আসমা খুশবু:
নারী নির্যাতন বিষয়ে একটি আর্টিকেল পড়ছিলাম। নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে, বাংলাদেশের এক জরিপে পুরুষদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁরা নারীদের অধস্তন মনে করেন কি না! এর উত্তরে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সব ধরনের বেশির ভাগ পুরুষই জানান, তাঁরা নারীদের অধস্তন মনে করেন। অর্থাৎ এখানে আমাদের সমাজের নারীদের নিয়ে পুরুষদের মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। যে সমাজে পুরুষের মানসিকতার চিত্র এমন, সেই সমাজে নারীরা নির্যাতিত হবেই, এটা অস্বাভাবিক নয়।
‘আগের তুলনায় নারী নির্যাতনের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। দেশের নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়েছেন, তা যেমন সত্য; তেমনি নির্যাতন পিছু ছাড়ছে না, তা-ও সত্য। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, ডিজিটাল সংস্কৃতি, আইনের কঠোর প্রয়োগ না হওয়া, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে নির্যাতন বাড়ছে’।
কয়েকদিন আগে সাফ অনুর্ধ-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপ টুর্নামেন্টে কিশোরী মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। খবরটা নিঃসন্দেহে আশা জাগিয়েছে। সমাজের নিম্নশ্রেণীর এই মেয়েগুলো তাদের অবস্থান থেকে যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে তার কোন তুলনা হয় না, দেখতেই কেমন অপ্রতিরোধ্য মনে হয়। মনে হয় এই তো সেই প্রজন্ম যাদের নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি। সত্য বলতে ওদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর সাহসকে আমি মনে মনে স্যালুট জানিয়েছি। কিশোরী মেয়েদের এই বিজয়ের সংবাদ পড়তে গিয়ে কমেন্ট সেকশনে চোখ আটকে গেছে। তাদের হাফপ্যান্ট হাজার হাজার পুরুষের মাথা ব্যাথার কারণে পরিণত হয়েছে। দেশে মানুষের অনুভূতির এত তীব্রতা দেখে তো ভয়ই হয় কখন না আবার এই মেয়েগুলি নির্যাতনকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
এই আশা জাগানিয়া মেয়েদের নিয়ে যখন আশায় বুক বাঁধছি তখন ঠাকুরগাঁয়ের হরিপুরের মৌসুমীর মৃত্যুতে চুপসে গেলাম। এই ২০১৭ সালে দাঁড়িয়ে কোন নারীকে যদি দোররার আঘাতে মৃত্যু বরণ করতে হয়, তাহলে বলতেই হয় আমরা কি পেছনে হাঁটছি আসলে? এই মেয়েটির দোষ সে এবং তার পরিবার তার স্বামীর চাহিদামতো যৌতুক দিতে পারেনি, যার কারণে বিভিন্ন সময়ে তাকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এই নির্যাতনেও যখন মেয়েটি বেঁচে ছিলো, তখন তাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই পরকীয়ার মিথ্যা বদনাম করে তার স্বামী গ্রাম্য সালিশের আয়োজন করে। সেখানে গ্রামের মাতব্বররা ১০১ টি দোররা মেরে মেয়েটিকে মৃতপ্রায় করে ফেলে রাখলে পরেরদিন মেয়েটির মৃত্যু হয়। এটাকে কি আমরা একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলবো না?
এই মেয়েটি মৃত্যুর আগে যখন বিভিন্ন সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তখন কেন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, এই বিষয়টা খুব ভাবাচ্ছিল। পরিবার কেন জেনেশুনে আরও নির্যাতনের শিকার হতে দিলো? তারা মেয়েটির স্বামীর সাথে একরকমের রফা করেছিল যে, ধীরে ধীরে তারা যৌতুকের টাকা পরিশোধ করে দেবে, কিন্তু লোভী স্বামীর এতো দেরি আর সহ্য হলো না। নতুন কোনো মেয়ের সর্বনাশের আশায় হয়তো মেয়েটিকে মেরেই ফেলতে হলো!
এই স্বামী তো যৌতুকের নির্যাতনের জন্য দায়ী, কিন্তু গ্রামের সালিশ চালানো মাতব্বরেরা তারা তো মেয়েটার খুনি, আবার মেয়েটির পরিবার, জেনেবুঝে তাকে সেই মৃত্যুপুরীতে বারবার ফেরত পাঠিয়ে তো তাকে মৃত্যুর মুখেই ঠেলে দেওয়া। অথবা থানার পুলিশ, যারা কিনা নির্যাতনের মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তারা? স্বামী, পরিবার, সমাজ, মানুষের নিরাপত্তা দানকারী বাহিনী, কেউই তো নারীদের পক্ষে না।
আমাদের সমাজই তো নারী বান্ধব সমাজ নয়, এখানে যেসকল নারীরা টিকে থাকে তারা অর্থনৈতিক জোরে টিকে থাকে, নিম্নশ্রেণীর প্রান্তিক নারীদের শিক্ষা, সাহস অথবা অর্থনৈতিক মুক্তি না থাকায় তাদেরকে মৌসুমী – পূর্ণিমাদের জীবন মেনে নিতে হয় মুখ বুঝে। পূর্ণিমার কথা মনে আছে তো? যার স্বামী রেগে গিয়ে ফুটন্ত গরম পানি তার মাথায় ঢেলে দিয়েছিল! ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে সে মারা যায়। এদের আর্ত চিৎকার কারও কানে পৌঁছে না, পৌঁছুবেও না।
এই মেয়েগুলোকে খুব বলতে ইচ্ছে হয়, মেয়ে এইবার তুমি জেগে ওঠো, কেউ যখন শুনবেই না তোমার চিৎকার, নিজেকে নিজে শোনাও। এ সমাজকে তুমি তোমার উপযোগী করে গড়ে তোলার দায়িত্ব নাও। তুমি পারবে, নিজের দায়িত্ব নিজে নাও, শিক্ষার আলোয় নিজেকে আলোকিত করো, তোমার অর্থনৈতিক মুক্তিই পারে তোমাকে সমাজে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে।।