মাতৃত্ব যখন কাঠগড়ায় (পর্ব-২)

সুদীপ্তা ভট্টাচার্য্য রুমকি:

নির্যাতন যেখানে মুখ্য উদ্দেশ্য হয় সেখানে সন্তান আসলে অছিলা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এ কারণেই জন্মের দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় মায়ের দোষত্রুটি অন্বেষণ। পান থেকে চুন খসার আগেই প্রতিনিয়ত মাকে দাঁড়াতে হয় আসামীর কাঠগড়ায়। অথচ কোনো মেয়েই মা হয়ে জন্মায় না, নিজে সন্তানের জন্ম দিয়ে মা হয়।

একটি শিশুর যেদিন জন্ম হয়, সেদিন শুধু তার মা-ই তাকে জন্ম দেয় না, শিশুটিও তার জন্মদাত্রীর ভিতর মাতৃত্বের জন্ম দেয়। অপ্রিয় হলেও সত্য যে সদ্যোজাত একটা শিশুর জন্য তার মা-ই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তাকে স্বাভাবিক রাখার জন্য তার মায়ের উপস্থিতি, সান্নিধ্য, স্পর্শই যথেষ্ট।

ছোট্ট একটা মানুষ, কিছুই যখন বোঝার ক্ষমতা তার থাকে না, তখনও সে তার মাকে চেনে, মাকে বোঝে, মাকে ভালবাসে। পৃথিবীর সবচেয়ে মোহনীয়, অকৃত্রিম ও ঐশ্বরিক দৃশ্য বোধ হয় এটিই। কীভাবে মানুষ অমানুষের মতো সেই মাকেই সন্তানের ভালোমন্দ সবকিছুর জন্য দায়ী করে, আমি বুঝি না। একজন মাকে ক্রমাগত মানসিক চাপযুক্ত রাখা, প্রতিনিয়ত জনসম্মুখে বা অলক্ষ্যে অপদস্থ করার মতো পরিবারের মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তাদের কাছে সন্তানের সুস্থ-সবলভাবে বেড়ে উঠার জন্য সহায়তা প্রত্যাশা করাটা আসলে কতোটা যৌক্তিক?

মেয়েটির নামটা না হয় থাক।

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে তার শ্বশুর বাড়ি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের হলেও তবুও মেনে নেয়া যেতো, কিন্তু আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দোরগোড়ায় রেখে সেই বাড়িতে চোখ থাকতেও অন্ধ সেজে হাতড়ানোটা কোনো দোষ মনে না করা হলেও দোষ মনে করা হতো বাড়ির বউটির জেনেশুনে কিছু বলাকে। তাই কোনো বিষয়ে বিন্দুসম সঠিক জ্ঞান থাকুক আর না থাকুক, নিজের ইচ্ছামতো পরিবারের সন্তানটিকে গিনিপিগ বানিয়ে তার উপর বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হতো অবলীলায়। সেখানে একজন মায়ের কিছু বলার কোনো অধিকার ছিল না। কারণ মা’টি তো সন্তানের ভালো চায় না, আর সবাই যেভাবে চায়।

নিম্নবিত্ত নয়, অর্থ-বিত্তসম্পন্ন তথাকথিত সভ্য পরিবারই ছিল সেটি, অথচ সন্তান কোলে নিয়ে বাসায় ঢোকার আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল “আর কেউ যেন বাচ্চা জন্ম দেয় নাই, ইনিই দিছেন। আর কারো তো সিজার হয় নাই, উনারই হইসে। এতোই যখন ননীর পুতুল, বাপমায়ের ঘরে থাইক্কা গেলা না ক্যান? আমার ঘরে ন্যাকামি চলবো না কইয়া দিলাম। মাথা ঘোরায়, ঘুম হয় নাই, আল্লাদের আর জায়গা নাই। বুঝি না বোধ হয় এক্টিং। সব বইয়া খাওনের ফন্দি”।

