অপরাজিতা সংগীতা:
নারী অবমাননাকর একটি ভিডিও’র বিরুদ্ধে গত কয়েকদিন ধরে অনেক কথা বলেছি আমরা অনেকেই। কিন্তু কেন নারী অবমাননাকর বলছি আমরা? কী ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল ভিডিওটি? ভিডিওতে বলা হয়েছিলো- ছেলেরা প্রকাশ্যে ধূমপান করতে পারলেও নারীরা তা কোনোভাবেই করতে পারবেন না। কারণ, নারীরা প্রকাশ্যে ধূমপান করলে পরিবেশের নাকি বিশাল একটা পরিবর্তন হয়ে যায়! তাই নারীরা ধূমপান করতে চাইলে ঘরে বসে করতে হবে।
শুধু তাই নয়, ভিডিওটিতে আরও বলা হয়েছে, কোনো মেয়েকে প্রকাশ্যে ধূমপান করতে দেখলে, সাথে সাথে ভিডিও করে তা ফেসবুক বা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল করে দিতে হবে। আর, ছেলেরা বহাল তবিয়তে সব জায়গায় ধূমপান করতে থাকবেন। কারণ, পাবলিক প্লেসগুলো সব পুরুষদের পিতার সম্পত্তি, মানে পুরুষদেরই কিনে নেওয়া। সেখানে নারীরা বানের জলে ভেসে এসেছে আর কী!
কেন ৫/৬ দিন ধরে আমরা কিছু মানুষ আমাদের ব্যক্তিগত কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে এই ভিডিও নির্মাতাদের নিয়ে পড়েছিলাম। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই পড়েছিলাম। কারণ আমাদের মানে মেয়েদের অসম্মান করা হয়েছে ভিডিওটিতে, আমাদের অপমানে লেগেছিল। আমাদের কি ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ ছিলো? আমরা কি সবাই ধূমপান করি?
উত্তরটা হলো- না, আমরা যারা প্রতিবাদ করেছি তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ধূমপান করি না। আমি নিজে চরমভাবে ধূমপানবিরোধী একজন মানুষ। অধূমপায়ী হবার কারণেই হয়তো কেউ যখন সিগারেট টেনে আমার আশেপাশে ধোঁয়া ছাড়ে, আমার তখন চরম বিরক্ত লাগে। তাই, এটা যদি ধূমপানবিরোধী কোনো প্রচার হতো, যদি বলা হতো যে পাবলিক প্লেসে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে কেউ সিগারেট খেতে পারবে না- তাহলে এই নির্মাতাকে আমি স্বাগত জানাতাম।
কিন্তু না, এই ভিডিওটি কোনো ধূমপানবিরোধী প্রচার ছিলো না। বরং এটা ছিলো উগ্র পুরুষতান্ত্রিকতার গল্প; নারী স্বাধীনতাবিরোধী প্রচার। তাই আমরা প্রতিবাদ করেছি, পদক্ষেপ নিয়েছি ভিডিও নির্মাতা এবং অভিনেতার বিরুদ্ধে। কারণ, এরাই আমাদের আগামী প্রজন্ম। এদের নিয়েই আমরা দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি। এরা যেন এদের মনের মধ্যে এমন কোনো বৈষম্য নিয়ে বেড়ে না ওঠে যে, নারীরা দুর্বল! এরা যেন এটা মনে না করে যে, পুরুষ চাইলেই নারীকে যৌক্তিক-অযৌক্তিকভাবে, সময়ে-অসময়ে শাসন করতে পারে! নারী বলেই যেন ‘এটা করা যাবে না’, ‘ওটা করা যাবে না’ বলে বাধা হয়ে সামনে দাঁড়াতে পারে। কোনও পুরুষই যেন কোনও নারীর উপর আঙুল তুলে নারীর স্বাধীনভাবে চলাফেরাকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে।
আমাদের সমাজে নারীবিদ্বেষ নতুন কোনো ইস্যু নয়। কিন্তু এই ২২/২৩ বছরের ছেলেগুলো এতোটুকু বয়সেই যে নারী বিদ্বেষ ভেতরে পোষণ করে রেখেছে সেটি ভাবিয়েছে আমাকে।
৬/৭ দিন আগে আমাদের বন্ধু আতিকা রোমাদি প্রথম যখন ‘বৈষম্য’ ভিডিওটির কথা আমাকে ইনবক্সে জানায়, সেদিন সেটি দেখার পরই প্রচণ্ড শঙ্কিত হয়েছিলাম। বাংলাদেশের মতো নারীর প্রতি অসহিষ্ণু এবং যৌন সন্ত্রাসপ্রবণ একটি সমাজ ব্যবস্থায় এরকম নারী অবমাননাকর, বৈষম্যমূলক এবং নারীদের হেয়-প্রতিপন্ন করতে উসকানি দেওয়া ভিডিও ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে এটা ভেবেই এই শংকা।
তাই, শুরু থেকেই সোচ্চার হয়েছিলাম আমরা ওদের রুখে দিতে।
প্রথমদিন থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা কয়েকজন মিলে চেষ্টা করেছি ভিডিওর স্ক্রিপ্ট রাইটার, ডিরেক্টর হায়াত মাহমুদ ও অভিনেতা সাব্বির অর্ণবের সাথে যোগাযোগ করে ভিডিওটি ডিলিট করানোর। কিন্তু তারা সেটা না করায় আমরা আইনি পথে যেতে বাধ্য হই।
