শেখ তাসলিমা মুন:
বিবাহ এবং সম্পর্ক চিরন্তন কোন বিষয় নয়। বিষয়টি যে চিরস্থায়ী কোনো বিষয় নয়, সে বিষয়ে ধারণা ও এক্সেপ্টেন্স থাকা খুব বড় একটি দরকারি বিষয়। আমাদের কন্টিনেটের মেয়েরা বিয়েকে একটি চিরস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে আজও মনে করে। বিবাহবিচ্ছেদকে তারা সকল ব্যর্থতা বলে মনে করে। ‘জীবন দিয়েও আমি আমার ম্যারেজ বাঁচাবো’ ‘স্বামীকে ফেরাবো’ এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। এমনকি শিক্ষিত স্বনির্ভর নারীদের মুখেও। নিজের আপন সম্মান ও সক্ষমতা বিষয়টি নগণ্য করে বিবাহের ব্যর্থতাকে আটকাতে সকল শক্তি ব্যয় করে। অনেক শিক্ষিত নারীও ‘বিবাহকে বাঁচানোর’ জন্য তার সকল চেষ্টাকে জীবনের মহান চেষ্টা ও কাজ মনে করেন। বিবাহকে রক্ষা করা নোবেল মনে করে।
সম্প্রতি দেখেছি, ৯০ টি ফিল্মে অভিনয় করা ধনবান নায়িকা কী করেছেন। তিনি জানেন তার স্বামী তাকে ভালবাসে না। সে একটি জারক। এক বছর তাকে অলক্ষ্যে রেখেছে। সেও ওবে করে গেছে তার নির্দেশ পরামর্শ প্ল্যান। এ ধরনের অসাধু পুরুষদের তুলে ধরা দরকার ছিল তার অনেক আগেই। অন্যভাবে। উত্তর দেওয়া উচিত ছিল আপন মর্যাদায়। অনেক আগেই।
মূলত সম্পর্ক এবং বিবাহ সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন বিষয়। সম্পর্কের উপর ভিত্তি করেই উন্নত বিশ্বে বিবাহ প্রতিষ্ঠিত। আমাদের এলাকায় এখনও বিবাহকে ভিত্তি করে সম্পর্কগুলো গড়ে ওঠানোর চেষ্টা করানো হয়। প্রত্যাশা সফল হবে। যদি ক্লিক করে তাহলে ‘ভাগ্যের’ খেলাটির পরিণতি ভাল হয়। যদি সেটি না হয় তবুও সেটি থেকে বের হবার কোন পথ খোলা থাকে না। দুর্ভোগটির শুরু সেখানে। তবু তাকে বয়ে নিয়ে বেড়ানোর যে দায় বহন করতে হয় নারী এবং পুরুষ উভয়কে, সেটিই জীবন বিধ্বংসী। এ ক্ষেত্রে শুধু নারী নয়, পুরুষও সমানভাবে ভুক্তভোগী। পুরুষের ক্ষেত্রে সে সামাজিকভাবে অনেক সুবিধাভোগী। পরিবারের বাইরের বিষয়গুলোতে ডুবে গিয়ে সে নিজেকে বিযুক্ত রাখতে পারে। একটি আলাদা জীবন যাপনের সুবিধা ভোগ করে যায়, যা নারী পারে না। একজন পুরুষ ইচ্ছে করলে এক সপ্তাহ বা একমাস কোথাও ঘুরে আসার নাম করে বেরিয়ে পড়তে পারে। একজন নারীকে বদ্ধ ঘরেই থাকতে হয়। সকল কর্তব্য কর্মে নিযুক্ত থেকেই জুঝতে হয় তাকে সকল কিছুর সাথে।
পরিবার প্রথা আমাদের জীবনের সাথে এমনভাবে জড়িত যে এর বাইরে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবন যাপন করার অবস্থা প্রায় দুরূহ করে রেখেছে সবার জন্য। কাউকে বড় ধরনের মূল্য দিয়ে এ প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করে যেতে হচ্ছে। আর এভাবে এতো বড় একটি ক্ষয়িষ্ণু প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা যে কঠিন, সেটি কেউ আমলে নিচ্ছেন না। নারী-পুরুষ তথা সুস্থ সমাজ গড়তে সেটাই ক্ষতির। একজনের একচেটিয়া স্যাক্রিফাইসের উপর কোন বিষয় টেঁকসইভাবে দাঁড়াতে পারে না। সেটি ক্ষয়িষ্ণু হয়ে ওঠে। ভেতরে ভেতরে মুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। সেজন্য সমস্যাটির মূল নিয়ে ভাবতে হবে আগে।
খুব বেসিক কিছু বিষয়ে পরিষ্কার থাকা দরকারি। সম্পর্ক আজীবনের কোন বিষয় হবেই এমন নয়। বিবাহ একটি কন্ট্রাক্ট। সে কন্ট্রাক্ট ভাঙার আইনগত এবং ধর্মীয় বৈধতা রয়েছে। শর্ত যাই থাকুক বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে বেরিয়া আসা অবৈধ করেনি আইন রাষ্ট্র ও ধর্ম। এসব প্রতিকূলতার থেকে বেশি প্রতিকূলতা আমাদের মনের। আর এ মনে সমাজের, পরিবারের ক্ষমতা সীমাহীন।
মানুষ যত বেশি সক্ষম, নিজের শক্তি বিষয়ে অবগত সে ততো জানে সম্পর্ক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নির্ভরতার বিষয় নয়। সম্পর্ক ভালবাসা, সম্মান, আত্মমর্যাদা ও সৌহার্দ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এর কোনোটি যখন একজনকে বিসর্জন দিতে হয় কোনো কারণে, তখন সেখানে একজনের একটি অক্ষমতা তৈরি হয়। তখন একজনের একটি দুর্বলতা এবং নির্ভরতা তৈরি হয়। তখন সম্পর্কে এক্সপ্লয়টেশন শুরু হয়। একে অপরের দুর্বলতাগুলো ব্যবহার শুরু হয়। সম্পর্কগুলো অসাধু হয়ে ওঠে। সুবিধাবাদের উপর দাঁড়িয়ে সম্পর্কের মর্যাদা নষ্ট হয়ে ওঠে।
মানুষের শাশ্বত স্বভাব আলাদা কথা বলে। মানুষ মূলত জন্মগতভাবে মুক্ত সোউল। মানুষ সব সহ্য করতে পারে, তার আত্মার অবমাননা সে সহ্য করতে পারে না। বন্দিত্ব সহ্য করতে পারে না। মানুষ যখন কোন কারণে সেটি করতে বাধ্য হয়, তখন মানুষ হিসেবে তার গুণাবলী সে হারাতে থাকে। তার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে পড়তে থাকে। জীবন অসুখের হয়ে ওঠে।
সম্পর্ক একটি গেইম হয়ে ওঠা উচিত নয়। সম্পর্ক আত্মিক। সেটিকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। একজনের আরেকজনের প্রতি ভালবাসা শেষ হয়ে যেতেই পারে, সেটিকে গ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জন করা দরকারি। নীতিবাক্য এবং নানান ভ্যাল্যুজ আরোপ করে আর যাই হোক, কাউকে ভালবাসতে বাধ্য করানো যায় না। দুজন মানুষ কোন একদিন সীমাহীন ভালবাসতো সেকারণে সেটি চিরস্থায়ী হবে সেটি নয়। মানুষের মনে যেহেতু ভালবাসার বাস, সে মন থেকে ভালবাসাটি কিভাবে ধীরে ধীরে সরে গেছে সেটি নিয়ে মামলা দায়ের করে ভালবাসা ফিরিয়ে আনা যায় না।
একজন মানুষের অনেক কারণে আশাভঙ্গ হতে পারে। অনেক জানার পরও একজনকে কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অজানা থাকতে পারে। সে জায়গাটিতে সে কম্প্রোমাইজ নাও করতে পারে। ভালবাসা থেকে দূরে সরে যাওয়ার আরও কারণ তৈরি হতে পারে। অন্য কাউকে ভালবাসাও ক্রাইম কিছু নয়। এখানে মানুষকে সৎ হওয়া দরকারি। সত্য বার্তাটি দেওয়া এবং যে গ্রহণ করবে দুজনকেই বিষয়টির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবার গুণগত যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আমাদের ৯০% ম্যারিড কাপল এবং ক্ষেত্র বিশেষে বাগদত্তা কাপল মিথ্যের উপর বাস করে। নিজেদের প্রতি আকর্ষণ, ভালবাসা হারিয়েও তারা সত্যটি বলতে পারে না। বলাটা একটি ডিজাস্টার বলে মনে করে। আর যাকে বলা হয়, তিনিও গ্রহণ করতে পারেন না। তার পৃথিবী তাতে ভেঙে পড়ে। তিনি পার্সোনালি নিয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যান। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে দায়ী করে হস্টাইল হয়ে ওঠেন। প্রতিক্রিয়া নারীর ক্ষেত্রে আর পুরুষের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা হয়। পুরুষ তো ‘না’ গ্রহণ করতেই শেখেনি। সে সেজন্য খুন পর্যন্ত করতে পারে।
সামনাসামনি দুজন বসে সত্য বিষয়টি বলতে না পারলেও দুজন দুজনের প্রতি হস্টাইল এবং সহিংস জীবন যাপনে পিছিয়ে থাকে না। ঝগড়া মারামারি নিত্যদিনের হয়ে ওঠে।
অথচ যদি তারা শান্তভাবে ভাবতে পারেন, একজন মানুষের হৃদয় থেকে আমার জন্য ভালবাসা উঠে গেলে আমি জোর করে কীভাবে পেতে পারি! যে মানুষটি আমাকে ভালবাসে না, তাকে দিয়েই বা কী করবো?
এই পয়েন্টটিতে নিজেদের কাছে সৎ হবার সকল সম্ভাবনাও যেন সমাজ পরিবার বন্ধ করে রেখেছে। ভালো না বেসে বলে যায় ভালবাসি। এবং তৃতীয় ব্যক্তির সম্পর্কে প্রবেশ এবং তা নিয়ে মিথ্যেকে আরও বিস্তৃত করে চলে তারা। সম্পর্ক ও পরিবার হয়ে ওঠে সুবিধা ও অসততার এক নরক প্রতিষ্ঠান।
এ শতাব্দীর মানুষকে খুব শান্তভাবে ভেবে দেখতে হবে। বিচ্ছেদকে মানার শিক্ষা অর্জন করতে হবে। কোনকিছু জীবনে ‘টেক ইট ফর গ্রান্টেড‘ ছিল না, নাইও। কোনকিছু ‘চিরস্থায়ী’ নয়। জীবনে সেটিই মহান নয়। জীবনে সৎ হওয়া বেশি দরকারি। আত্মসম্মান ও আপন মর্যাদা চর্চা বেশি দরকারি। পরিবারে এটি শুরু হলে সমাজ ও পরিবার সুস্থ হবে। দেশ সৎ ও সুস্থ নাগরিক পাবে।