মামুনুর রশীদ:
এই ছেলে নাম কী তোমার? এই ছেলে!!
– জ্বী আমাকে বলছেন!
ঘাড় ঘুরিয়ে তিনজন প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ৬ ফুট ৩ ইঞ্চির অনি।
: জ্বী, আপনেরেই জিগাইছি।
– সরি, কানে হেডফোন ছিল শুনতে পাইনি, জ্বী আমার নাম অনি!
: অনি! এইডা আবার কেমন নাম! তা চেহারা সুরুত তো ভালোই, মুখে পাতলা দাঁড়িও আছে, কিন্তু নামডা তো মুসলমানের না!
অনি হঠাৎ করেই যেন চূড়ান্ত অপ্রস্তুত বোধ করতে থাকে! বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে, এটা সে আশা করেনি!
ঠিক তার চারদিন পরেই ঘটেছিল ঘটনাটা- গরমের দিন বলে বাহির বাড়িতে অনেক রাত অবধি যখন সে আর বন্ধু আতিক মিলে নিজেদের মধ্যে ধর্ম, সমাজ, সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে আলোচনা করছিল, ঠিক তখনি জনা আট দশেক লোক তাদের ঘিরে ফেলে!
কিছু বলার আগেই – বুঝে উঠার আগেই এলোপাথাড়ি বাড়ি পড়তে থাকে তার উপর। জ্ঞান হারাবার আগে সে আর কিছুই মনে করতে পারেনি। তারপর কীভাবে কী হয়েছে সে জেনেছে আতিকের কাছ থেকে, দীর্ঘ ১১ মাস হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে তাকে!
তারপর অনেকবার সে আতিককে জিজ্ঞেস করেছে, কে বা কারা এমনটা করেছে? প্রতিবারই আতিক এড়িয়ে গিয়েছে, কিন্তু তার বিদেশে চলে যাওয়ার দিন বন্ধুকে শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করতেই সে শুধু বলেছিল- “এটা নাকি ছিল মুসলমানের সন্তান হয়ে অমুসলিম নাম রাখার শাস্তি”!
ঠিক এরপর থেকেই বদলে যায় জীবন সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে অনির ভাবনা, গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে তার চিন্তাধারা! অসংখ্যবার – লক্ষ বার সে ভেবেছে শুধুমাত্র একটা “নাম” এর জন্য তাকে এমন নির্দয় – অমানুষের মতো মেরেছিল মানুষগুলো!
তারা একটি বারও জানতে চায়নি সে নামায পড়ে কিনা – পূজা করে কিনা – গির্জা প্যাগোডায় যায় কিনা, সে কোরআন – গীতা- বাইবেল- ত্রিপিটক পড়ে কিনা, সে ধর্মচর্চা করে কিনা – একটি বারও না! অথচ তারা জানতে চাইলেই সে জানাতো – সে প্রতি ওয়াক্তে নামাজ পড়ার চেষ্টা করে, সে ছোটবেলায় মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু না বুঝেই একটি বিদেশী ভাষার বই আল – কোরআন “খতম” দিয়েছে, কিন্তু মনের তাগিদে সে এরপর আবার প্রায় প্রতিদিন কোরআন পড়ছে, প্রতিটি শব্দের অর্থ বোঝার চেষ্টা করছে।
আর কীইবা হতো যদি সে কোনো ধর্মেই বিশ্বাসী না হতো! সে তো আজ পর্যন্ত কাউকে একটু ধমক দিয়েও কথা বলেনি! আঘাত বা ক্ষতি করা, কারো ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে কটুক্তি করা তো দূরের কথা! অথচ তারা কিছুই জানতে চায়নি, তাদের কাছে দুই অক্ষরের একটি নিরীহ শব্দই ছিল তাদের কাছে, তাকে মেরে ফেলার অছিলা!
এই যে সে এখন প্রতি সপ্তাহে একদিন অনাহারী কয়েকজন মানুষের খাওয়ানোর আয়োজন করে – তখন তো সে কারো নাম জিজ্ঞেস করে না, কারো ধর্ম বিশ্বাসের কথা জিজ্ঞেস করে না – এতে কি তার স্রষ্টা মনোক্ষুন্ন হয় তার প্রতি!
