“সম্পর্কগু‌লো যেন কেবলই লোক দেখা‌নো না হয়”

হেলেনা আফরোজ:

অামার দাদীর কা‌ছে গল্প শু‌নে‌ছি, তার যখন বি‌য়ে হ‌য়ে‌ছিল মাত্র ছয় বছর বয়‌সের ‌ছোট্ট শিশুটি সে ছিল, অার দাদা ছিল ২০ বছ‌রের তরুণ। তার দাদীর কো‌লে চ‌ড়ে এ‌সে‌ছিল প্রথমবার শ্বশুরবা‌ড়ি। শৈশব, কৈশোর, যৌবন পে‌রি‌য়ে অাজ‌কে বৃদ্ধ সে। অ‌নেকগু‌লো বছর পে‌রি‌য়ে গে‌ছে দাদা চলে গে‌ছেন না ফেরার দে‌শে।

‌সে‌দি‌নের সেই ছোট্ট মে‌য়ে‌টি ধী‌রে ধী‌রে হ‌য়ে উ‌ঠে‌ছিল তার স্বামীর ভালবাসার জীবনসঙ্গী, তার সন্তান‌দের মমতাময়ী মা এবং দা‌য়িত্বশীল গৃহকর্ত্রী। তার সন্তানরা সবাই যার যার মত সুপ্র‌তি‌ষ্ঠিত অাজ‌কে। এখন দাদীর ম‌ধ্যে স্বামী‌কে হারা‌নোর কষ্ট যেমন কাজ ক‌রে, তেম‌নি সন্তান‌দের জন্য প্রচণ্ড গ‌র্বেও তার বুকটা ভ‌রে থা‌কে। কারণ এটা তার অর্জন।

যতবারই দাদীর কাছ থে‌কে তার স্বামী বা সংসার নি‌য়ে কোনো গল্প শু‌নে‌ছি, তার সবটা‌তেই মি‌শে থাকতো অ‌নেক অ‌নেক শ্রদ্ধা, ভালবাসা, অার বোঝাপড়া দুজ‌নের ম‌ধ্যে।

অাজ‌কে নিয়ম পা‌ল্টে‌ছে। ‌মে‌য়ে‌দের জন্য ১৮ এবং ছে‌লে‌দের জন্য ২১ নির্ধারণ করা হ‌য়ে‌ছে বি‌য়ের বয়স। এখন কেউ অার দাদীর কো‌লে চ‌ড়েও শ্বশুর বা‌ড়ি অা‌সে না। তার জন্য পাল‌কি বা গা‌ড়ি অা‌ছে। হাজা‌রো রীতিনী‌তি নতুন ক‌রে যোগ হ‌য়ে‌ছে বি‌য়ের তা‌লিকা‌তে।

‌বি‌য়ের সম্পর্কটা ঠিক হওয়া থে‌কে সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত হাজা‌রো অনুষ্ঠান অার গ‌বেষণা চল‌তেই থা‌কে। শুধু তাই নয় এখন তো রী‌তিমতো বি‌য়ে উৎসবও হ‌চ্ছে বি‌য়ের কেনাকাটা কিভা‌বে বা কোথায় কর‌বেন সেই বিষয়টাকে সহজ করার জন্য।

এই এত শত গ‌বেষণা অার অা‌য়োজন ক‌রে যখন একটা বি‌য়ে বা নতুন বন্ধন তৈ‌রি হ‌চ্ছে সেটা সবসময় সুন্দর থাক‌বে বা অাজীবন টি‌কে থাক‌বে, সেটাই তো অামা‌দের কাম্য। অার এখন যে বয়‌সে অামরা বি‌য়ের প্রস্তুু‌তি নি‌চ্ছি সেটা যে কোনো সম্পর্ক‌কে খুব ভালো ক‌রে বুঝতে পারার জন্য বা কিভা‌বে সেটার ম‌ধ্যে নি‌জে‌কে ভাল রাখা যা‌বে সেটা জানার জন্য য‌থেষ্ট।

এতো প‌জি‌টিভ দিক থাকার পরও অাজ‌কের দি‌নে অামা‌দের সম্পর্কগু‌লো ভালো নেই। অামরা দুজন মানুষ একই ছা‌দের নী‌চে থাকার পরও দুজ‌নের বন্ধু হ‌য়ে উঠ‌তে পার‌ছি না। একজন অার একজন‌কে বুঝ‌তে পার‌ছি না। সম্মান কর‌ছি না। অার যেখা‌নে বোঝাপড়া বা সম্মান নেই সেখা‌নে অবশ্যই ভালবাসা নামক কিছু থাক‌তে পা‌রে না।

এমন‌কি মা‌ঝে মা‌ঝে তো দুজন মানু‌ষের ম‌ধ্যে এই সুন্দর সম্পর্কটা এতোটাই তিক্ততায় প‌রিণত হ‌চ্ছে যে, একটা সমাধান (বি‌চ্ছেদ) ছাড়া অার কোনো উপায় থাক‌ছে না। সন্তান বা সংসা‌রের কোনো মায়ায় অার তা‌দের একসা‌থে বে‌ঁধে রাখ‌তে পার‌ছে না।

এক‌দিন যেখা‌নে দুইজন মানুষ একসাথে না থাক‌তে পার‌লে ম‌রে যাবার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল, অাজ‌কে সেই দুইজন মানুষ ই একসা‌থে না থাকার জন্য সব‌চে‌য়ে ক‌ঠিন সম‌াধান টাকে বে‌ছে নি‌চ্ছে।

পু‌রোনা দি‌নের সম্পর্কগু‌লো স‌ত্যিই অামার দা‌দির সম্পর্কটার মতো সহজ ছিল। কোন রং ছিল না সাদা কা‌লো ছাড়া। বি‌য়ের মা‌নে টাই অাপনার বোঝার সময় হয়‌নি কিন্তুু অাপ‌নি হয়ত কা‌রো কোলে চ‌ড়েই চ‌লে এ‌লেন শশুর বা‌ড়ি তে। ত‌বে সব‌চে‌য়ে গুরুত্বপূর্ন ব্যাপারটাই সেখা‌নে ছিল। সেটা হল কিভা‌বে সম্পর্কটা‌কে ধ‌রে রাখা যা‌বে বা ভালবাসাটা টি‌কে থাক‌বে।

অন্য‌দি‌কে অাজ‌কের সম্পর্ক গু‌লো‌তে অাপ‌নি ম‌নের মাধুরী মি‌শি‌য়ে র‌ঙ দি‌তে পার‌ছেন। প্র‌তিটা ছোট ছোট ব্যাপা‌রও প্লান প্রোগ্রাম ক‌রে ঠিক করা হ‌চ্ছে। যা‌তে অা‌য়োজ‌নে কোন ঘাট‌তি না হয়। অার এই এত লোক দেখা‌নো বা‌ণি‌জ্যিক বিষয় নি‌য়ে অামরা এতটাই ব্যাস্ত হ‌য়ে পড়‌ছি যে সবচাই‌তে শৈ‌ল্পিক অার নাজুক বিষয়, মা‌নে সম্পর্ক টা‌র যত্ন নি‌তেই বোধহয় ভুলে যা‌চ্ছি। সুতরাং সব‌কিছু থাকার পরও একটু বি‌শেষ যত্ন বা বোঝাপড়ার অভা‌বে সম্পর্কগু‌লো ভে‌ঙ্গে যা‌চ্ছে।

এমন‌কি অাজকাল অামরা সম্প‌র্কের অাসল মা‌নেটাই বুঝ‌তে পার‌ছি না। যেখা‌নে বিশ্বাস থাক‌বে, সততা থাক‌বে, সেখান থে‌কেই তো তৈরি হ‌বে ভালবাসা অার মায়ার বন্ধন। যে বন্ধনটাই অাজীবন দু‌টো মানুষ‌কে একটা সংসারকে একসা‌থে শক্ত ক‌রে ধ‌রে রাখ‌বে।

‌কিছু‌দিন অা‌গে অামার একজন উচ্চ‌শি‌ক্ষিত বন্ধুর বি‌য়েতে প্রথম সমস্যাটা শুরু হ‌য়েছিল কা‌বি‌নের টাকা নি‌য়ে। ব্যাপারটা ছিল এরকম, ছে‌লের সামর্থ ছিল পাঁচ লাখ টাকা কা‌বিন করার মতো, কিন্তুু তার শ্বশুর বা‌ড়ির কথা অনুযা‌য়ী তা‌কে টাকার অংকটা লিখ‌তে হয়ে‌ছিল চ‌ল্লিশ লাখ। তা‌দের যু‌ক্তি ছিল, তারা ছে‌লের সামর্থ্য সম্প‌র্কে জা‌নে, সুতরাং ছে‌লেকে টাকাটা স‌ত্যি স‌ত্যি দি‌তে হ‌বে না। শুধু টাকার অংকটা লিখ‌তে হ‌বে মাত্র। এটা মে‌য়ের এবং তাদের পু‌রো প‌রিবা‌রের একটা স্টাটা‌সের ব্যাপার। যে‌হেতু তা‌দের প‌রিবা‌রের অন্য কোনো মে‌য়ের পাঁচ লাখ টাকার মতো ‘সামান্য টাকা’য় কা‌বিন হয়‌নি কখ‌নো।

সুতরাং অামার উচ্চ‌শিক্ষিত বন্ধু নি‌জের অাত্মসম্মান বোধ, এমন‌কি ধর্মীয় অনুভূ‌তি (যেহেতু কা‌বিন একটা ধর্মীয় প্রথা এবং ছে‌লেটা ধ‌র্মে বিশ্বাসী) সব বিসর্জন দি‌য়ে এই অসৎ কাজটা‌তে সায় দি‌লো। ত‌বে খুবই দুর্ভাগ্যবশত তার বি‌য়েটা একবছ‌রের ম‌ধ্যেই ভে‌ঙে গে‌ছে।

কেন এতো অল্পসম‌য়ে তা‌দের বি‌চ্ছেদ হ‌য়ে‌ছিল বা এই মিথ্যাটার জন্যই কিনা, অা‌মি জা‌নি না। কিন্তুু এই সুন্দর সম্পর্কটা শুধুমাত্র লোক দেখা‌নোর জন্য এমন মিথ্যা দি‌য়ে শুরু না কর‌লেও বোধহয় হতো।

একটা সম্পর্ক‌কে সুন্দর ক‌রে বা‌ঁচি‌য়ে রাখাটাই কৃ‌তি‌ত্বের, বি‌চ্ছিন্ন কর‌তে বা ভে‌ঙে ফেল‌তে তেমন সময় বা শ্রম দরকার হয় না। অামাদের স‌ত্যিই উ‌চিত একটু চেষ্টা ক‌রে দেখা। ভাল ক‌রে অার একবার তা‌কি‌য়ে দেখা দুজ‌নের দি‌কে ইমপ্রুভ‌মে‌ন্টের জায়গাটা খু‌ঁজে পাওয়া যায় কিনা।

একটা গাছ‌কে কিছু‌দিন অা‌লো বা পা‌নি দি‌য়ে ঠিকমত যত্ন না নি‌লে যেমন অা‌স্তে অা‌স্তে সেটা শু‌কি‌য়ে যে‌তে থা‌কে, তেম‌নি অাপনার সম্পর্কটাও। সম্পর্কগু‌লোর দেখা‌শোনাটা স‌ত্যিই জরুরি।

অাপ‌নি কিছু বিষয় প্রাক‌টিস কর‌তে পা‌রেন, যেটা হয়তো অাপনা‌কে সাহায্য কর‌বে। যেমন অামা‌দের সু‌খের সব‌চে‌য়ে বড় একটা অন্তরায় হ‌চ্ছে খুব বে‌শি এক্স‌পেক্ট করা অন্যজ‌নের কাছ থে‌কে। অামা‌দের এক্স‌পেক্টেশনটা সবসময় ফেয়ার হওয়া উ‌চিত। তা‌তে অাপ‌নি নি‌জে যেমন কষ্ট পা‌বেন কম, তেম‌নি অাপনার সঙ্গীর কা‌ছেও বিষয়টা বির‌ক্তির কারণ হ‌বে না।

অাপনার সঙ্গী‌কে গুরুত্ব দিন। হোক না সেটা কোনো সামান্য ব্যাপার বা কম গুরুত্বপূর্ণ কথা! মন‌োযোগ দি‌য়ে তার কথা শুনুন। প্র‌ত্যে‌কের যে নিজস্ব ব্যাক্তিগত একটা লাইফ থা‌কে সেটা বুঝ‌তে শিখুন। অাপ‌নি তা‌কে ভালবা‌সেন তার মা‌নে এই না যে, সে অাপনা‌কে ছেড়ে একবার বুক ভ‌রে নি:শ্বাসও নি‌তে পার‌বে না। প্র‌তি‌দিন অ‌নেক নে‌গে‌টিভ বিষ‌য়ের অাড়া‌লে যে প‌জি‌টিভ ব্যাপারগু‌লো ঘ‌টে সেগু‌লো‌কে গুরুত্ব দিন এবং অবশ্যই ধন্যবাদ জানান সেগু‌লোর জন্য।

অার য‌দি ম‌নে ক‌রেন কোন কার‌নে স‌ত্যিই অাপ‌নি খুব খারাপ মু‌ডে অা‌ছেন বা একা‌কিত্ব বোধ কর‌ছেন, দয়া ক‌রে ইনসট্যান্ট‌লি সমস্যাটার সমাধান কর‌তে চাই‌বেন না। নি‌জে‌কে একটু সময় দিন, কারণ অাপনার নাইস এবং কাইন্ড আচরণ শুধুমাত্র অাপনার সঙ্গীর প্র‌তি না, বরং নি‌জের প্র‌তিও হ‌ওয়া উ‌চিত।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.