নিলীমা সুলতানা:
আমি নারী, কিন্তু কখনো কখনো নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কে? উত্তর পাই না। ছেলে হয়ে জন্মেছি, মেয়ে হতে ইচ্ছে করে, এটা শুনলে লোকে আমাকে পাগল বা হিজড়া বলবে নিশ্চয়ই, কিন্তু আমার ইচ্ছার পিছনে আমার কি কোনো হাত ছিলো কখনও? না।
শুরু থেকেই বলি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি, চেহারাটা ছোটবেলায় সম্ভবত একটু মেয়েলি ছিলো, তার উপর ছিলাম লাজুক টাইপের। অনেকের হয়তো ধারণা নেই এমন ছেলেদের ব্যাপক টিজিং এর শিকার হতে হয়, যেটা ইভ টিজিং এর চেয়ে কোনো অংশে কম না। ছিলামও বোকা টাইপের, ক্ষ্যাপালে চট করে রেগে যেতাম, যা হবার তাই হতে হতো, আরও বেশি টিজিং এর শিকার হতে হতো। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কথাগুলো শেয়ার করার, সমাধান চাওয়ার কেউ ছিলো না, কতোই বা বয়েস আমার তখন, ৯/১০।
একটা স্থায়ী বিষণ্ণতা গ্রাস করেছিলো আমাকে, মেয়ে হওয়াকে ঘৃণা করতাম আমি, হ্যাঁ ঘৃণাই করতাম। তারপর ধীরে ধীরে দিন গেলো, আরেকটু বড় হলাম। ও হ্যাঁ, আরেকটা ব্যাপার হয়েছিলো, একবার দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম আমি মেয়ে হয়ে গেছি, স্বপ্নটা তাড়া করে ফিরলো আমাকে, কোনো কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে, কোনো কাজে মনকে বুঝাতে মনকে বলতাম, ওটা করো না বা ওটা করো, না হলে মেয়ে হয়ে যাবে। মনের মধ্যে গেঁথে গেলো ব্যাপারটা।
আমার বোধহয় তখন পাগল হওয়ার বাকি। ১২/১৩ বছর বয়সে এসে অনুভব করলাম আমাকে কেউ পাত্তা দেয় না, সমবয়েসী কাজিনগুলা অনেক বেশি এটেনশান পায়, তাদের সুন্দর সুন্দর পোশাক। আমাকে খারাপ ভাববে জানি তোমরা, তবু সত্যিই ভীষণ হিংসা হলো আমার। সেই প্রথম আমি একদিন মনের সাথে লড়াই করলাম, আমি মেয়ে হলে সত্যিই কি খুব খারাপ হতো! লুকিয়ে লুকিয়ে বোনের একটা ড্রেস পরলাম আমি, সেই শুরু।
কতদিন যে লুকিয়ে বোনের জামা পরেছি। বাসায় কেউ না থাকলেই জামা পরতাম, সাজতাম, আয়নায় নিজেকে দেখতাম, ক্যাট ওয়াক করতাম। তবে সবকিছুর পর যখন জামা খুলে আবার ছেলের পোশাক গায়ে দিতাম একটা অপরাধবোধ, বিষণ্নতা গ্রাস করতো আমাকে, নিজেকে খুব খারাপ, অপরাধী মনে হতো। রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারতাম না, মানুষের চোখের দিকে চেয়ে কথা বলতে পারতাম না, জানতাম আমি পাপী। এই অপরাধবোধ আমার সামাজিক দক্ষতা, মানুষের সাথে সহজ ভাবে মেশার ক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছিলো।
আজও আমি তাই অনেক লাজুক, নার্ভাস টাইপের। মনে আছে পড়ার খাতায় লিখতাম I am a girl. আমি মেয়ে, লিখেই আবার কেটে ফেলতাম সব। এ একটা নিষিদ্ধ আনন্দ। তবু ভালো লাগতো ভীষণ, নিজের ইচ্ছাটা প্রকাশ করার কিইবা উপায় ছিলো আমার। পড়াশোনায় অনেক অমনোযোগী অনেক দুর্বল হয়ে গেলাম, আজো মনে হয় এই ব্যাপারটা যদি আমার সাথে না হতো আমার জীবন, ক্যারিয়ার অন্যরকম হতে পারতো। অামার অল্প কয়টা বন্ধুর সবাই ছিলো ছেলে, তাদের এগুলা বললে আমার মানসম্মান চিরদিনের মতো নষ্ট হয়ে যেতো, বন্ধুত্বই হারাতাম হয়তো। মেয়ে বন্ধু আমার ছিলো না, মেয়েদের সাথে মিশতেই লজ্জা পেতাম আমি।
বোন বড় হয়ে ফ্রক পরা ছেড়ে দিলো, সালোয়ার কামিজ ধরলো, আমিও লম্বা বড়সড় পুরুষ হয়ে উঠলাম, মুখে গোঁফের রেখা, সেই জামা আমার গায়েই হতো না। আমাকে আর মেয়ে বলে কেউ ক্ষ্যাপাতো না, গুণ্ডা মার্কা একটা ছেলেই লাগতো বোধহয়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি যে মেয়ে হয়ে গেছি তার কী করা! ছেলেদের আমার ভালো লাগতো না কখনো, লাগেওনি, আমি শুধু আরো অনেক মেয়ের ভিড়ে আরেকটা মেয়ে হতে চাইতাম।
ধীরে ধীরে বড় হলাম। নাহ, মেয়ে সাজার সুযোগ আমার আর হয়নি, তবে চাইতাম, ভীষণভাবে চাইতাম। জানি এ সমাজে শুধু মেয়েরাই ছেলে হতে চায়, তারা চায় নিজের জ্বালায়, মেয়েদের স্বাধীনতা নেই, সম্মান নেই, নিরাপত্তা নেই, নেই আড্ডা বো খেলাধূলারও সুযোগ। তারা তো আমাদের সমাজে দ্বিতীয় শ্রেণীর জীব। ঘরবন্দী মেয়েরা যে কূটকচালি, আর পরনিন্দা পরচর্চায় ব্যস্ত থাকে, এ জন্য তাদের কি খুব বেশি দোষ দেয়া যায়? তাদের কি বিকল্প বিনোদনের খুব বেশি ব্যবস্থা আছে? অস্বীকার করবো না আমার তা ছিলো, পুরুষ হবার কারণে অনেক স্বাধীনতা আমি ভোগ করেছি, রাত বিরেতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে পারি, যখন-তখন চাইলেই যেতে পারি যেখানে খুশি, আমি তো সমাজের প্রিভিলেজড শ্রেণীরই মানুষ।
তবু বলি আমি কিছু হারিয়েওছি। সিনেমা দেখে বা বই পড়ে কান্না আসলে চেপে রেখেছি, প্রকাশ্যে কান্না করে নিজেকে হালকা করতে পারিনি কখনো, অনেক সময়ই নিজের আবেগ প্রকাশ করতে পারিনি, কারণ ছেলেদের এসব করতে নেই, বন্ধুদের অশ্লীল আড্ডায় নিশ্চুপ থেকেছি, প্রতিবাদ করতে পারিনি। তবে আর পাঁচজনের মতো হয়তো মেয়েদের অসম্মান করিনি, মেয়েদের ফিগার, গায়ের রং, উচ্চতা নিয়ে কখনো কটাক্ষ করিনি, পারিনি, মেয়েদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে টিজ করতে পারিনি, আমি তো জানি আমিও ওদেরই একজন। কোনো ছেলে মেয়ে হতে চায় শুনে হয়তো আপনি ভ্রু কুঁচকে তাকাবেন, একটা বিশ্রি গালিও দেবেন হয়তো, মানসিক সুস্থতা নিয়ে হয়তো প্রশ্ন তুলবেন, তারপর খুব ঘৃণার দৃষ্টি নিয়ে তাকে দেখবেন। এজন্য কখনো কোন ঘনিষ্ঠতম বনধুকেও এ সত্য বলার সাহস পাইনি।
অনেক বড় হয়ে গেছি এখন, আমি যদি নিম্নবিত্ত ঘরে জন্মাতাম কী জানি হয়তো বা হিজড়ার দলেও নাম লেখাতে পারতাম, উচচবিত্ত হলে বিদেশে চলে গিয়ে সব ভুলে সেক্স চেঞ্জ? হয়তো দুটোর কোনটাই করতাম না, কিন্তু সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না, জানি না কীসে কী হতো! কিন্তু আমার মূল্যবোধ, সমাজ, পরিবার, সব মিলিয়ে আমি খোদার উপর খোদকারী করার কথা ভাবতে পারি না, জানি পাশ্চাত্যে এমন হয়। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যেভাবে তৈরি করেছেন আমি তেমনি।
এখন বড় হয়েছি, হয়তো অবাক হবেন বিয়েও করেছি, বাবা হয়েছি। তবু কোথাও আমার মধ্যে একজন নারী অাছে, যে হয়তো নিজেকে প্রকাশ করতে পারেনি কখনো, কখনো সে শাড়ী পরবে না, পায়ে দেবে না আলতা, তার হাতে কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনি কখনোই শোনা যাবে না। কখনো সে মুখ ফুটে বলতে পারবে না, আমি মেয়ে, আমি নারী।