মেয়েরা, চেষ্টাটা তবে ছাড়ুন!

সুচিত্রা সরকার:

কখনো দেখেছেন মেয়েরা, এক গাছের ছাল, আরেক গাছে জুড়ে গেছে? আগের গাছের কাণ্ডে বা ডালে যেমন লেপ্টে থেকেছে, তেমনি পরবর্তী গাছটায়ও- যেই গাছটায় জুড়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে? আম গাছের ছাল কাঁঠাল গাছে?

যদি উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, যদি এরকম দেখে থাকেন, তবে শিরোনামটা আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আপনি যেমন চেষ্টা করছেন, করতে থাকুন।

বিয়ের পরের দিন থেকেই বুঝে নিন, আপনার দায়িত্বগুলো কী কী! শ্বশুরের সেবা-যত্ন করুন। বিনিময়ে পাবেন- এক সমুদ্র আদর, অপত্য স্নেহ, আর অপরিমিত ভালবাসা। কারণ এক গাছের ছাল অন্য গাছে লেগে যায়!

শাশুড়িকে সেবার পাশাপাশি তাঁর জন্য আরো কী কী করতে হবে, জেনে নিন। কোথায় আপনার যাওয়া বারণ, কোথায় খাওয়া বারণ, কী করলে সুফল, কী করলে কুফল- নিবিড়ভাবে শুনুন! আপনার দায়িত্ব কী কী জেনে নিন।

তারপর একটা টালি খাতা বানিয়ে সেগুলো টুকে রাখুন। ও ভালো কথা, শ্বশুরেরগুলোও টুকবেন এ খাতায়।

এরপর দেবর, ভাসুর, ননদ, কাকি শাশুড়ি, মেসো শ্বশুর, বৈবাহিক সম্পর্কে নাতনি, পুতনি অবধি বাদ দেবেন না। ধীরে ধীরে সবার কথা শুনুন। সবার, আপনার কাছে ‘এক্সপেক্টেশন’ কী জানার চেষ্টা করুন। তারপর সেগুলোও টালিখাতায় লিপিবদ্ধ।

বিনিময়ে ওদের কাছ থেকে কী পাবেন, জানতে চান? পরের বাড়িতে একজন ‘নির্ভেজাল আগন্তুক’ এর খেতাব। আদর্শ ঘরনীর খেতাব। এই খেতাবটা ভীষণ কাজে লাগে। সকলে আপনাকে ভালো বলবে। নিন্দে-মন্দ করবে না, ইত্যাদি।

তারপর ঘরের কাজ। সে তো আপনারই। কারো বিপদ হলো, তাও আপনার। কারো খুশির সংবাদ- সেখানেও আপনাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে!

মোদ্দা কথা হলো এই, আপনি এই টালি খাতা দেখে, খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যদি সবকিছু মানিয়ে চলতে পারেন এবং জীবনের একদিনও যদি এসবের ব্যত্যয় না ঘটে, তবেই আপনি পরীক্ষায় পাশ করবেন। এবং আপনি যে দেখেছেন, আম গাছের ছাল কাঁঠাল গাছে লেগে গেছে, সেরকম অবশ্যই ঘটবে আপনার জীবনে।

টিকার এক্ষেত্রে একটি কথাই বলে, এ দেখার জন্য আপনার চব্বিশ ঘণ্টা ‘অন ডিউটি’তে থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

এতো স্বজনের ভিড়ে বরের প্রতি আপনার কর্তব্য কী, তা-ই তো বলা হলো না। বেশি কিছু না। বর যেমন চায়, তেমন করবেন। বরকে কখনো নাখোশ করবেন না। যখন ভালবাসা থাকবে, ভাসবেন। দরকার হলে, বেশি বেশি। যখন তিনি মন্দ বাসবেন, তখনো ভালবাসবেন। কারণ এটাই আপনার ভবিতব্য। তার সঙ্গে ঝগড়া মিটিয়ে নেবেন নিজ দায়িত্বেই। আর ভালো কথা, তাঁর কাছেও কখনো, তাঁর জীবনের অংশ হয়েছেন কিনা, এ প্রশ্ন করবেন না। সদুত্তর পাবেন না। উপরি একটা টিপস, তাঁর পিতা-মাতা- ভ্রাতা- ভগ্নীর সমতুল্য আপনাকে ভাবে কিনা, এমন বোকা বোকা প্রশ্ন করবেন না। এমন বাজে রকম ‘এক্সপেক্টেশন’ করবেন না। কারণ মনে রাখবেন ‘ভিন্ন গাছের ছাল হবার পরীক্ষার ফলাফল’ এখনও প্রকাশিত হয়নি।

প্রত্যাশা করি, আপনার জন্ম সার্থক হোক। নারী জন্ম, মাতা জন্ম, পত্নী-জায়া জন্ম- সার্থকতা পাক। আপনি সুখে থাকুন।