প্রতি তিন-চার মাস পরপর যখন সে রক্ত দেয় – তখন সেই রক্ত কাকে দেয়া হয়- সে তো কারো নাম জিজ্ঞেস করে না, কারো ধর্ম বিশ্বাসের কথা জিজ্ঞেস করে না – এতে কি তার স্রষ্টা মনোক্ষুন্ন হয় তার প্রতি!
বিভিন্ন দুর্যোগের সময় যখন সে খাবার নিয়ে, পানি নিয়ে, বস্ত্র নিয়ে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করে – তখন তো সে কারো নাম জিজ্ঞেস করে না, কারো ধর্ম বিশ্বাসের কথা জিজ্ঞেস করে না – এতে কি তার স্রষ্টা মনোক্ষুন্ন হয় তার প্রতি!
পৃথিবীর কোন ধর্মগ্রন্থেই বলা হয়নি, শুধু কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষদের সাহায্য করতে, অন্যের সাথে কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেই তাকে মারধোর করতে, ধর্ম মানা – না মানা নিয়ে অন্যের সাথে জোর জবরদস্তি করতে।
যারা প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাসী – ধর্ম পালনকারী, তারা ধর্মকে ব্যবহার করেন “ভালবাসা” র মাধ্যম হিসাবে। মানুষকে, স্রষ্টার সৃষ্টিকে ভালোবেসে, সবার মধ্যে ভালোবাসা ছড়িয়ে স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করতে চায় তারা। যারা নিতান্তই ধর্মে অবিশ্বাসী, খেয়াল করলে দেখা যায় – এদের নিতান্তই গুটি কয়জন ছাড়া – বাকিরা কেউই শুধু অন্যের ধর্ম বিশ্বাসের কারণে অন্যের প্রতিপক্ষ বা শত্রু হয়ে উঠে না, অমানবিক – নির্দয় হয়ে উঠে না।
আর একদল আছে, যারা ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের লোভ – লালসা – ক্ষমতা চরিতার্থ করতে, ব্যবসা হিসাবে। এরা ধর্মের নামে, ধর্মীয় বাণী বিকৃত করে অধর্মের আফিম খাওয়াতে চায় সবাইকে। এরা কারো আপন নয়, এদের কাছে নির্দিষ্ট কোন ধর্ম – জাতি – গোষ্ঠী নিরাপদ নয়। এরা ধর্মীয় লেবাসে থাকা অধর্মের ঝাণ্ডাধারী। এরা ভালোবাসা – হৃদ্যতা – সহমর্মিতা – মানবতা বুঝে না, এরা শুধু বোঝে ক্ষমতা, লাভ আর লোভ।
এরা বুঝে না যে কাউকে ধার্মিক হতে হলে তাকে আগে একজন মানুষ হতে হবে! এরা বোঝে না বুকে ঘৃণার আর হিংসার বীজ নিয়ে সাময়িকভাবে কিছু তৃপ্তি পেলেও, দিনশেষে জয় হয় ভালোবাসার, মনুষ্যত্বের।
এই জিনিষগুলোই অনি জেনেছে – শিখেছে – বুঝেছে গত কয়েক বছরে ধর্মীয় বই পড়ে, সমাজ দেখে, জীবন থেকে। তাই সে যে ধর্ম পালন করে তাকেও ভালোবাসে, আবার যে ধর্ম পালন করে না তাকেও সে ভালোবাসে সমানভাবে। কিন্তু কেবল ভয় পায় ধর্মকে পুঁজি করে যারা ব্যবসা করে তাদের!
তবে সে জানে, দিনশেষে জয় মনুষ্যত্বেরই হয়, মানবতারই হয় – শুধু ভালোবাসাটা ছড়িয়ে দিতে হয় সবার মাঝে – এই ঘৃণার বীজ কেবল ভালোবাসা – মানবতা দিয়েই উপড়ে ফেলা সম্ভব।
তাই ভাবি, চলতি পথে যদি কখনো অনির সাথে দেখা হয়, আমরা শুধু একে-অন্যের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসবো আর একে অন্যকে বলবো – “শুধু” নামে নয় – ধর্মে নয়, কর্মে আর মানবতার গুণেও হোক আসল পরিচয়।
লিখেছেন: Mamunur Rashid
(Published as part social media campaign #BeHumaneFirst to Promote Secularism in Bangladesh)