১৬ জানুয়ারি ‘বৈষম্য’ ভিডিওটির নির্মাতা এবং অভিনেতার বিরুদ্ধে আমরা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ‘সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম ডিভিশন’-এ লিখিত অভিযোগ জানাই। ১৭ জানুয়ারি আমাদের উপস্থিতিতে নির্মাতা এবং অভিনেতাকে ফোন করে ডিএমপি-র ‘সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম ডিভিশন’-এ ডেকে আনা হয়। এরপর তারা তাদের কৃতকার্যের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায় আমাদের কাছে। আমরা যারা সেখানে উপস্থিত ছিলাম এবং তাদের বিরুদ্ধে আমাদের এই পদক্ষেপ নেওয়ার প্রসেসের সাথে আরও যারা যুক্ত ছিলেন, আমরা সবাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেই যে, কয়েকটি শর্ত দিয়ে আমরা ওদের একটি সুযোগ দিবো।
কারণ, আমরা মনে করি, কেউ ভুল করে অনুতপ্ত হলে, ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা করা উচিৎ। একবার সুযোগ দেওয়া উচিৎ শুধরে নেওয়ার। তাই, আমরা তাদের কয়েকটি শর্ত দিয়ে শুধরে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছি।
শর্তগুলো ছিলো –
১। লাইভে এসে সবার কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া,
২। মুচলেকা দেওয়া যে, ‘ভবিষ্যতে এমন কোনও কাজ তারা করবে না’,
৩। নির্মাতা এবং অভিনেতা কর্তৃক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউটিউব চ্যানেল এবং ফেসবুকে থাকা এ সংক্রান্ত সব ভিডিও ডিলিট করা,
৪। এই ঘটনা থেকে তারা যে শিক্ষা পেয়েছে সেটা নিয়ে সবাইকে সচেতন করার জন্য একটি ভিডিও নির্মাণ করে প্রচার করা
শর্ত মেনে নির্মাতা এবং অভিনেতা ফেসবুক লাইভে বিষয়টির জন্য ক্ষমা চেয়েছে, মুচলেকা দিয়েছে।
ক্ষমা চাওয়ার ভিডিও লিংক: https://www.facebook.com/hmrahat2/videos/2021288028083915/?hc_location=ufi
আর এরই মধ্যে অনেকগুলো ইউটিউব চ্যানেল এবং ফেসবুক পেইজ থেকে ভিডিওটি ডিলিট করা হয়েছে এবং শেষ শর্ত মেনে এই ঘটনা থেকে গৃহীত শিক্ষা নিয়ে তারা একটি ভিডিও বানিয়ে সবাইকে সচেতন করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই- ডিএমপির ‘সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম ডিভিশন’কে। বিশেষ করে এডিসি Nazmul Sumon ভাইকে। তিনি গুরুত্ব দিয়ে শুনেছেন আমাদের অভিযোগ এবং তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিয়েছেন। সারাদিন আমাদের অত্যাচার সহ্য করেছেন, দুপুরে খাইয়েছেন (মাটন খিচুড়িটা মজার ছিলো)। পুলিশের ভাবমূর্তি আমাদের সমাজে যেহেতু ইতিবাচক কিছু না, তাই ‘সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম ডিভিশন’ সম্পর্কেও মানুষের তেমনই ধারণা। তাই আমরাও ইত:স্তত বোধ করেছিলাম কী করবো না করবো ভেবে। কিন্তু তারপরও বিশ্বাস ছিল যে, সবাই মিলে কোনো উদ্যোগ নিলে কিছু একটা ফল পাবো; পেয়েছিও। অনেকদিন পর আবার মনে হলো- পুলিশ জনগণের বন্ধু।
এই ভিডিও ভাইরাল হবার শুরু থেকে যে মানুষগুলো প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ। আর যাদের কথা না বললেই নয়, যাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সাহায্য ছাড়া এই কাজটি করা সম্ভব হতো না সেই Jharna Moni, Irani Bilkis Khan, Rumana Iqbal, Farhana Huq Nila, Swapna Chokroborty, Shabana Seju আপুসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। Supriti দি আর Roma দি তো সবসময়ের, সব কাজের কাজী। তারা প্রতিটা মুহূর্তে নিজের কাজ ফেলে ‘বনের মোষ তাড়িয়েছেন’। অবশেষে আমরা পেরেছি নারী অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও পদক্ষেপ নিতে।
অবশেষে এটা প্রমাণ হয়েছে, আমরা এক হলে যে কোনও অন্যায়কে রুখে দেওয়া সম্ভব। আমাদের একতা থাকবে এবং এখন থেকে কোনও নারীকে কোনও সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্যক্ত করা হলে বা নারীর বিরুদ্ধে অবমাননাকর কোনো কন্টেন্ট প্রচার করা হলে আমরা সেই অপরাধের বিরুদ্ধে সবসময় লড়ে যাবো। আমাদের যাত্রা এখানে সবে শুরু। আশা করি, পুলিশ ভাইয়েরা আমাদের সহযোগী হিসেবে পাশে থাকবেন।