পেশীতে মেধার অবস্থান নয় পুরুষ! মেধা থাকে মস্তিষ্কে!

শেখ তাসলিমা মুন:

সম্প্রতি একজন পুলিশ কর্মকর্তা তার পেশাগত ক্ষমতা দেখিয়ে একজন নারীকে তুলে নিয়ে বিয়ে করেছেন বলে শিরোনাম দেখলাম। শিরোনাম দেখে বেশি পড়তে ইচ্ছে করলো না। ইচ্ছে করলো না, কারণ, এ ক্ষমতার দামামা আমি আমার সারা জীবন ধরে প্রত্যক্ষ করেছি। সরকারি বাহিনী খরচ করে যাত্রাদলের মেয়েকে তুলে নিয়ে রাতভর জুলুম করার গল্প খুব স্বাভাবিক দেখেছি। জনপ্রতিনিধিদেরা এ ফিল্ডে আরও এগিয়ে। তাদের ক্ষমতার বলি কম নারী নয়।
পুলিশ কর্মকর্তা তুলে এনে ‘বিবাহ’ করেছিলেন জানলাম। অনেকে এ ক্ষমতার বলি হয়ে ‘বিবাহ’ নয়, ‘রক্ষিতার’ আসনে অধীন হয়ে মর্মান্তিক জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। জোর যেখানে মাধ্যম, সেখানে ‘বিবাহ’ কোনো ‘মর্যাদা” নয়, একই রকমের অবমাননা, একই রকম দুঃসহ, দুঃস্বপ্ন।

ক্ষমতা শব্দটি পুরুষের পেশীতে পেশীতে বাস করে। আর রাষ্ট্রীয়, আইনগত, বিচারিক, প্রশাসনিক সকল ক্ষমতা পুরুষতান্ত্রিক পেশীতে। যার অবস্থান মেধায় নয়, বড় স্থুলভাবে পেশীতে। যা সেই প্রিমিটিভ সময়ের কথা বলে দেয়। বলে দেয় পৃথিবী বেশি দূর এগোয়নি। পেশী ও পেনিস এখনও নিয়ন্ত্রণ করছে রাষ্ট্র ও সমাজ।

পারিবারিক উদাহরণের আশ্রয় নেই।
আমার বড় খালাম্মা আমার মায়ের থেকে প্রায় পনেরো বছরের বড়। অনেককাল বেগম পত্রিকায় লিখে গেছেন। আমার নানা ছিলেন শিক্ষক। সেই সময়, বিভাগীয় শহর খুলনায় বাড়ি ভাড়া করে খালাম্মাকে Khulna Cornation Girls High School এ ভর্তি করতে বাধ্য হোন আমার নানা। তার পেছনে একটি বড় কারণ ছিল। সময়টি দেশ বিভাগের সময়ে। কিছুটা আগে খুব সম্ভব। যদি কেউ মনে করেন সে সময় ইভটিজার, উত্যক্তকারী উৎপীড়ক ছিল না সেটি একটি ভুল জানা। ছিল। তখনই ছিল। আমার খালাম্মা পালকি করে বাড়ি থেকে সামান্য দূরের স্কুলে যেতে শুরু করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এবং অপরূপ রূপসী। পালকিতে আব্রু থাকলেও তার রুপের খবর এলাকায় ছড়িয়ে গিয়েছিল। নানার বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব আসতেই থাকতো। পার্শ্ববর্তি গ্রাম থেকে ষণ্ডা মূর্খ কুস্তিগির পোলার শখ হলো এ অপরূপ রূপসী মেয়েকে বিবাহ করবেন। বাপের ৫০০ বিঘা জমি মাঠে, কুস্তির নৈপুণ্য দেখিয়ে বেড়ায় মানুষের কাঁধে চড়ে, তাহাদের ‘না’ করার ক্ষমতা কারও আছে? কিন্তু সে ক্ষমতা আমার নানা এবং বড় খালাম্মার হলো। এবার তারা হুমকি দিলো, খালাম্মা যখন স্কুলে যাবেন, তার পালকি শুদ্ধু অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হবে। আমার নানী এ খবর শুনে মূর্ছা যেতে থাকলেন। আমার স্কুল শিক্ষক নানা খুলনায় গিয়ে বাড়ি ভাড়া করলেন। সমস্ত পরিবার সেখানে বাস করতে লাগলো তাদের বাড়ির একটি মেয়ে সেখানে স্কুলে পড়বে বলে।