শাশুড়ি অবশ্য প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, “বাচ্চা নিয়ে তুমি ২১ দিন গেস্ট রুমে থাকবে। একটা চকিতে বিছানা করে দিব, পুরনো যা ফেলে দেয়ার মতো জিনিস দিয়ে। কারণ তুমি আঁতুড় ঘরে যাই ব্যবহার করবে, সবই ফেলে দিতে হবে। দুইটা পুরনো ম্যাক্সির বেশি তোমার আর কাপড় লাগবে না। আর নতুন মায়েদের আন্ডারগার্মেন্টস লাগে না। চুল আঁচড়াবে না। তুমি ঘর থেকে বেরুতে পারবে না। খাবার দাবারও ঘরেই পাঠিয়ে দেয়া হবে। যা দিব তাই খাবে, রুচি দেখাবে না। যা বলেছি এর চেয়ে বেশি বুঝতে যাইও না। পণ্ডিত পরিবারের পণ্ডিত মেয়ের পণ্ডিতির জায়গা আমার ঘর না”।

সু্যোগ পেলেই যেহেতু তিনি এভাবে কথা বলেন, তাই মেয়েটি তাতে অবাক না হয়ে, অবাক হলো রান্না ঘরের পাশের ঐ রুমটায় ভ্যাপসা একটা ভাব, গরমও বেশি লাগে। খুব ছোট রুমটা। পাশে যে বাথরুম সেটাতে লো কমোড, ও ব্যবহার করবে কীভাবে? সি সেকশনের পর তিন দিনের ভিতর নিচে বসা তো ওর পক্ষে সম্ভব হবে না। এছাড়া বাচ্চার জন্যও তো ঠিক হবে না রুমটা। তাই অনেক অপমানিত হতে হবে জেনেও শাশুড়িকে অনুনয়-বিনয় করে সে নিজের বেডরুমে থাকার অনুমতি নিয়েছিল, যদিও সে নিজের বিছানা ছাড়া ঘরের কোনো জিনিস ছোঁবেও না বলে কথা দিয়েছিল।

শিশুদের জন্মের সময় মধু খাওয়ানোর একটা রেওয়াজ আছে আমাদের দেশে। শিশু মিষ্টভাষী হবে এই কারণে তা করা হয়। যে পরিবারের কেউই মিষ্টভাষী নয়, সেও মধু খাওয়াতে যায়, শিশুকে মিষ্টভাষী বানাতে। অথচ একটা শিশু তখনই মিষ্টভাষী হবে, যদি পরিবারের মানুষ মিষ্টভাষী হয়। অন্যথায় পুরো বোতল মধু খাইয়ে তাকে অসুস্থ অবশ্যই বানানো যাবে, তবে মিষ্টভাষী নয়। এখনকার সময় ডাক্তাররাও নিষেধ করেন এই কাজ করতে। কারণ মধুকে ডাইজেস্ট করার মতো এনজাইম জন্মের দিন শিশুর দেহে থাকে না। তাই মেয়েটি তার হাজব্যান্ডকে অনুরোধ করেছিল মধু না খাওয়াতে।

আর বাচ্চার জন্মের পর নাভি পড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নাভির জায়গাটা শুকনো রাখতে স্নান করাতে নিষেধ করা হয়। যাতে জল লেগে ইনফেকশন না হয়। আবার সময়ের আগে যদি শিশুর জন্ম হয়, সেখানেও শিশুর স্নান করানোর ক্ষেত্রে একটু সচেতনতা অবলম্বন করতে হয়। উভয় ক্ষেত্রে গা’টা ভালভাবে মুছে দিতে হয়। তাই বউটি এইসব ব্যাপারগুলো সুন্দরভাবে সামলানোর জন্য তাদের সহযোগিতা কামনা করেছিল। কেন নিজের ঘরে থাকতে চাইলো, কোন সাহসে মধু খাওয়ানো আর স্নান করানো নিয়ে হাজব্যান্ড ও শাশুড়িকে অনুরোধ করলো, তার ফল ওকে খুব ভয়াবহভাবে ভোগ করতে হয়েছিল।

বাচ্চাকে খাওয়াতে গেলেও সে ব্যথা পেত, প্রথম সন্তান তাই খাওয়ানোর সঠিক নিয়মটা জানতো না বলে। তা দেখে যখন ওর বাবা-মা ডাক্তারের সাথে মেয়ের জামাইকে একটু কথা বলতে বলেছিলেন। সেক্ষেত্রে কোনো সহযোগিতা না করে সাথে সাথে শাশুড়ি বললেন, “কী অপমান, কী অপমান!! পাটেশ্বরীকে এতো সেবা দেয়ার পরও হয়নি! তোকে কিন্তু অপমান করলো বাবা”।

