পুরুষতন্ত্রের শেকড় কোথায়?

আফরোজা চৈতী:

আমি নারীবাদী। কারণ আমি নারীর প্রতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক, ধর্মীয় অনাচার অত্যাচারের বিপক্ষে। আসলে কেন নারীর প্রতি এতো নিপীড়ন সেই প্রাচীন কাল থেকেই? কেন জমি গরু ফসলের মতো নারীও অনেক দামী ছিলো? এর সম্ভবত একটাই কারণ, আর তা হলো, নারী জমির মতোই উর্বরা, মাটির মতোই সে সন্তান উৎপাদন করে তার দেহে। আর তার এই উৎপাদন ক্ষমতাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। পুরুষের ভেতর ভয় ঢুকে গেলো নিজের অস্তিত্ব নিয়ে, কেননা এই উর্বরতা তার নেই। সে চাইলেও তার শরীরকে শস্যক্ষেত্র রুপে পাবে না। সে শুধু বীজ বপন করতে পারে, কিন্তু মানববৃক্ষ বেড়ে উঠে নারীর দেহে।

আর একটি বিষয়েও তারা নারীর কাছে হারতো, সেটা হলো উপস্থিত বুদ্ধি ও নারীর সাংগঠনিক ক্ষমতা। কোন খাবারে কী পুষ্টি বা কোন ফলে কোন রোগের ঔষধ, এটা প্রাচীন কালে নারীই সবচেয়ে ভালো জানতো। পুরুষ শুধু তার পেশীর চর্চাই করে গেছে, আর নারী একই সাথে সন্তান পালন, আহার সংস্থান, কৃষিকাজ অথবা অসুখ বিসুখে টোটকা বা ঔষধিজ্ঞান এই সবই সে একসাথে করে গেছে।

নারী ভার্সাটাইল গুণের অধিকারী। আর একটা বিষয় সে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে ছিলো আর তা হলো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। নারীর ইনট্যুইশন পাওয়ার পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি। যে কোনো বিপদ সে আগে থেকেই টের পেয়ে যেতো। গোষ্ঠীর কারো রোগবালাই এর মহৌষধ এর খোঁজ ঐ গোষ্ঠীর নারীটিই জানতো। তবে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় পুরুষ সেদিন থেকে ভুগতে শুরু করলো, যেদিন সে বুঝতে পারলো একমাত্র মা ছাড়া তার সন্তানের আসল পিতার পরিচয় কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয়! এই বিষয়টা ধূর্ত পুরুষকে ভাবিয়ে তুললো। সে নিশ্চিত হতে চাইলো তার পিতৃত্বের সত্যতা নিয়ে। আর শুধুমাত্র এটাকে নিশ্চিত করতেই সে নারীর নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইলো। তাদেরকে সন্তান ও গৃহের দায়িত্ব এককভাবে দেয়া হলো। নারীর জন্য ঘর আর পুরুষের জন্য শিকার নির্ধারিত হলো। আর তখনই সবচেয়ে বড় রাজনীতির সূচনা হলো।

নারীকে শুধু গৃহের কাজে ব্যস্ত রাখা নয়, বরং তার চলাফেরা উঠাবসা শোয়া সবকিছুর উপরই নিয়ন্ত্রণ আনা হলো।একজন পুরুষ একাধিক নারীকে তাদের সঙ্গিনী করার ক্ষমতা প্রাপ্ত হলেও নারীর জন্য সেটি নিষিদ্ধ হলো। এর কারণ একটিই, আর তা হলো সন্তানের পিতা কে এটা নারী নির্ধারণ না করে দিলে সেটা জানার ক্ষমতা পুরুষের নেই। একটি পুরুষ যেমন একাধিক নারী সঙ্গ লাভে তুষ্ট হয়, তেমনি বোধ একটি নারীরও থাকতে পারে, কিন্তু সমাজ, ধর্ম, পরিবার পুরুষের বহুগামিতাকে স্বীকৃতি দিলেও নারীর বহুগামিতাকে দেখেছে ব্যাভিচার হিসেবেই। আর এই সব শৃংখল এর পিছনে একটা বিষয়ই পুরুষকে তাড়িত করেছে, তা হলো নিজের পিতৃত্ব নিয়ে পুরুষের নিরাপত্তাহীনতা। আর তাই তার এই নিরাপত্তাহীনতা ঘুচাতেই একটার পর একটা বিধিনিষেধ দিয়ে নারীর পদচারণাকে করেছে শৃংখলিত।

রজঃস্বলা নারীকে অশুচি জ্ঞান করা হয়েছে। যে বিশেষ ক্ষমতার বলে নারী তার ভেতরে ধারণ করে আরেকটি প্রাণকে, নারীর সেই ক্ষমতাকে আমার মনে হয় সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে মঙ্গলময়। যে প্রসব বেদনা সে অনুভব করে সন্তান জন্মদানে, সেই ব্যথার কিঞ্চিত ভার প্রতি মাসেই নারীকে বহন করতে হয় তার ঋতুস্রাবের সময়ে। নারীর সেই ক্ষমতাকে খাটো করে দেখার বা গোপন করে অপরাধীর মতো নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার কোনও কারণ আমি দেখি না।

একজন নারী যখন ধর্ষিত হোন, তখন তার উপর হওয়া সেই অনাচার বা অন্যায় এর প্রতিকারের চেয়েও বড় হয়ে উঠে নারীর চরিত্র, নারীর পোশাক। এই মানসিকতা শুধু পুরুষ লালন করেন তা নয়, বরং এই একই ধারণা পোষণ করেন অনেক নারীও। এটা নারী বা পুরুষের দোষ নয়, বরং হাজার বছর ধরে চলে আসা নারীর প্রতি হওয়া অন্যায় অত্যাচার আর শোষণ নিপীড়নের একটি ধারা, যা আজও বহমান। আর এই নিপীড়নের শুরু পুরুষের সেই হীনমন্যতা বোধ থেকেই যে, সে যত বড় ক্ষমতাবান আর প্রভাবশালী ভাবুন না কেন এই একটি বিষয়েই সে বড় অসহায়!

নারী না চাইলে তার সন্তান যে তারই ঔরসজাত এটা সে নিশ্চিত হতে পারবে না। আর তাই নারী দুর্বল, অবলা, বোকা, আবেগতাড়িত এই জন্য সে নির্যাতিত হয়েছে বিষয়টা তেমন নয়, বরং চতুর পুরুষ বরাবরই ভয় পেয়ে এসেছে নারীর উর্বর শরীরকে, নারীর গার্হস্থ্য জ্ঞান ও উপস্থিত বুদ্ধিকে।

আজ এতো বছর পরও পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে প্রতিটা ক্ষেত্রেই নারীর জ্ঞান ও সৃজনশীলতাকে পুরুষ ঈর্ষা করে, তার প্রভু হয়ে উঠার পথে বাঁধা বলে মনে করে, কখনও নিজের অপারগতার পথে তার সঙ্গিনী নারীকেই দায়ী বলে মনে করে। এটা আর কিছুই নয়, তার হীনমন্যতা আর নিজের প্রতি নিজেরই এক সামাজিক চাপ যে তুমি পুরুষ, তুমি শ্রেষ্ঠ। তুমি পুরুষ তাই নারীর ভরণপোষণ তুমিই দেবে, তুমিই নির্ধারণ করবে তোমার স্ত্রীর ভবিষ্যত, তুমিই হবে জ্ঞানে কর্মে শ্রেষ্ঠ পুরুষ।আর তার এই শ্রেষ্ঠ হওয়ার পথে পুরুষ বরাবরই নারীকেই ভেবেছে সবচেয়ে বড় বাঁধা। আর তাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র নারীকে অবদমনের জন্য সোচ্চার থেকেছে। কেটে নেয়া হয়েছে খনার জিহবা, রাণী পদ্মাবতীকে দিতে হয়েছে আগুনে আত্মাহুতি নিজের সম্মান রক্ষায়! কে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এই অবদমন আর নিপীড়নের রাজনীতিতে? নারী?

খুব অবাক শোনাবে, কিন্তু এটাই সত্যি যে এই রাজনীতির ফলে ভয়ংকরভাবে হেরে গেছে পুরুষ নিজেই। পুরুষতান্ত্রিকতার যে শৃংখল এর বলয় তৈরি হয়েছে হাজার বছর ধরে তার শেকলে বাঁধা পড়েছে পুরুষ নিজেই। প্রতিদ্বন্দ্বী আর ক্ষমতার বিচারে এখনও পুরুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়ার জীবাণু বিদ্যমান। শ্রেষ্ঠ তাকেই হতে হবে সেটা যেভাবেই হোক, এটাই তার ধর্ম। তার কান্না আসলেও তাকে সেই কান্না অবদমন করে চলতে হবে, সৃজনশীলতার সুক্ষ্মবোধের চেয়ে মোটাদাগের পেশিশক্তির পুরুষালী আচরণই তার কাছ থেকে কাম্য। সে চাইলেও তাকে অবদমন করতে হয় তার মানবিক বোধের অনেক সুকুমার ভাবনা। চাইলেও দু’দণ্ড বসে জিরোনোর সময় তার নেই। তাকে যে কর্তৃত্ব চালাতেই হবে! সে যে পুরুষ, প্রভু! তার প্রভুত্ব টিকিয়ে রাখতে গেলে তার তো রাজনীতি না করে উপায় নেই!

অথচ এই প্রভুগিরি না ফলিয়ে পুরুষ যদি তার হাসিখেলার সাথী করে চলতো তার সাথের নারীকে, তবে সে নিজেও বেঁচে যেতো এই অসমপুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনেক ফাঁদ থেকে। সমতাপূর্ণ এক বিশ্ব তখন নারী পুরুষের সম্মিলিত শক্তিতে এক সত্যিকার এর মানবিক বিশ্ব হয়ে উঠতো।

শেয়ার করুন: