একটি ব্রিটিশ রিয়ালিটি শো ও আমার উদ্বেগ

শেখ তাসলিমা মুন:

সারাদিন পর ঘরে ফিরে সোফাতে এলিয়ে পড়ে, ক্লান্ত হাতে টিভির রিমোট কন্ট্রোল টিপছিলাম। হঠাৎ বাংলাদেশের দৃশ্য দেখে আঙুল থেমে গেল। বিদেশি টিভিতে বাংলাদেশের দৃশ্য দেখলে এখনও উৎসুক হই।

দেখি, ব্রিটিশ বেকিং শোয়ের নাদিয়া হুসেইন। অনুষ্ঠানটির অনেকখানি হয়ে গেছে। আগ্রহী হয়ে দেখতে শুরু করলাম। ইংল্যান্ড থেকে সিলেট এয়ারপোর্টে নামছে নাদিয়া হুসেইন। সিলেট এয়ারপোর্ট থেকে গ্রামে চলছে তাদের গাড়ি। উচ্ছ্বাসটা আমাকেও ছুঁয়ে গেল। নাদিয়া হুসেইন ব্রিটিশ একটি টিভি শোয়ে বেকিং কমপিটিশনে প্রথম হয়। তার আগে সে ছিল একজন হাউজ ওয়াইফ। ৩৩ বছরের এই মেয়েটি চার সন্তানের জননী। গ্রামে তার বাবা মা থাকেন।

কথা শুনে বুঝলাম, তার বাবা মাও একসময় ব্রিটেনেই থাকতেন। বাবা ও মা দুজনেরই ব্রিটিশ ইংলিশ। এমনকি তার নানিও ব্রিটেনেই বাস করেছেন। সিলেট জেলাটিতে ইংল্যান্ডে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের ছাপ। তিন জেনারেশনে ব্রিটেনে বসবাস করে পরিবারের আধাআধি ব্রিটেনে এবং সিলেটে। বাড়িগুলো বাংলাদেশের অন্যান্য গ্রাম থেকে আধুনিক। বেশিরভাগ বাড়িতে শহুরে সুযোগ সুবিধা। ইংল্যান্ডে মেইন্সট্রিমের সাথে যুক্ত হয়েও, ব্যারিস্টার, ব্যারোনেস, কাউন্সিলর, এম্পি হয়েও তারা ব্রিটিশ কালচারের কেউ নন। বরং বেশ দূরত্ব। তাই সুদুর ইংল্যান্ড এবং ছায়া সুনিবিড় সিলেটের এ গ্রামগুলোর সাথে এক মেলবন্ধনে একটি লন্ডনি ছাপ পরিস্ফুট এ গ্রামগুলোতে।

নাদিয়া হুসেনের বাবার গ্রাম তেমনি একটি গ্রাম। আত্মীয় স্বজনের অনেক মেয়ে ব্রিটেনে জন্মগ্রহণ করেও এখন বসবাস সিলেটের গ্রামে। বিয়ের পর সংসার করছে গ্রামেই।

ওদের কথপোকথনগুলো মন দিয়ে শুনছিলাম। নাদিয়াকে ওয়েলকাম জানিয়ে তার আত্মিয়া বলছে, এখানে অন্তত তোমাকে হিজাব পরার জন্য কোনঠাসা হতে হবে না। কিংবা তুমি ডিফারেন্ট, এটি তোমার অনুভূত হবে না। এখানে হিজাব পরলে কারও কাছে অবাক লাগবে না।

নাদিয়া বলছে, আই নো।

ওরা কথা কন্টিন্যু করছে।

– হিজাব আমাদের জন্য সম্মানের। হিজাব মডেস্ট এবং মুসলমান নারীর এক সম্মানজনক আইডেন্টিটি।

– অন্য পুরুষ আমাদের প্রতি আকৃষ্ট হতে না পারার জন্য আমরা এ পর্দা ব্যবহার করি। ইসলাম নারীর সম্মান এভাবে সযত্নে রক্ষা করেছে।

– ইসলাম নারীকে দামী জুয়েলের মর্যাদা দিয়েছে। নয় কি?

