সারা বুশরা দ্যুতি:
ছয় বছর ধরে নিজেদের প্রেম লুকিয়ে আসছিলো আদ্রিতা ও যারাফ। আদ্রিতার বাসা থেকে যখন বিয়ের জন্য প্রচণ্ড চাপ আসা শুরু হলো, তখন আদ্রিতা বুঝলো, এবার না বলে আর উপায় নেই…সে বলতে বাধ্য হলো এবং যা আশংকা করেছিল, ঠিক সেটাই হলো…তার মা, বোন, খালারা পরিবারের সবাই বেঁকে বসলো।
…কিছুতেই তারা যারাফের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি না.. তাদের যুক্তি হলো ছেলে মেয়ে সহপাঠী, দুজনের বয়স সমান। সমবয়সীর বিয়ে ঠিক না… মেয়েটা আগে আগে বুড়ি হয়ে যাবে, ছেলে তখনও জোয়ান থাকবে। বৌ এর প্রতি একসময় তার মন উঠে যাবে, অন্য মেয়ের দিকে নজর পড়বে, সংসার টেকানো মুশকিল হবে। তারা জেনে শুনে এরকম রিস্কি ম্যারেজ করতে মেয়েকে কিছুতেই এলাও করতে পারেন না..
আদ্রিতা বলার সময় খুব কাঁদছিলো। আমাকে বললো, তোমার কাছে কি কোনো কঠিন বা অভেদ্য যুক্তি আছে আপু, যা দিয়ে আমি বাসার সবাইকে চুপ করিয়ে এই বিয়ের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে পারি? সেই সাথে অনেক করে অনুরোধও করলো যেন ওর বোন, মাকে আমি বোঝাই। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। মনে মনে ভাবলাম, আমার কাছে সত্যি কি কোনো যুক্তি আছে যা দিয়ে আমি আদ্রিতার সুশিক্ষিতা, কর্মজীবী ও আধুনিকা মা এবং বড়ো বোনকে বুঝিয়ে তাদের মন টলাতে পারি? নাহ… সেরকম পয়েন্ট আমার কাছে নেই…আমার যা আছে, তা হলো, এই গোটা মানসিকতারটার প্রতি বিদ্বেষ। আছে অনেকগুলো প্রশ্ন। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং সেই শিক্ষার বলে বলীয়ান স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত আমাদের মা-বোনেরা এই ২০১৮ তে এসেও কেন এরকম আদিকালের ধারণা পোষণ করেন, সেই বিস্ময়ের ঘোরটাই আমি যেন কাটিয়ে উঠতে পারি না।
কাকে কী বোঝাবো আমি? কী বলবো?
একটি মেয়ের ২৫ বছর হওয়া মানে তার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু একটি ছেলের ২৫ মানে সে এখনো ছোট…একটি মেয়ের ৩০ মানে সে বুড়ি হয়ে গেছে, অথচ একটি ছেলে ৩০ মানে সে তরুণ থেকে যুবক হলো মাত্র।
…একটি মেয়ে মা হওয়া মাত্র সে একজন মহিলা, কিন্তু একটি ছেলে বাবা হবার পরও সে ছেলে বা যুবকই থাকে। কী অদ্ভুত, কী হাস্যকর আমাদের সমাজের লোকেদের ধ্যান ধারণা। আমার সত্যি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আমরা এখনো, এতো লেখাপড়া শিখেও এসব মানসিকতা ঝেড়ে ফেলতে পারিনি।
.. এগুলো আমরা পরম যত্নে লালন করে যাচ্ছি।
..বলার সময় নিজেদের আধুনিক বলি, অথচ এরকম মনোভাব পোষণ করতে কুন্ঠাবোধ করি না।.. এতো কন্ট্রাডিক্টরি কেন আমাদের স্বভাব?
কিছুদিন আগে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমাদের সবার এখন ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে। আমাদের সব বন্ধুদের বাচ্চাগুলোর বয়সও কাছাকাছি। কারো বয়স দুই বছর, কারো তিন এরকম মিলিয়ে। আমাদের আড্ডার মধ্যেই আমরা যার যার বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছি, ঘুম পড়াচ্ছি, কান্না থামাচ্ছি। সেইসাথে নিজেদের গল্পগুলো সমানতালে জারি রাখছি।
হঠাৎ একজনের স্বামী বলে উঠলো, ‘কয়েক বছর আগেও তোমাদের একসাথে দেখতে দারুণ লাগতো, একঝাঁক স্টাইলিশ সুন্দরী তরুণী মেয়ে হাসাহাসি করছে, কী মনোরম দৃশ্য! আর এখন দেখ, বাচ্চা কোলে নিয়ে সব মহিলা হয়ে বসে আছো। আমাদের দিকে তাকাও, আমরা এখনও যদি একা কোথাও যাই, লোকে ব্যাচেলর ভাববে, আমরা এখনো তরুণ’।
কথাটা ঠাট্টা করেই বলা, কিন্তু আমার কানে কট করে লাগলো। একটি সন্তানের বাবা হবার পরও যদি একজন পুরুষ নিজেকে একজন ব্যাচেলর এর মতো ইয়ং, ফ্রেশ আর আকর্ষণীয় মনে করতে পারে, তাহলে একটি মেয়ে কেন পারবে না? মা হয়ে গেছে দেখে তার জন্য কি অন্য সব কিছু হারাম হয়ে গেছে? কোন অলিখিত নিয়মে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে বাধ্য?
একটি মেয়ে বিবাহিত, এক বাচ্চার মা এবং বয়স ত্রিশের ঘরে মানে সে একজন মহিলা, প্রায় ”আন্টি”টাইপ। আর একটি পুরুষ ত্রিশের ঘরে যার বয়স, যে নিজেও বিবাহিত এবং সন্তানের পিতা, অথচ সে তখনও ছেলে, তাকে ‘লোক’ হিসেবে অভিহিত করা যেন বিরাট কোনো পাপ!
খুব দুঃখের সাথে বলছি, এই থার্ড ক্লাস ধারণাগুলো ভাঙার জন্য মেয়েরা একেবারেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে না.. এযুগের মেয়ে হয়েও তারা সেই দাদি নানীদের মতনই বলে, ‘পুরুষের আবার বয়স কী? বাচ্চা হওয়ার পর আমাদের শরীর নষ্ট হয়, ওদের তো এসব ঝামেলা নেই’।
একটি সন্তান জন্ম দিয়ে মেয়েদের শারীরিক যে পরিবর্তন আসে, খুব কম মেয়েই সেটা এড়াতে পারে। তবে আজকাল মেয়েরা অনেক সচেতন। তারা নিজদের কেয়ার করা শিখেছে। মা হয়ে গেছে তাই শরীর শেষ, রূপ যৌবন ঝরে গেলো, বুড়ি হয়ে গেলো এসব গেঁয়ো কথা এযুগের মেয়েদের মুখে মানায় না। অধিকাংশ মেয়েই দীর্ঘশাস ফেলে যদি ভাবতে বসে, আর কত? বয়স তো হলো আমার!
তাদের বলি, ত্রিশেই বয়স? সত্যি এটা ২০১৮ তো? আমার মাঝে মঝে মনে হয়, মেয়েরা নিজেরা যদি নিজেদের এভাবে ছোট করা আর পুরুষদের মহান করে তাদেরকে সবকিছুর জন্য ছুট দিয়ে রাখা বন্ধ না করলে তাদের একসময় নিজের সমবয়সী পুরুষের মুখ থেকেও আন্টি বা খালা ডাক শুনতে হবে…কে জানে তাতেও বোধ করি তাদের আপত্তি হবে না। কিন্তু আমার আপত্তি আছে… আমি শুধু মুখে নিজেকে প্রগতিশীল বলি না, আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, বয়সে কিছুই এসে যায় না। সবকিছুর মূলে রয়েছে মন-মানসিকতা ও নিজের প্রতি বিশ্বাস।
বিয়ে হওয়া বা সন্তান হওয়ার সাথে মনের বয়সের কোনো সম্পর্ক নেই… যদি থেকে থাকে তাহলে সেটা পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্রে সমান হওয়া উচিত। একটা মেয়ে তো বিশ বছরেও মা হতে পারে। কেন সমাজ তার মনটা বুঝবে না? কেন শুধু মাত্র মা হয়ে গেছে দেখেই তার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়ে যাবে? কবে মানুষ বুঝতে শিখবে যে মা হলেই কোনও মেয়ের মনের সব দরজা বন্ধ হয়ে যায় না, বা সে খালাম্মা শ্রেণীতে চলে যায় না।
একটি মেয়ে বিবাহিত, সন্তানের মা অথবা বয়স ত্রিশ, তার মানে এই নয় যে সেই মুহূর্তে তার সারা জীবনের অভ্যাস, আচার আচরণ, ধ্যান ধারণা, পছন্দ অপছন্দ, ইচ্ছে ও স্বপ্ন সব ত্যাগ করে সে মাদার তেরেসা বনে যাবে। মানুষ হিসেবে মেয়েটি কিন্তু আগের মতই থাকে এবং তার আশে পাশের মানুষের কাছেও সেই আগের মতই ট্রিটমেন্ট আশা করে… অসংবেদনশীল পুরুষদের কথা বাদই দিলাম, ক্ষোভ হয় এই ভেবে যে, যখন সো কলড প্রগতিশীল নারীরা এসব দেখেও ইচ্ছে করে চোখ বুঁজে থাকেন।
আই উইশ সবাইকে বোঝানো যেত যে শুধু ফেসবুকিং করতে পারাটাই আধুনিকতা নয়… মন আর মাথাটাও একটু খোলা, একটু উন্নত আর একটু পরিষ্কার রাখতে পারাই সত্যিকার আধুনিকতা… জীবনটা এমনি অনেক ছোট, তার উপর মনও যদি এমন সংকীর্ণ হয়, তাহলে আর মানুষ শান্তি পেলো কিসের? রূপ, যৌবন যদি এতই ক্ষণিকের হতো তাহলে একজন জয়া আহসানের চল্লিশ বছর বয়সে নতুন করে কমার্শিয়াল সিনেমার নায়িকা হতে পারতেন না… বয়সকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য গুন লাগে, যোগ্যতা লাগে, আর লাগে আত্মবিশ্বাস। যার এই তিনটি জিনিস আছে তাকে রূপ, সৌন্দর্য এবং যৌবন কখনো ছেড়ে যায় না…যে নিজের আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে পারে, সে তার বয়স এবং রূপও বহুদিন ধরে রাখতে পারে। প্রতিটা নারী যদি নিজেকে নিয়ে এভাবে ভাবতে পারতো, তাহলে আর আমাদের সমাজের খোকাবেশী বুড়োরা নিজেদের সমবয়সী মেয়েদের আন্টি ভাবার দু;সাহস করতো না।
লাস্ট বাট নট দ্যা লিসট, একটি পুরুষের মন হলো মুক্ত বিহঙ্গ, আর মহিলার মন তালাবন্ধ সিন্ধুক এই হিসেব যারা করেছে তাদের প্রতি আমার বক্তব্য খুবই পরিষ্কার। আর সেটি হলো, বৌয়ের বয়স আমার সমান তাই অন্য নারীতে আসক্ত হওয়া যদি স্বাভাবিক হয়, তবে স্বামীর বয়স আমার সমান সেই কারণে অন্য পুরুষে আকৃষ্ট হওয়াটাও খুবই স্বাভাবিক। মনের কোনো বয়স থাকে না। সে তো যেকোনো সময় যে কারো প্রতি দুর্বল হতে পারে।
যারা রুচিবান, সত্যিকার অর্থে ভদ্র, শিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত তারা নারী পুরুষ নির্বিশেষে কখনোই বিবাহ বহির্ভূত অন্য কোনো সম্পর্ক স্থাপনের কথা চিন্তা করবে না… মনে এধরনের আবেগ বা ভাবনা এলেও তারা তাদের বুদ্ধিমত্তা ও বিবেক কাজে লাগিয়ে চিন্তা করবে এবং যা সকলের জন্য কল্যাণকর সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিবে। তাই এখানে স্বামী বয়সে বড় না স্ত্রী, নাকি দুজনের বয়স সমান, এগুলো সত্যিকার অর্থেই ম্যাটার করে না।
একজন পুরুষ যদি ৪৫ বছর বয়সে একটি ২০ বছরের মেয়ের প্রেমে পড়তে পারে, তাহলে একজন মহিলাও পারে। বিয়ে দেয়ার সময় যদি মেয়েপক্ষ এই দু:শ্চিন্তা করে, বয়স সমান, ছেলে যদি কিছুদিন পরে অন্য মেয়ের প্রেমে পড়ে তখন আমার মেয়ের কী হবে.. .তাহলে ছেলেপক্ষেরও এই ভয় পাওয়া উচিত যে মেয়ে এতো কোয়ালিফায়েড, আমাদের ছেলের থেকেও বেশি স্টাব্লিশড কোনো ছেলের জন্য আমার ছেলেকে ছেড়ে চলে যায়, তখন আমাদের ছেলের কী হবে? তাই নয় কি? লজিক্যালি এভাবেই তো ভাবা উচিত!
কিন্তু আমরা লজিক দিয়ে কখনোই কিছু ভাবি না। আমাদের পড়াশোনা, আধুনিকতা সবকিছু ওই মুখে মুখেই, ধারণাগুলো এখনো সনাতনই রয়ে গেছে। তাই এ সমাজে বাবুরা বুড়ো হয়েও খোকা সেজে অবাধে ঘুরে বেড়ান। অতীতেও তাই বেড়িয়েছেন, এবং ভবিষ্যতেও উনারা খোকাবাবুর মূর্তি ধারণ করেই আমাদের আশেপাশে বিচরণ করবেন। যতদিন না মেয়েরা ঘুরে দাঁড়াবে, নিজেদের সম্পর্কে ২৫ বছর বয়স থেকেই, বুড়ি, মহিলা, বয়স হয়ে গেলো এইসব বলা বন্ধ না করবে, ততদিন এমনি চলতে থাকবে।
আদ্রিতার ও যারাফের মতো আরো বহু এমন প্রেমিক যুগলকে নিজেদের পরিবারের সাথে লড়তে হবে, মনের সুখ শান্তি সব নষ্ট করে বিনিদ্র রজনী পার করতে হবে চোখের জলে ভিজিয়ে …
Sara Bushra Dooty
Bedfordshire, United Kingdom