পুরুষতন্ত্র আমাদের মগজে

সাবরিনা স. সেঁজুতি:

সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে আজকাল সবাই কম-বেশি লেখালেখি করে। পত্রিকায় লেখার বিষয়টাও আজ খুব খেলো, ব্লগার হবার তো সুযোগই নেই, পাছে বাচ্চাটা আমার এতিম হবে নাকি? তাই আমার আর লিখতে ইচ্ছে করে না, মনে হয় লিখে আর কী ই বা হবে! পরিবর্তন যখন এতদিনেও আসে নি আর আসবারও নয়। মেয়েরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন চায় না। পুরুষতন্ত্র এদের মগজে ঢুকে গেছে। যে ভুক্তভোগী সেও চায় না, যে ভুগেনি সেও চায় না।

যে ভুগেনি তার না চাওয়াটা স্পষ্ট। আর ভুক্তভোগীরা চায় না, কারণ পাছে লোকে মন্দ বলে, তাই নাম প্রকশে অনিচ্ছুক। হয়তো তাদের জায়গায় থাকলে আমিও তাই করতাম। এ সমাজ নির্যাতিতার পরিচয় লাভে যতোটা আমোদিত হয়, নির্যাতনকারীর নাম-ধাম জেনে ততোটাই হতাশ হয়। মনে মনে ভাবে, “ধুর শালা, ঐ ব্যাটায় পারলো, আমি বইয়া বইয়া বা.. ছিঁড়লাম”। তাই ভুক্তভোগী নারীরা নিজেদের অভিজ্ঞতা বা নাম-ধাম প্রকাশ না করে নিশ্চুপ থাকার যে পন্থা অবলম্বন করেন, তা একদম ফেলে দেয়া যায় না।

পুরুষতন্ত্র মাথায় ঠুকে যাওয়া পুরুষ কিংবা নারী দু’দলই ভুক্তভোগীগণ কতটা ভুগলেন তা জেনে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলে।
তবে আজ হঠাৎ করে লিখতে বসার স্পৃহা মোটেও কে নাম প্রকাশ করছেন আর কে করছেন না বা কারো আত্মতৃপ্তি লাভের প্রয়াসকে সুপ্রসারিত করা নয়। আমি ভাবছি, বর্ণবাদের চেয়েও ভয়ংকর যে অসুখে ভুগছে এ সমাজ, তা নিয়ে, সেটা হলো সেক্সিসম, বাংলায় কি একে লিংগবাদ বলা যায়? জানি না।

যাই হোক, সেক্সিজমের মূল লক্ষ্যই হলো সমাজের একদল জনগোষ্ঠীকে অকেজো করে রাখা। এটা কি শুধুই জাতীয় সমস্যা নাকি আন্তর্জাতিক? ভেবে দেখেছেন কি একটি দেশ বা সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী যদি পিছিয়ে পড়ে, তবে ঐ দেশের বাকি অর্ধেককে কতোটা এগিয়ে যেতে হবে যাতে পুরো জাতিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়? সে হিসেবে আমার দেশ পেছনের দিকে হাঁটাই বাঞ্ছনীয়।

আমাদের সমাজের পুরুষতন্ত্রকে মগজে লালন করা পুরুষ কিংবা নারীগণ যে অর্ধেক জনগোষ্ঠির অভাব পূরণ করার মতো উন্নয়ন সাধন করেন নাই, সে বিষয়ে মনে হয় দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ নাই ।
কিন্তু যারা এই সকল বাধা বিপত্তি পেরিয়ে পুরুষতন্ত্রের আজগুবি নিয়ম-নীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে উন্নয়নের পথে পা রাখছেন, তাদের পথটা কতটা সুগম? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যোগ্য নারীর ভয়ে অযোগ্যরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হাজির হোন। যোগ্য নারীর বড় দোষ সে যোগ্য তার জ্ঞানে, কর্মে, গুণে আর সাথে যদি রূপ থাকে কিংবা নাই থাকে তার চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ করতে পুরুষতন্ত্রকে মাথায় পোষা মানুষগুলোর এতোটুকু ভাবতে হয় না।

দুশ্চিন্তার বিষয় হলো পুরুষতন্ত্রকে মাথায় পোষা নারীদের নিয়ে, তারা অযোগ্য সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই, তাদের পোষেন একদল পুরুষ, যারা পুরুষতন্ত্রের পূজারী, এই নারীদের ব্যবহার করা হয় সেক্সিজমের হাতিয়ার হিসেবে। যেখানে নারী হিসেবে বিশেষ সিম্প্যাথি পাবার অবকাশ আছে সেখানেই এদের ব্যবহার করা হয়। হতে পারে কাউকে শায়েস্তা করা দরকার তখন এদের ব্যবহার করা যেতে পারে। টার্গেট যদি পুরুষ হয়, তবে যৌন হয়রানী টাইপ কোনো অজুহাতে, আর টার্গেট যদি নারী হয়, তবে কুৎসা রটিয়ে। এক নারীর কুৎসা অন্য নারীর মুখে শুনতে, আহা কী-ই না ভালো লাগে!

পুরুষের পোষা এই নারীগণ যে কেবল ঘরের বাইরেই জীবাণু ছড়াচ্ছেন তা নয়, এরা পরিবারেও বিশেষ দায়িত্ব পালন করে আসছেন যুগ যুগ ধরে। তাই যদি না হবে, তবে বউ শাশুড়ির ঝামেলার উৎস স্থল কোথায়? পরিবারের হর্তাকর্তা সবসময়ই পুরুষ, আর তাইতো তিনিই নির্ধারণ করেন তার হাতিয়ার কোথায়-কিভাবে ব্যবহার করবেন!

অযোগ্য নারী তার আত্মা বিক্রি করেছে পুরুষতন্ত্রের কাছে। সুখের আশায়। যোগ্যদের সাথে টিকে থাকার খেলায় এটাই একমাত্র পথ। সমাজ আর রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে যোগ্যদের কাজে লাগাতে। আইন করে অনিয়ম দূর করতে। তাই নারীর কপালে শুধুই ঝাঁটার বাড়ি অবশিষ্ট। যে দুয়েকজন নারী বাধা বিপত্তি পেরিয়ে পা বাড়িয়েছিলেন আলোর পথে, তাদের পথও সুদুর প্রসারি।
শেষ করার আগে সকল সেবাদাসীদের উদ্দেশ্যে মল্লিকা সেনগুপ্তের লেখা আমার পছন্দের কবিতার কিছু অংশ।

দ্রাবিড় যে মেয়ে এসে গম বোনা শুরু করেছিল আর্য পুরুষের ক্ষেতে,
যে লালন করেছিল শিশু সে যদি শ্রমিক নয়
শ্রম কাকে বলে?
আপনি বলুন মার্কস, কে শ্রমিক, কে শ্রমিক নয়, নতুন যন্ত্রের যারা
মাস মাইনের কারিগর শুধু তারা শ্রম করে
/ ……………
গৃহশ্রমে মজুরী হয় না বলে মেয়েগুলি শুধু বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে
আর কমরেড শুধু যার হাতে
কাস্তে হাতুড়ি !…………কখন বিপ্লব হলে
পৃথিবী স্বর্গরাজ্য হবে
শ্রেণীহীন রাষ্ট্রহীন আলো পৃথিবীর সেই দেশে
আপনি বলুন মার্কস,
মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী হবে?

হ্যাঁ তাই, নারী আজীবন সেবাদাসী ছিল, তাই-ই আছে। কখনো ঘরে কিংবা আধুনিক যুগে ঘরের বাইরেও। তাই হাটে, বাজারে, শিক্ষাক্ষেত্রে কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারী দেখলেই আহ্লাদে আহ্লাদিত হবেন না কিংবা চট করে মুখ ঘুরিয়ে নেবেন না, পর্দার আড়ালে সে আপনার বন্ধু কিংবা শত্রুও হতে পারে। সে কারো হাতিয়ার কিংবা ভুক্তভোগী, কিংবা কে জানে, হয়তো একাধারে দুটোই।

শেয়ার করুন: