে নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে তিনি নেতিবাচকভাবে ব্যাখ্যা করছেন… । নারীর প্রতি এই বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভংগী স্পষ্টতই তার পুরুষতান্ত্রিক দর্শন,মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে তিনি দেশে একটি পুরুষতান্ত্রিক [Patriarchal] সমাজ ব্যবস্থাকে হেফাজত করতে চাইছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সাধারণত পুরুষ [এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার নারী] অন্যায় এবং বৈষম্যমূলক নিয়ম–কানুন প্রয়োগ করে নারীর উপর কর্তৃত্ব করে, নারীর অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্থ করে এবং তাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে; যা ইসলাম ধর্ম এবং দেশের সংবিধান বিরোধী। পবিত্র কুরআন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে অনুমোদন দেয় না, বরং যে কোন ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণকে শিরক্ হিসাবে অবিহিত করে।

ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায় নবীজির স্ত্রী খাদিজা (রাঃ) ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী, অন্য স্ত্রী আইশা (রাঃ) ছিলেন একজন বিশিষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তি, যিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার -প্রসার-উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখেছেন, এমনকি সেসময় তিনি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইসলাম ধর্মে প্রত্যেক নারী-পুরুষ এর জন্য শিক্ষা এবং জ্ঞান অর্জনকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়া হয়েছে; তাই আমাদের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, জ্ঞান অর্জনের জন্য সাগর-মহাদেশ পাড়ি দেবার কথা এবং উদাহরন হিসাবে তিনি বলেছেন ‘জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনে চীনে যাও’।

ধর্ম মতে নারী-পুরুষ সকলেরই দায়িত্ব রয়েছে অন্যের প্রতি, পরিবার ও কমিউনিটির সদস্যদের প্রতি, মুসলিম-অমুসলিম সবার প্রতি, পুরো মানবজাতির প্রতি। ইসলাম ধর্মে কোথাও নারীকে ঘরের বউ হয়ে থাকার কথা বলা হয়নি। কিন্তু আহমদ শফির বক্তব্যে যে সব নারী ঘরের বাইরে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত যেমন পোষাক শ্রমিক, তাদের সম্পর্কে যথেষ্ট অশালীন মন্তব্য করা হয়েছে। কোন তথ্য প্রমান ছাড়া পোষাক শ্রমিকদের সম্পর্কে মন গড়া আন্দাজে [Asuumption] এই অশোভন মন্তব্য মানে তাদের অবমাননা করা, পরিবার এবং রাষ্ট্রে তাদের অবদানকে অসম্মান করা। নারীকে মানসিকভাবে আহত করা, মিথ্যা কুৎসা রটিয়ে সমাজের তাদের হেয় করা- এসবই হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক কূটকৌশলের অংশ যা অনৈতিক এবং নিন্দনীয়। অন্যদিক তিনি নারীকে পুরুষের প্রতিপক্ষ বা পুরুষের শিক্ষা গ্রহণে অন্তরায় হিসাবে বিবেচনা করছেন। তার মতে, নারীদের দেখলে পুরুষের যৌনাভূতি হয় যা তাদের মনোযোগ বাধাগ্রস্থ করে! চরম আত্মবিশ্বাসহীন কোন পুরুষেরই কেবল এরকম হতে পারে যা একান্তই ঐ পুরুষের সমস্যা। এখানে লক্ষণীয় আহমদ শফি তার নিজস্ব ধারনা বা অভিজ্ঞতা দিয়ে [Subjective experience] পুরো পুরুষ জাতিকে বিচার করছেন এবং তার বিপরীত অভিজ্ঞতার পুরুষদের বিদ্রুপ করছেন। নারীর প্রতি তার এই দৃষ্টিভংগি তার সমমনা পুরুষদের এই বার্তাই দেয় যে, – নারী ভোগের সামগ্রী এবং তাদের দেখলে পুরুষের যৌনাভূতি হওয়া উচিৎ! এ ধরনের বার্তার ভয়ংকর ফলাফলই হয়তো প্রায় প্রতিদিন পত্রিকায় নারী ধর্ষনের খবর, আমার ধারনা।

ব্যক্তিগতভাবে একজন পুরুষ নারীদের তেতুল বা মধু যাই মনে করেন সেটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার কিন্তু সে বিষয়ে জনসমক্ষে সাধারণীকৃত [Generalised] বক্তব্য এবং অন্যকে প্ররোচিত করা অন্যায়। এই সমাজের অধিকাংশ পুরুষ নারীকে মানুষ মনে করেন, নারীদের সাথে একসাথে পড়াশোনা করেন, কাজ করেন এবং নারীর সহযোগিতায় পাশে থাকেন। আর এই জন্যই সমাজ টিকে আছে। ইসলাম ধর্মে মানুষে মানুষে এই সহমর্মিতা-সহযোগিতার কথাই বলা হয়েছে।

চূড়ান্ত পুরুষতান্ত্রিক আচরণ হচ্ছে, কিছু পুরুষ নারীকে ভোগ্যবস্তু ভেবে লালায়িত হয় এবং আহমদ শফি এবং তার শিষ্যরা এর জন্য নারীকে দায়ী করে তথাকথিত পর্দা মেনে চলার ফতোয়া দেন। ধর্মের নামে, পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ব করে ঐ সব পুরুষের চারিত্রিক সমস্যার দায় নারীর উপর প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন। পর্দার মূল বিষয় হচ্ছে শালীনতা- মনে, চোখে এবং পোশাকে। আমাদের দেশের প্রায় সকল নারী প্রয়োজনীয় শালীন পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করেন; তারা মন এবং চোখের পর্দা মেনে চলেন। তাছাড়া, ধর্মে নারী-পুরুষের শালীনতা সমান গুরুত্বের সাথে বলা হয়েছে। আশা করি আহমদ শফি তার অনুসারীদের এবং ছাত্রদের যথাযথ শালীনতা সম্পর্কে জ্ঞান দিবেন, বিশেষ করে মনের এবং চোখের পর্দা সম্পর্কে, যাতে ঐ সব পুরুষ নিজেদের সংযত করে চলতে পারে, নারীর শরীরের কোনায় কোনায় দৃষ্টি না দিয়ে নারীকে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করতে শেখে।

প্রসংগত, এদেশের মুসলিম নারী বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির আলোকে ধর্মের রীতি-নীতি মেনে চলেন এবং সেটাই স্বাভাবিক। এদেশের নারী সৌদী বা আফগানিস্তানের সাংস্কৃতিক রীতি নীতি মানতে বাধ্য নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ধর্মের রীতি-নীতি কে, কDভাবে পালন করছে তা বিচার করার অধিকার রাখেন কেবল আল্লাহ্, কোন মানুষ নয়। হেফাজতে ইসলাম বা আহমদ শফির বক্তব্য আপাতত দেশের নারী শিক্ষা-উন্নয়নে কোন নেতিবাচক প্রভাব হয়তো ফেলবে না। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে অদূর ভবিষ্যতে সেরকম কিছু হতে পারে, যা মোটেও কাম্য নয়। কারণ আহমদ শফি এবং তার অনুসারীরা অনেকেই হয়তো গ্রামে-গঞ্জে এভাবেই ধর্মের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। বিশেষ করে, ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে ধর্মের নামে এই অপশিক্ষা পাচ্ছে শিশুরা।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশু বয়সে কোমল মনে মানুষ যা বিশ্বাস করে পরবর্তীতে তা দূর করা বা পরিবর্তন করা কঠিন। এটা প্রতীয়মান যে, কওমি মাদ্রাসার শিশুরা ইসলাম ও নারী বিষয়ে নারীবিরোধী বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভংগী নিয়ে বড় হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা এই সহজ সরল শিশুদের হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক ব্যবহৃত হতে দেখেছি। আগামী পাঁচ বছর পরে এই শিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে কি করবে আমরা জানি না।

আমি এই ছাত্রদের কোন দোষ দেখি না, বরং তাদের যারা শিক্ষা দিচ্ছেন পুরো দায় তাদের। ধর্মের নামে পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক রীতি-নীতি বা বৈষম্যমূলক অপসংস্কৃতির এই চর্চা বন্ধে তাই সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সবারই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা দরকার, কারণ এটা আমাদের সমাজ-সভ্যতা-সংস্কৃতিসহ সমগ্র উন্নয়নের বিষয়। তাই বিষয়টিকে শুধু আলোচনা এবং রাজনীতিকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

লেখক পরিচিতি: সীনা আক্তার, গবেষক।

তথ্যসূত্র: Asma Barlas (2002) Believing Women in Islam: Unreading Patriarchal Interpretations of the Qur’an, University of Texas Press. Asma Barlas (2005) Interview: “The Qur’an Doesn’t Support Patriarchy”, Published in ABC, The Nation, Pakistan.

Amina Wadud (1999) Qur’an and Woman: Rereading the Sacred Text from a Woman’s Perspective, Oxford University Press

Amina Wadud, ‘Islam Beyond Patriarchy Through Gender Inclusive Qur’anic Analysis’, http://www.musawah.org/sites/default/files/Wanted-AW-EN.pdf

শেয়ার করুন: