ফারজানা গুঞ্জন:
বনানীর একটা ক্যাফে থেকে কেবলই বের হয়ে দাঁড়িয়েছি রাস্তায়। সন্ধ্যা তখন নামি নামি করছে। আমি আর আমার বন্ধু গল্প করছিলাম, আর আমার চোখ ছিলো ফোনে। হঠাৎ সে আমার ফোনটা সরিয়েই বললো, “দেখ, সামনের ছেলেটা মেয়েটাকে মারছে।”
তাকায় দেখলাম বেশ গুড লুকিং একটা কাপল, ওয়েল ড্রেসড; রীতিমতো পশ যাকে বলে। ছেলেটা মেয়েটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় মেয়েটার মাথা আর গাল মিলায় কষে একটা থাপ্পড় মারলো। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলাম, থ মেরে গেলাম এক কথায়। এর মাঝেই তার থেকেও জোরে আরেকটা মারলো। আমরা এবার পিছে হাঁটা শুরু করলাম। অফিস ফেরত কিছু মানুষ তাদের দেখলো, পাশ কাটিয়ে গেলো, কিন্তু কেউ কিচ্ছু বললো না। ভাবলাম কিছু একটা তো বলা দরকার আসলে।
ফ্রেন্ড বললো, যা বল, তুই তো মেয়ে। ওরা এতো জোড়ে হাঁটছিলো যে ঠিক তাল মিলানো যাচ্ছিলো না। আমি দৌড় দিলাম এবার, পিছন থেকে ডাকলাম
-এক্সকিউজ মি! আমি দেখলাম আপনি ওনাকে মারছেন, আপনি জানেন না আপনি কাউকে ফিজিক্যালি এবিউজ করতে পারেন না? (বেশ এ্যাগ্রেসিভলি বলেছিলাম কথাগুলো, যেহেতু রেগে ছিলাম।)
সেই ভদ্র চেহারার অভদ্র ছেলেটা একটু থতমত খেয়ে গেলেন। বললেন,
-উনি আমার ওয়াইফ। আমরা বাসায়ই যাচ্ছিলাম কথা বলতে।
-ওয়াইফ হোক আর যেই হোক বাংলাদেশে যে নারী নির্যাতনের আইন আছে তা জানেন? যার আন্ডারে আপনাকে ফেলতে পারি!
-আপনি জানেন না সে কী করেছে। পুরোটা জানলে বলতেন না এভাবে।
আমার বন্ধুও তখন আমাদের কাছে পৌঁছে গেছে। এবার সে বললো,
-যেটাই হয়ে থাকুক, আপনি কারো গায়ে হাত তুলতে পারেন না।
আমাদের অবাক করে দিয়ে এবার সেই ভুক্তভোগী মেয়েটা বলে উঠলো
-আচ্ছা উনি আমার হাজব্যান্ড, আপনারা যান। বলে হাত টেনে নিয়ে গেলো।
মেয়েটা অবশ্যই কাঁদছিলো এবং থাপ্পড় খেয়ে তার মুখ লাল হয়ে ছিলো। তারা আরেকটু সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা শুরু করলো, আমরাও দাঁড়ালাম কিছুটা দূরত্ব রেখে। এবার অন্তত আরেকবার মারার সাহস পেলো না। আমাদের দেখে কিছুক্ষণ পর রিক্সা ডেকে উঠলো। যাওয়ার সময় শেষ কথা আমার বন্ধু বলেছিলো,
-Don’t do it bro.
সে এবারও বললো,
-সরি, বাট আপনি জানেন না ঘটনা কি।
এর আগে ছেলেটা মেয়েটার গলা চেপে ধরে মারছিলো, যেটা আমি দেখিনি, পরে শুনলাম।
আমি বলবো না যাকে বাঁচাতে গেলাম সেই উল্টা কথা বললো। মানুষের ভালো করতে নাই আ্যান্ড অল দ্যাট। হয়তো আরেকবার মারার আগে ছেলেটা একবার হলেও ভাববে আজকের কথা! হয়তো মেয়েটা পরে হলেও একবার ভাববে যে, তার গায়ে কেউ হাত তুলতে পারে না! আমাদের প্রোটেস্ট করা দেখেও হয়তো একদিন নিজে সাহস করে প্রোটেস্ট করবে।
কিন্তু এই শিক্ষিত আধুনিক শ্রেণীর দুইটা মানুষকে যে আজকে আমরা দেখলাম, যারা দামী জামাকাপড় পরে মেকাপ করে রাস্তায় বেরিয়েছে, অথচ মধ্যযুগীয় বর্বরের মতো বউ পেটাচ্ছে (যদিও আমার মনে হয় না তারা বিবাহিত) তারা আসলে কতোটা শিক্ষিত? যাদের মধ্যে এই ধারণাটাই নাই যে, ফিজিক্যালি তারা কাউকে এ্যবিউজ করতে পারে না এটা হিউম্যান রাইটস বহির্ভূত।
বার বার শুধু বলছে, ও আমার বউ ও আমার জামাই। আরে ভাই, আপনারা কি রাস্তায় দাঁড়ায় চুমু খাচ্ছিলেন যে আমি বাসায় যেয়ে খাইতে বলবো? ভায়োলেন্স একটা ক্রাইম, এই সাধারণ জ্ঞান নাই তাদের? ঐ মেয়ে যদি কারো সাথে পরকীয়াও করে এইখানে তাও আপনি তার গায়ে হাত তুলতে পারেন না। আপনি কারো গায়েই হাত তুলতে পারেন না, হোক সে আপনার পার্টনার আপনার বউ, গার্লফ্রেন্ড, বোন, কাজের মেয়ে অথবা রিক্সাওয়ালা, না হয় কোন কর্মচারী। এই অধিকার আপনার নাই। এই সিম্পল জিনিস আমরা কবে বুঝবো?
আধুনিকতা কি আসলে খোলসে নাকি অন্তরে?
মানবিকতার শিক্ষাই যারা পায়নি তারা আর কিসের শিক্ষিত?
আসুন আমরা শুধুই কাগজে কলমে শিক্ষিত না হই। আমরা শুধু আমাদের চোখগুলো ব্যাবহার করে তাকিয়ে না থাকি, সাথে মুখটাকেও ব্যবহার করি। আমরা মানবিক হই।