সময়টি মনে হয় ১৯৭৬। আমি মনে হয় ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমার ফুপু বিএ পড়ে। বাসায় বিচিত্রা আসতো। ফুপু বিচিত্রার একটি ফিচার ধারাবাহিকভাবে পড়তো আর কাঁদতো। মনে আছে সাড়া জাগিয়েছিল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নীহার বানু হত্যা। আমার ফুপু ‘নীহার আমার নীহার’ বলে একটি লেখাও লিখেছিল। ছাপা হয়নি। সে ঘটনাটি মনে অসম্ভব দাগ কেটেছিল। প্রেমের বলি। ‘না’ এর বলি। তাঁকে দল বেঁধে ক্যাম্পাস থেকে ‘তুলে’ নিয়ে শহরের একটি বাড়িতে তার শাড়ির আঁচলে গলা পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।

‘না’ নিতে না পারার বলি আমি নিজেও। গ্রীষ্মের ধু ধু দুপুরে হল থেকে আমাকে কল দিয়ে কমের পক্ষে ১৬ জন ষণ্ডা ঘিরে রেখে ভয় প্রদর্শন করতে থাকে এই আমাকে। ক্যাম্পাস থেকে তুলে নিয়ে যাবার ভয়ও দেখাতে থাকে। হল থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারলে কী জানি, হয়তো আরও একটি ‘নীহারবানু’ গল্প হতো সে সময়। মজার বিষয়, ঘটনাটি খুব ঘনিষ্ট ছাড়া কাউকে বলা যায়নি। এসব ক্ষেত্রে সকল দোষ মেয়েটির। সকল ঘটনা হজম করে যাওয়ার। একটি ২০ বছরের মেয়ের কাছ থেকে এর থেকে আর কী আশা করা যায়? ভয় আমিও পেয়েছিলাম। রাতের দুঃস্বপ্নে ঘুরে-ফিরে আসে আজও সে ভয়াবহ অনুভব।

সমসাময়িক সময়ে খুব কাছের বন্ধু, ক্যাম্পাসে এক ‘হ্যান্ডসাম গুণ্ডা’র ক্রমাগত ভীতি প্রদর্শনের মুখে জীবন-যাপন করে যেতে থাকলো। অপরাধ, সে দুবার ছেলেটির আমন্ত্রণে ক্লাসের ফাঁকে ডিপার্টমেন্টের সামনের চত্বরে বসেছে, বাদাম খেয়েছে, গল্প করেছে। ছেলেটি প্রেমের প্রস্তাব দিলে সে ‘না’ বলেছে। যুক্তি, ‘না’ বলবে, তাহলে আমার সাথে বসলে কেন? যখন সে বসেছে, তার মানে তাঁকে তার প্রেমে ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে। ‘হ্যাঁ’ না বললে তাঁকে ক্যাম্পাস থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। এ বিষয়টি পরে ক্যাম্পাসে মারামারি পর্যায়ে গড়িয়েছিল।

এ ‘না’ নিতে না পারার পেছনের কারণ ‘শক্তি’। ‘পেশী শক্তি’! আমার যেহেতু পেশী আছে, আমি যা চাইবো, তা আমাকে পেতে হবে। যুক্তি বলে নয়, পেশী বলে।

মূলত পেশী শক্তি বলে যা পেতে হয়, সে পাওয়া একটি দুর্বল পাওয়া। সে ‘পাওয়া’ আসলে হেরে যাওয়ার অপর নাম। একজন পালোয়ানের কাছে একজন মেধাবী পুরুষ যদি কম শক্তিশালী হতো, তাহলে পালোয়ানরাই দেশ চালাতো। আসলে পালোয়ান দিয়ে দেশ চলে না। বিষয়টি বুঝতে বেশী বুদ্ধি দরকার হয় না।

মেধা দিয়ে ফেইস করতে হবে, পেশী দিয়ে নয় – বিষয়টি পুরুষ ও পুরুষতন্ত্র যত তাড়াতাড়ি বুঝতে সক্ষম হবে তত পেশীর বড়াই ফিকে হয়ে আসবে। পেশী শক্তি দেখাতে লজ্জিত বোধ করবে। কারণ পেশী যদি ‘শক্তির উৎস’ হতো, তাহলে জঙ্গলের বুনো গণ্ডার, বুনো শুকোর তাদের থেকে শক্তিশালী হতো! এটি ভেবে দেখলে লজ্জায় তারা মাথা হেট করবে নিঃসন্দেহে।

মেধাই শক্তি। মেধা দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে, উত্তীর্ণ হতে হবে সকলকে। সকল ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত সবল এবং দুর্বল সকলের এ মেধা দিয়েই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মেধাজাত মানুষের কাজ। বারবার ভাবতে হবে, মেধা এবং মেধা আর সে মেধা পেশীতে নয়, থাকে মস্তিষ্কের একটি ছোট্ট কোটরে!

শেয়ার করুন: