তাহিরা ফারজানা:
“সন্তানসহ কর্পোরেটে টিকতে না পেরে শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করেছে”- এই অপবাদটি সামনাসামনি শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমার একজন কাছের শিক্ষক বন্ধু এই কথাটি তার সহকর্মী (একজন নারী শিক্ষক) এর কাছ থেকে শুনেছেন। এই কথা তার কাছ থেকে শুনে নিজের কানকে নিজেই বিশ্বাস করতে বড় কষ্ট হয়েছিল সেদিন। কারণ তার মতো আমিও একজন মা, আমিও একজন শিক্ষক, আমিও একজন প্রাক্তন কর্পোরেট কর্মকর্তা।
কী অদ্ভুত এই মিল!
এই ছোট্ট কিন্তু ভারী লাইনটি নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। এই লাইনটি হৃদয়ের গভীরে খচখচ করতে লাগলো.. কাঁটা চামচ দিয়ে হৃদয়ে কেউ আঁচড় কাটছে। মনে হলো, আমাদের মাতৃত্ববোধে এর চাইতে বড় আঘাত বোধহয় আর কিছু হতে পারে না।
একজন নারী যখন ধীরে ধীরে “মা” হয়ে উঠেন, তখন তার মানসিক শক্তি, কাজ করার ক্ষমতা, সহনশীলতা, প্রজ্ঞা ক্রমশ বাড়তে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় তিনি যে গুণাবলীর ধারক হোন, তা দিয়ে যে কোনো মূল্যবান সৃষ্টি তৈরি করা সম্ভব এই পৃথিবীতে। কিন্তু হায়! এই পৃথিবীর অধিকাংশ সুযোগ সন্ধানী মানুষ এই সত্য জানে বলেই তারা তাদের বিবেককে গলা টিপে হত্যা করে সৃষ্টিশীল এই নারীদের মা হয়ে উঠার পথে রক্তক্ষরণের বন্যা তৈরি করে তাদের ভাসিয়ে দিয়ে যায় বিষাদের অতল গহবরে। যেখান থেকে আমরা অনেকেই হারিয়ে যাই… নিজের যে পরিচয় পৃথিবীর বুকে রেখে যেতে পারতাম, যে সৃষ্টি দিয়ে পৃথিবীকে আরো সম্পদশালী করে যেতে পারতাম সেই সৃষ্টিগুলো বুকের মধ্যে নিয়ে, বিষাদের বন্যায় ভেসে অনেক দূর কোনো গ্রহে চলে যাই… আহা জীবন! জলে ভাসা পদ্ম যেমন! কিংবা, অভিমান জমে জমে আমি ব্যথাহীন।
একজন শিক্ষক ও গবেষক হিসাবে উল্লেখিত বাক্যটি আমার জন্য অনেক বড় গবেষণার উপাদান। দুইটি দিক মূলত আমার আজকের এই লিখার আলোচ্য বিষয়।
“সন্তানসহ কর্পোরেটে টিকতে না পারা ও শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ”।
সামগ্রিকভাবে যে কোনো কর্মজীবী নারী তার মাতৃত্বের শুরুতে প্রথম যে দ্বন্দ্বের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে, তা হলো “সন্তান ও কর্মজীবন এর মধ্যে সমন্বয়”। এই দুয়ের সমন্বয় সাধন করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই।
এই সংকটে পড়েনি এমন কোনো কর্মজীবী মা খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমি, আমার বন্ধু এবং আমার পরিচিত অনেক কর্মজীবী মা এই সংকটের সম্মুখীন হয়েছি এবং এই সংকট অতিক্রমও করেছি। এই সংকটে সবচেয়ে বেশি যে পাশে থেকেছে তিনি আরেকজন নারী… “আমাদের মা”। আমাদের মায়েরা তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমাদের পাশে ছিলেন বলেই হয়তো তাদের সন্তানেরা সৃষ্টির ক্ষমতা নিয়ে হারিয়ে যায়নি।
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে শুধু নয়, সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানেই সন্তানসহ টিকে থাকার জন্য আমাদের মায়েরা দিন-রাত কঠোর যে সংগ্রাম করে সেই সংগ্রামের কথা আরেকদিন বলবো…মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই, অন্য অনেক কর্মজীবী মায়ের মতো আমার বন্ধুর মা তাকে যে সহযোগিতা করেছিলেন, তার ফলশ্রুতিতে তার কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে টিকে থাকা কোনো বিষয় ছিল না। বরং সে ওই সময় আরো বড় পদে অন্য প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলো…বলতে দ্বিধা নাই সে বাইরের একটা প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ পেয়েছিলো সে সময়। যে সুযোগগুলি হাতে ছিল তার মধ্যে তার কাছে “শিক্ষকতা” পেশায় আসার সুযোগ সবচাইতে ভালো মনে হয়েছিল বিধায় সে অন্য সুযোগগুলি না নিয়ে “শিক্ষকতা” পেশায় আসে।
আমার অনেক প্রাক্তন সহকর্মী ও বন্ধু হয়তো আমার সাথে একমত হবেন যে, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতাকে যদি পাঠ্য-পুস্তকের সাথে মিশ্রণ করা যায় তাহলে তা ছাত্রদের জন্য অনেকাংশেই ইতিবাচক প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করার একটাই কারণ “কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে যারা শিক্ষকতা পেশায় আসেন তারা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে টিকতে না পেরে চলে যাচ্ছেন এই ভাবনায় বিশ্বাসীদেরকে একটি নতুন ভাবনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া।”
ও হ্যাঁ, একটি বিষয় বাকি রয়ে গেলো, একজন মা যদি সন্তানসহ শিক্ষকতার পেশায় আসেন, তাহলে তা কিন্তু টিকতে না পারার কারণে চলে আসেন তা নয়, বরং নিজের সন্তানের পাশাপাশি আরও অনেক সন্তানের দায়িত্ব একসাথে পালন করতে পারবেন বলেই এই পেশায় আসেন।
আমি আমার বন্ধুকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এই প্রেক্ষাপট আমার কাছে উপস্থাপন করায়। নিজের মনের মধ্যে এতো কঠিন অপবাদ পুষে রেখে মাতৃত্ববোধের কষ্টকে দ্বিগুণ না করে সে যে অকপটে তা বলে ফেলার সাহস দেখিয়েছে, সেই সাহসের জন্য তাকে অভিনন্দন।
সকলের বিবেকবোধ জাগ্রত হোক! প্রতিযোগিতায় টিকতে হবে বলে সেখানে যেন আমরা অন্যায়ের কাছে নিজেদের মাথা নত না করে ফেলি। মাতৃত্ববোধ সৃষ্টির সেরা বোধ। এই বোধকে অন্তত আঘাত করা থেকে নিজেদের বিরত রাখি।
লেখক: শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।