মৌসুমী হত্যার জন্য আসলে কে দায়ী?

দিলশানা পারুল:

যখনই কোনো মেয়ের সত্যিকার সংসার যন্ত্রণার কথা লিখতে গেছি, এক বা একাধিক সন্দিহান, ধারালো তীরের ফলার মতো মানুষের সন্দেহকে মোকাবেলা করতে হয়েছে, মোকাবেলা করতে হয়। কিছু যায় আসে না আমি কতখানি যন্ত্রণার কথা লিখছি, কিছু যায় আসে না কী পরিমাণ অন্যায় অত্যাচার সত্যিকার অর্থে আমাদের মেয়েগুলো সহ্য করে, এইগুলো বলতে গেলেই তীব্র সন্দেহ মোকাবেলা করতে হয় আমি আদৌ সত্যি বলছি কিনা! কারণ মেয়েগুলোর সংসার যন্ত্রণার কাহিনী সমাজের যে অন্ধকার ছবি ফুটিয়ে তোলে সেইটা স্বীকার করতে আমরা নারাজ। আমরা দেখেও না দেখার ভান করি। মধ্যমা উঁচিয়ে হিমালয় পবর্তকে আড়াল করার মতো। কারণ ডিনায়াল ইজ দ্যা পাওয়ার।

মৌসুমী মেয়েটাকে ১০১ টা দোররা মেরে হত্যা করা হয়েছে, পত্রিকা মরফত মোটামুটি আমরা সবাই এইটা জানি। মেয়েটাকে কি শুধু ১০১ টা দোররাই হত্যা করেছে? মেয়েটা মরে যাওয়ার আগে অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে তারপর মরে গেলো।

দোররা মারার আগে একটা সামাজিক সালিশ হলো। সেই সালিশটা কারা করলেন? সেই সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ, যাদের মধ্যে নির্বাচিত মেম্বার, সম্মানিত কাজী, সম্মানিত ইমাম এবং দশর্ক্ হিসেবে পাড়া-প্রতিবেশী প্রত্যেকে মিলেই এই বিচারটা করলেন। সেই সালিশটা কেন করা হলো? মৌসুমী নামের বিবাহিতা মেয়েটি পরকিয়া করেছে। আসল ঘটনা কী? মেয়েটার শ্বশুর বাড়ি দীর্ঘদিন ধরে মেয়েটাকে যৌতুকের জন্য চাপ দিচ্ছিলো এবং শারীরিকভাবে অত্যাচার করছিলো। এই ঘটনা কি যারা বিচার করলেন তারা সহ পাড়া-প্রতিবেশি জানে না?

জানে। কিন্তু যৌতুকের জন্য একটা মেয়েকে চাপ দেয়ার মধ্যে তারা কখনো কোন সমস্যা দেখতে পায় নাই। যৌতুকের জন্য একটা মেয়েকে শারীরিকভাবে অত্যাচার করার মধ্যেও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, নির্বাচিত ব্যক্তিত্ব কোনো সমস্যা দেখতে পেলেন না। শ্বশুর বাড়ি যে সম্পূর্ণ্ মিথ্যা একটি গল্প ফাঁদলো, সেইটার মধ্যেও তারা কোনো সমস্যা দেখেনি। একমাত্র সমস্যা একটি মেয়ে পরকিয়া করেছে, সেটি এবং তাও যে গল্পটি বানানো।

ঘটনার শুরু এইখানেই না। এর আগে আরও লম্বা কাহিনী আছে। মেয়েটাকে এর আগে কয়েকবার শ্বশুর বাড়ি থেকে মারতে মারতে বাপরে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, যৌতুক না দেয়ার অপরাধে। মেয়েটা মরে যাওয়ার পর তার আত্মীয়-স্বজন একাধিক লোকের নামে মামলা করলেন। মেয়েটাকে যখন মারতে মারতে বাপের বাড়ি পাঠিয়েছিলো, তখন আসলে এই বাবা, মা, আত্মীয়-স্বজন কী করেছিলেন? মেয়েটাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সেই শ্বশুর বাড়িই পাঠিয়েছেন।

মৌসুমীর পরিবার এবং আত্মীয় স্বজনও যৌতুক চাওয়ার মধ্যে কোনো সমস্যা দেখতে পায়নি। এমনকি যৌতুকের জন্য নিজের মেয়েকে এইরকম মারধরের মধ্যেও তারা কোনো সমস্যা দেখতে পাননি। মেয়েটা যতবার বাড়ি ফিরে এসেছে, ততবাড়িই তাকে শ্বশুর বাড়িই ফেরত পাঠিয়েছেন। মেয়েটা শ্বশুর বাড়িতে মার খাচ্ছে তাতে কী? সমাজে বাবা মার সম্মান তো থাকছে !

আমি শুধু এই পরিবারগুলোর উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলতে চাই, এক বেলা একমুঠো ভাতের খরচ কী এতো বেশি যে এই বাবা-মাগুলো মেয়ের লাশ গুনতে রাজী, তাও একবেলা খাওয়াতে পারবেন না? এইখানেই শুরু না, আরও একটু খানি শুরুর গল্প বাকি আছে।

মৌসুমীর ছবি দেখে বোঝা যায়, বাচ্চা একটা মেয়ে। এই মেয়েটার কি ১৮ বছর বয়স হয়েছিলো? পত্রিকায় মেয়েটার বয়স লিখেনি। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখেন, মেয়েটার বিয়ের সময় আদৌ বয়স ১৮ ছিলো কিনা? না থাকলেও অসুবিধা নাই। এই রাষ্ট্র তো ১৬ তেই একটা মেয়ের বিয়ের বয়স পারমিট করে বসে আছে, এমনকি মেয়ে আরো ছোট হলেও সমস্যা নাই। এমনকি বারো-তেরো তেও বাবা মা চাইলে বিয়ে দিতে পারবেন, রাষ্ট্র কাউকে কিচ্ছুটি বলবে না।

এই অনলাইন, ফেইসবুকের যুগে আমরা কি আসলেই বুঝতে পারছি যে, বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা আসলে কোথায় অবস্থান করে? এই রাষ্ট্রে এখনও সামাজিক বিচার হয়। যেই বিচারে একটা মেয়েকে স্রেফ মেয়ে হওয়ার অপরাধে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় দোররা মারা হয়। আমরা কি আসলেই স্বীকার করি যে এই মধ্য আয়ের দেশে লক্ষ লক্ষ মেয়ে যৌতুকের জন্য নির্যাতিতা হয়?

বিশ্বাস করেন, আমি এমন অনেক গল্প জানি যেইখানে কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়া বাবা-মা আসলেই ভাবেন, মেয়ে তালাক দিয়ে বাড়ি ফেরার চেয়ে লাশ হয়ে বাড়ি ফেরা ভালো। বিশ্বাস করেন, এই বোধের কোনো ধনী গরীব মধ্যবিত্ত নাই। কেন? কারণ এই সমাজে এখনো মেয়ে মানে বাবা-মার কাছে বোঝা। মেয়েরা তো আর বাবা-মাকে কামাই করে খাওয়াতে পারবে না। দিনের শেষে তাদের ছেলে সন্তানই তাদের খাওয়াবে।

এই সমাজে একটা মেয়ের চালচলনে পান থেকে চুন খসলে বাবা-মার সম্মান শেষ হয়ে যায়। মৌসুমী মরে যেয়ে আসলে অনেকগুলো খুনের আসামীকে আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেলো। এই বধির এবং অন্ধ রাষ্ট্র ব্যবস্থা, ক্ষমতাবান সমাজপতিরা, র্নিলিপ্ত প্রতিবেশীরা এবং সম্মান বুভুক্ষ এই সব বাবা-মায়েরা, আসলে এরা সবাই সমান দায়ী একের পর এক মৌসুমীদের হত্যার জন্য।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.