আর শিরোনামটা যাদের সঠিক মনে হয়, সেই মেয়েরা, চেষ্টাটা তবে ছাড়ুন।

করবেন না কেন? অবশ্যই করবেন। বরের জন্য, শাশুড়ির জন্য, শ্বশুরের বা শ্বশুরবাড়ির বাকি যাদের কথা আগে বলা হলো, সকলের জন্যই করুন। তবে টালি খাতায় টোকার দরকার নেই। আপনি ভাবুন, আগে যেমন একটা জীবন ছিল বাপের বাড়িতে, এখানেও তেমন একটা বাড়ি- শ্বশুরের। ততোটুকুই করুন, যতোটা করলে আপনার জীবনটা ক্লান্ত লাগবে না। ততোটাই করুন, যতোটার পর, জীবনটা মূল্যহীন লাগবে না। বারবার মনে হবে না, আজকের পরীক্ষাটা উতরে গেলাম রে! কারো মন জোগানোর চেষ্টা করবেন না। ওটা কেউ পারেনি, পারবে না। কারণ, মন সদা চঞ্চল। ক্ষনে ক্ষনে তার চাহিদা তৈরি হয়।

দায়িত্ব পালন করাটা বোঝার মতো দেখবেন না। আবার দায়িত্ব পালন করতে করতে নিজেকে নিজের বোঝা বানিয়ে ফেলবেন না। শ্বশুর ঘরের লোক অন্য গাছ, সে গাছে আপনি ছাল হবেন না, জেনে গেছেন। তবু অমানবিক কোনো কাজ করবেন না। ন্যূনতম যতটা করা উচিত, করবেন। বরের জন্য, সে আপনাকে যতটা করে, ততটুকুই করুন, বাড়তি নয়, কমও নয়।

বাদবাকি সবাই, যতটুকু করে, সেরকমই। কম-বেশি নয়। আপনি মাথায় রাখুন, এক গাছ থেকে অন্য গাছের ছাল হলে, মানিয়ে গুছিয়ে জীবন পার করার জন্য আপনার জন্ম হয়নি। স্রেফ একটা, দুইটা, দশটা সন্তানের গর্বিত মা হবার জন্যই আপনার জন্ম হয়নি। বউ হবার জন্য আপনার জন্ম হয়নি।

আপনার জন্মটা মানব-জন্ম। এই সম্পর্ক, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের বাইরে, আপনার একটা পরিচয় আছে জগতে। সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। সংসারে কাজ, দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ভেবে দেখুন আপনার কোন বিষয়ে আগ্রহ। গান শুনুন, পারলে কণ্ঠে তুলুন। ছবি আঁকুন। সিনেমা নির্মাণ করুন। বড় কোম্পানির রাঘব বোয়াল হয়ে যান। অথবা ব্যবসায়ী। বা মুদি দোকান খুলুন। সেবা কাজে নিয়োজিত হোন। কাঁথা সেলাই করুন, বিক্রির উদ্দেশ্যে। বিজ্ঞানের বইগুলো পড়ুন। বিজ্ঞানের যতগুলো বিভাগ, যত তার গতিপথ, সবগুলো জানার চেষ্টা করুন। করতে করতে পড়তে পড়তে যদি একটি সোফিয়া (রোবট) বানিয়ে ফেলেন, জগতকে জানান। বা যদি নতুন একটা গ্রহ আবিষ্কার করেন বা আলুর জেনোমের রহস্যভেদ করুন।

করুন, করুন, করুন। কিছু একটা করুন। কারণ এক গাছের ছাল, অন্য গাছে শুধু লেপ্টেই থাকে। ওই গাছ থেকে না পায় রস, না হয় প্রাণসঞ্চার!

আর নারী জন্ম কেবলি প্রকৃতির আদেশ মান্য করা নয়। তার চেয়েও বেশি কিছু। আর আমরা যে মেয়েরা শুধু সংসার আর সন্তান উৎপাদনকেই জীবনের সার মনে করছি, তারা নিজ হাতে এ জাতির ধ্বংসের বীজটা পুতে দিচ্ছি।

কেমন করে?

আপনি জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, কলা, সংস্কৃতি বা শিল্পের ধারে কাছে গেলেন না। আপনার প্রতিভা বা মেধা পরখ করার অবকাশও মিললো না। তারপর আপনার সন্তান হলো। তারপর পরবর্তী প্রজন্ম। একসময় দেখা যাবে, গোটা প্রজন্মটাই মেধাশূন্য। কারণ আপনার পরবর্তী উত্তরসূরি তো আপনার ডিএনএ বা জেনোমও কিছু পাবে। আর আপনি তো মেধার চর্চা না করে, ছাল হবার চেষ্টা করেই জীবন কাটিয়ে দিলেন।

ভাবুন। তবে চেষ্টাটা ছাড়বেন না। চেষ্টাটা নিজের পরিচয় তৈরি করার ক্ষেত্রে করুন, ভবিষ্যতে বৃহৎ মঙ্গল কামনায়!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.