নিউনেটাল জন্ডিস খুব কমন একটা বিষয়। হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ এর সময় বলেই দিয়েছিল সকালে বাচ্চার গায়ে রোদ লাগাতে। বাসায় কেউ সেই কাজটা করতো না। এমনকি বাচ্চার বাবাও না। মায়ের তো ঘর থেকে বেরোনোই নিষেধ। মাকেই সারারাত জেগে থাকত হতো বাচ্চা কোলে অসহ্য ব্যথা নিয়ে, কারণ বাচ্চা সারারাত কাঁদলেও আর কেউ তাকে ধরতো না। এছাড়া ১১ তলার ফ্ল্যাটটিতে সকালে জানালা দিয়ে রোদটাও আসতো না। বাচ্চার মুখের দিকে তাকানোর সময় কারো না থাকলেও তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে মা টিকে প্রতি মুহূর্তে হেনস্থা করার জন্য সময়ের অভাব কারো ছিল না।

বাচ্চার চোখ হলুদ লাগছে – একথা মা’টি বার বার বলায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় বাচ্চাটিকে। ব্লাড টেস্টে বিলুরুবিন এর পরিমাণ বেড়ে গেছে দেখে বাচ্চাটিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন ডাক্তার। তা শুনে সাথে সাথে শ্বশুর-শাশুড়ি রণমূর্তি ধারণ করে, বউ এর ঘরে এসে পারলে খুন করে ফেলেন মেয়েটিকে। অমুকের বাচ্চা, তমুকের বাচ্চা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করবো তোকে, বলে যা তা ভাষায় গালিগালাজ করেই যাচ্ছিলেন। হাজব্যান্ড পাশে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিল দৃশ্যটা। মেয়েটি নিজের হাজব্যান্ডের কাছে দৌড়ে গিয়ে বললো, তুমি অন্তত এটা বলো না যে আমি দায়ী আমার ছেলের এই অবস্থার জন্য। সে সাথে সাথেই বলে উঠলো, তোমারই তো দোষ। চুপ করে থাকো। শাশুড়ি আরও মারমুখী হয়ে তার স্বামী এবং পুত্রকে বলছিলেন “নিজের বেডরুমরে আঁতুড় ঘর বানাইয়া জন্ডিস করসে বাচ্চার।স্নান করাইতে মানা করসে জন্মের পর, প্রতিদিন স্নান করাইলে তো জন্ডিস স্নানের সাথে ধুইয়া যাইতো। খাবারেও হলুদ খাইসে তাইলে বাচ্চার জন্ডিস হইবো না তো কী হইবো।”

মেয়েটি বুঝতে পারছিল, দাঁতে দাঁত চেপে তিনি সেদিন যখন তাকে তার বেডরুমে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন, জলে চুবিয়ে যে জন্মের পর স্নান করাতে পারেননি, তা সুদে আসলে উশুল করতে নিজে ‘অশৌচ’ ঘরে খাবার পাঠিয়ে বলে দিলেন মেয়েটি হলুদ খেয়েছে। অথচ উনি না দিলে ও খেল কীভাবে? স্তম্ভিত ফিরে পেল শাশুড়ি যখন বললেন, এতোকিছুর পরও তোমরা দেখতাছো, ওরে বাইর করবা না? বলতে না বলতেই শ্বশুর পা উঠিয়ে আগ বাড়লেন! মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। মাত্র আট দিন আগে অপারেশন হয়েছে। কীভাবে যে হাসপাতালে গিয়েছে বাচ্চা নিয়ে সে নিজেও জানে না। সেখানে গিয়েও নিস্তার ছিল না, ক্রমাগত শুনতে হচ্ছিল যা তা কথা। সেখানে গিয়েও শাশুড়ি চিৎকার করছিলেন, “আমরা তো টাকার গাছ লাগাইছি। নিজে অসুস্থ, বাচ্চা জন্ম দিছে আরেকটা অসুস্থ। এইগুলার পিছনে এখন আরও লাখ টাকা লাগবো। আমি কোন দিনও শুনি নাই কারো বাচ্চার জন্ডিস হইসে।”