– ইসলাম নারীকে ‘কুইন’ হিসেবে ট্রিট করেছে।

– আমি এটি ব্যবহার করতে কেন অপরাধবোধ করবো? আমিতো কোন ভুল করছি না। এটা একটি রাইট অ্যাক্ট।

কনভারসেশনটি প্রতিটি মুসলিম নারীর আপব্রিঙ্গিং বিষয়ের প্রায় সমস্তটাই বলে দেয়।

তবে আমি কেবল ভাবছিলাম অন্য একটি কথা।

”এখানে(বাংলাদেশে) অন্তত তোমাকে হিজাব পরার জন্য কোনঠাসা হতে হবে না। কিংবা তুমি ডিফারেন্ট এটি তোমার অনুভূত হবে না। এখানে হিজাব পরলে কারও কাছে অবাক লাগবে না।”

এ লম্বা বাক্যটির ভেতর এক ভিন জেনারেশনের ভিন ‘সময়’ কথা বলে উঠেছে। ওদের কাছে বাংলাদেশ ‘হিজাব বান্ধব’। লন্ডনে তারা এ বস্ত্রখণ্ডটি নিয়ে মনোযাতনায় ভুগে থাকলেও বাংলাদেশ তাদের জন্য হিজাবভূমি। এখানে তাদেরকে নিয়ে কটাক্ষ করার কেউ নেই।

বিষয়টি বিষয়ে আনন্দ করবো? ভাববো, বাংলাদেশে ইংল্যান্ড থেকে মানবাধিকার বেশী? বিষয়টি সেরকম? তাই কি?

আমার ভেতরে হীম শীতল একটি শৈত্য প্রবাহ অনুভব করলাম।

একটি কাজ কয়েকবার করলে তা হয়ে যায় অভ্যেস। সেই অভ্যেস কয়েক বছর করলে হয়ে যায় প্রথা। সেই প্রথা হয়ে যায় ‘কালচার?’ সংস্কৃতি? এই মেয়ে দুটি ব্রিটিশ এ ডকুমেন্টারিতে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে যেভাবে তুলে ধরলো, সে বাংলাদেশ আমার ভেতরটা কাঁপিয়ে দিলো।

কল্পনায় দেখছিলাম, ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া মেয়ে বাচ্চাগুলো ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যাচ্ছে। টিনেজে পৌঁছুতে তাদেরকে বাংলাদেশে এনে সিলেটে ইংলিশ মিডিয়াম ব্রিটিশ ধারার স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। তারা ব্রিটিশ জন্ম নিয়ে সিলেটের গ্রাম বা শহরের সংরক্ষিত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। বিয়ে হয়েছে। সন্তান হয়েছে। লন্ডনের ব্রিকলেন থেকে অপেক্ষাকৃত সামর্থ্যবান জীবন যাপন করছে। নিজভূমির এক স্বাধীনতা অনুভব করছে। কিন্তু তারা যেমন ব্রিটেনে থেকেও বোঝেনি ব্রিটিশ শেকড়কে, বাংলাদেশে ফিরে এসে বাংলাদেশে বসবাস করে, একটি বড় সময় পার করেও জানেনি বাংলাদেশের মূল শেকড়কে।

শুধু কি ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া এ স্পেশাল অবস্থার একটি গ্রুপ? চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া বাংলাদেশে জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা এক উদীয়মান প্রজন্ম? তারাও কি অনুভব করছে না, ”এখানে অন্তত তোমাকে হিজাব পরার জন্য কোনঠাসা হতে হবে না। কিংবা তুমি ডিফারেন্ট এটি তোমার অনুভূত হবে না। এখানে হিজাব পরলে কারও কাছে অবাক লাগবে না।”

না, বিষয়টি সত্য নয়। আমাদের অবাক লাগে। সত্যি লাগে। আমাদের মা, খালা, চাচী, নানী, দাদীরা মুসলমান নারী ছিলেন। তাঁরা নিয়মিত নামাজ পরতেন। পর্দা করতেন তাদের বারো হাতের শাড়িতেই। তাদের মাথায় এই অদ্ভুতুড়ে এক ঝাঁকা টেক্সটাইল দেখিনি। এ বস্ত্রখন্ডটি বাংলাদেশের নয়। এটি চোখে পড়ে। বেশ পড়ে।

নাদিয়া হুসেইন এবং তার মা যখন কিচেনে রান্না করছে, তার মা শাড়ী পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে পর্দা করছেন, কিন্তু নাদিয়ার মাথায় যে কাপড় খণ্ডটি, সেটই এ অঞ্চলে কোনদিন ছিল বলে আমরা জানি না। ব্রিটিশ এ তরুণীদের কাছে বাংলাদেশ হিজাবের অভয়ারণ্য বটে, তবে আমাদের কাছে অচেনা বস্ত্র। নিশ্চয়ই। এ পোশাকটি সম্পূর্ণ বাংলাদেশের মূল পোশাক থেকে আলাদা। বাংলাদেশের পোশাকের অনুষঙ্গ এটি নয়। শাড়ির অনুষঙ্গ হিসেবে এটি একটি নতুন আমদানী।

আমি হিজাবের এ বস্ত্রখণ্ডটিকে কেবল পোশাক হিসেবেই যদি নিতে পারতাম, তাহলে সে সরলীকরণ মানতে অসুবিধা হতো না। কিন্তু এটি কেবল একটি বস্ত্রখণ্ড নয়।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.