পরে অবশ্য উনারই ভাইয়ের বউ উনাকে পুত্রবধূর সামনেই বলেছিল, কী বলো সেজদি, আমার দুইটা ছেলেরই তো জন্মের পর জন্ডিস এতো বেড়ে গিয়েছিল যে আমি দশ-বারো দিন হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জই নিতে পারিনি, তুমি তো ছিলে, ভুলে গেছো? পুত্রবধূটি যা বোঝার তা বুঝলো।

একে নিজেই সিজারের পেশেন্ট, তার উপর খাওয়া নেই, ঘুম নেই, চূড়ান্ত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায়ও সন্তানকে ব্রেস্ট ফিড করাতে বার বার যেত সন্তানের রুমে। ডাক্তার বলেছিলেন, আপনি নিজেই সুস্থ নন। আপনি বেডে যান, আমরা খাওয়ানোর সময় বেবিকে নিয়ে যাবো আপনার কাছে। এক মিনিটের জন্য মাসি শাশুড়ি হাসপাতালে এসে বললেন, তুমি তো সুস্থ, এখানে বসে আছো কেন? বাচ্চার রুমে গিয়ে খাওয়াও। তোমার জন্য তো আর রুম নেয়া হয়নি!

সদ্য মা’টিই ডিউটি দিচ্ছে, অথচ গলির মোড়ে হাসপাতাল হওয়া সত্ত্বেও কেউ আসা বা খাবার পাঠানোর প্রয়োজনও মনে করেনি! শুধু যেদিন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল সেদিন রাতে শ্বশুরবাড়ি থেকে ওর খাওয়ার জন্য এক বাক্স আধপচা মিষ্টি পাঠানো হয়েছিল। মানুষ কতো ভয়াবহ মানসিকতার হয়, তা নিজের চোখে দেখার পরও বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছিল। দুই দিন পর যেদিন বাসায় আসে, সেদিন তারা সবাই মিলে আয়োজন করেছিল মেয়েটি কেন রিআ্যাক্ট করেছিল তাই তার সবার পায়ে ধরে মাফ চাওয়ার অনুষ্ঠানের। মেয়েটি শুধু নিজের হাজব্যান্ডের দিকে একবার তাকিয়ে ভাবছিল এই লজ্জা তোমার, আমার নয়।
মেয়েটি বাচ্চার আয়ার মতো ঐ বাড়িতে ছিল। তার সন্তানের ব্যাপারে সে ছাড়া বাকি সবার মতামত, পছন্দ-অপছন্দেরই গুরুত্ব ছিল।

ডায়পার পরানো ছাড়া কেউই বাচ্চাকে নিজেদের বিছানায় রাখতেন না, যার যখন খুশি পরিয়ে দিতেন, কিন্তু অন্তর্যামী হয়েও কেন সময়মতো খুলল না এর জন্য বউটিকে তুলাধুনা প্রায়ই করতেন। বউটির বাচ্চাকে ওষুধ খাওয়ানো, জল এমনকি খাবার খাওয়ানো নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হতো। অসুস্থ যাতে থাকে, সেজন্য মা’টি নাকি ইচ্ছা করেই ওষুধ খাওয়াতো না, আর খাবার না খাইয়েই নাকি অন্যদের কাছে খাইয়েছি বলে বাচ্চাকে দিত যাতে রান্নাঘরে গেলেই বাচ্চা কাঁদে আর কোন কাজ করতে না হয়।
আর এক মাসের বাচ্চাও নাকি পুরো মায়ের স্বভাবের, মায়ের কাজ করা সহ্য করতে পারে না। মা স্নান করালে কাঁদে না, অন্যের কাছে কাঁদে কেন? মায়ের কোলে এলেই ম্যাজিক এর মতো কান্না থেমে যায় কেন? শুয়ে থাকলেও মায়ের সাথে লেপ্টে থাকে কেন? সব প্রশ্নের উত্তর আবার নিজেরাই দিত যে, নিশ্চয় মা যাদুটোনা করেছে বাচ্চাকে। না হলে বাচ্চা মায়ের দিকে পাশ ফিরে থাকতে গিয়ে ঘাড় ত্যাড়া করবে কেন? কিন্তু মা’টি জানতোই না What is the meaning of Tona? এই বিশ্লেষণধর্মী আলোচনায় তারা কেউই লজ্জিত বোধ করতো না, মেয়েটি যে শুনেছে বা তার কেমন লাগছে, সেটাও একজনও ভাবতো না?

সময় গময়ের বালাই ছিল না, দুপুর ২.৩০,৩.৩০ টা এমনকি ৪ টার সময়ও এবং রাত ১২.০০ বা ১২.৩০ দিকে অর্থাৎ দৈনিক দুই বার শীতের মধ্যও সদ্যোজাত শিশুটিকে ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল দিয়ে শরীর শুধু নয়, মুখে পর্যন্ত ডলে দেয়া হতো। বিশেষত যখন চোখে, নাকে, মুখে ম্যাসাজ দিত বাচ্চাটি কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যেতে চাইতো ঝাঁঝের কারণে। সেটা বাচ্চার স্যুট করছে কিনা, তাও বিচার্য ছিল না। আরও আছে, এক মাসের বাচ্চার যাতে কাশি না হয় এই কারণে এক টেবিল চামচ ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেলে রসুন দিয়ে তা বাচ্চাকে খাইয়ে দেয়ার বাসনা পোষণ করেন শাশুড়ি। বাচ্চার পায়খানা ঠিকমতো হচ্ছে না সেই সরিষার তেল তো আছেই, তা পানের বোঁটায় লাগিয়ে টানা দেড় মাস খোঁচানো চললো, তবু ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া যাচ্ছিল না।

জন্মের পর যখন বাচ্চা পর্যাপ্ত দুধ পেত, তখন বউটিকে বলতেন, তোমার তো বস্তির মেয়েদের অবস্থা, আমাদের বাবা এমন ছিল না। চূড়ান্ত মানসিক নির্যাতনে বউটিরও বস্তির অবস্থা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বাচ্চার শরীরও খারাপ হচ্ছিল দেখে মেয়েটি ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে তাতে কারো মত না থাকলেও। ডাক্তার অমিডন ট্যাবলেট দেয় মাকে খাওয়ার জন্য এবং হাজব্যান্ডকে নিয়ে যেতে বলে, কারণ পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য সবার আগে উনাকে বোঝানো প্রয়োজন। তারা শোনার সাথে সাথেই বললেন, “বমির ওষুধ খেয়ে দুধ বাড়ানো বাপের জন্মে শুনি নাই, আর খাওয়াইতে তো আর কম খাওয়াইলাম না, তাতেও যদি তোমার বাচ্চা দুধ না পায়, কী আর করা। আর হাজব্যান্ডের সাথে ডাক্তারের কথা বলানোর বায়না তো তোমার, সুস্থ একটা মানুষ, তবুও তুমি যেন চলতেই পারো না”।

এদের পাগলামিতে বাচ্চার অসুস্থতা বাড়লো। ওকে শাসিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো ডাক্তারের কাছে যেন কোনভাবেই না বলে দেড় মাস ধরে বাচ্চাটিকে খুঁচিয়ে চলেছেন, তবু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাননি। ডাক্তার মা’টিকে দেখেই হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন সে অসম্ভব বিপর্যস্ত, তাই প্রশ্ন করায় মেয়েটি শাশুড়ির সামনেই বলেছিল, হ্যাঁ আমি ঠিক নেই ডক্টর….শাশুড়ি বাসায় এসে গগনবিদারী চিৎকারের মাধ্যমে পুত্রবধূর গোষ্ঠী উদ্ধার করে নিজের হাজব্যান্ড ও পুত্রকে ফোন করলেন যে, “অসভ্য, নবাবের মাইয়ার সাহস কত! ডাক্তাররে কয়, অয় মানসিকভাবে ঠিক নাই, আরে তুই হইলি পাগল, তুই কেমনে ঠিক থাকবি, কেমনে যে আমি সহ্য করছি কি কমু, তাড়াতাড়ি আয় বাপ… তোর বউরে আইয়া ঘর থাইক্কা বাইর কর।”

যথারীতি শ্বশুর এবং পুত্রের আগমন এবং বউকে ঘর থেকে বের করে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ। বাচ্চাটা যে অসুস্থ, সেই খেয়ালটুকুও নেই। আবার যখন হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলো শরীরে রক্ত কম বলে তখন ল্যাবে, হাসপাতালে বার বার বলছিল, মা’কে সরিয়ে রাখুন, ছোট্ট বাচ্চা -মা সহ্য করতে পারছে না, উনিই কেন সব সময় বাচ্চার সাথে? আর কেউ নেই? খুব দুর্বল মনে হচ্ছে দেখে… কিন্ত মা’টিকে সান্ত্বনা দেয়ার পরিবর্তে তারা ছিঃ ছিঃ করেই যাচ্ছিলেন।
অথচ যারা পায়ের নখ উল্টালেও দেশের বাইরে যায় চিকিৎসা করাতে দেশের চিকিৎসার উপর বিন্দুসম আস্থা নেই বলে, সেই তারাই ঘরের কাছে হাসপাতালে বাচ্চাটিকে ফেলে রেখেছিল। গবেষণাগারের ইঁদুরের মতো তার উপর গবেষণা চলছিল। কারো কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সারাদিন বাচ্চা নিয়ে মা একাই থাকতো। হাসপাতালের খাওয়া পারলে খেত, ওয়াশরুমও রুমের বাইরে, একটা মানুষও থাকতো না যার কাছে দিয়ে খাবে বা ওয়াশরুমে যাবে! একদিন ডাক্তারের কাছে শাশুড়ি কমপ্লেইন করছিলেন মা’টির দায়িত্ব কর্তব্যে অবহেলা সম্বন্ধে, ডাক্তার বলেছিলেন, “আড়াই মাস আগে সিজার হয়েছে! মেয়েটির খাওয়া, ঘুম, রেস্ট কিছুই নেই, একটা প্রসূতির সাথে এই ব্যবহার করে যে পরিবারের মানুষ আশা করে বাচ্চা সুস্থ থাকবে, তাদের কিইবা বলার থাকতে পারে, খাওয়ান খাওয়ান ফিডার খাওয়ান। দয়া করে কথায় কথায় বউ এর দোষ ধরাটা বন্ধ করেন।”

তারা অপমানবোধ করলেন ডাক্তারের কথায়, কিন্তু একবিন্দু লজ্জা অনুভব করলেন না নিজেদের আচরণে। এতেও তারা বউ এর দোষই খুঁজে পেলেন। অথচ তাদের অমানবিক, অমানুষিক আচরণে বউটি শুধু নয়, শিশুটিও ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে তা তারা বুঝেও বুঝতে পারছিলেন না। জন্মের পর যখন ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন ন্যুনতম আধঘণ্টা সকালের রোদটা বাচ্চার গায়ে লাগাতে, তা করা হয়নি এবং পরবর্তীতে ফলোআপেও বাচ্চাটিকে রাখা হয়নি। ডাক্তারের কাছে কেবল তখনই নেয়া হতো, যখন আর না গেলেই নয়। শুধুমাত্র অসচেতনতা ও অজ্ঞানতার ফল ভোগ করেছিল সদ্যোজাত শিশু ও তার মা’টি।

শারীরিক ও মানসিক অযত্ন, অবহেলায় অবাঞ্ছিতের মতো অমানবিক জীবন-যাপন করতে করতে মেয়েটি একপর্যায়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন ছয় মাসের বাচ্চা কোলে দিয়ে অসুস্থ অবস্থায় তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়।
পুরো প্রক্রিয়ায় হাজব্যান্ড এর অবস্থান ছিল গৃহপালিত সন্তান, কাপুরুষ হাজব্যান্ড এবং অথর্ব পিতা হিসাবে।

একটা মেয়ে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার পরও কেন এতো অত্যাচার মেনে নিল? হয়তো সে মনে করেছিল তাদের মধ্যে যদি কখনো মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়!! কিন্তু যাদের চরিত্রই এমন, সেক্ষেত্রে আপনি যতই অত্যাচার সহ্য করুন না কেন, তাদের অত্যাচারের মাত্রাটা কমবে না, বরং ততই বাড়বে। সেটা মেয়েটিও হয়তো সেদিন বুঝতে পেরেছিল যখন ঘর থেকে বের করে দিয়ে আর খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন মনে না করলেও যেদিন নিজেদের ঘরের কাঠগড়া ছাড়িয়ে তাকে নিয়ে তুলেছিল আদালতের কাঠগড়ায়। কাঠগড়ায়ই থাকুক মাতৃত্ব আর দ্ব্যর্থহীন থাকুক পিতৃত্ব, সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায়।

শেয়ার করুন: