রনিয়া রহিম:
তিনটি গল্প শুনুন। আমি আবছা করে পাল্টে দিবো কিছু ঘটনা, যেহেতু সবগুলো সত্যি ঘটনা, আর সত্যিকারের মানুষগুলোকে কোন ভাবে চেনা না যায়, আর তাদের বিব্রত হতে না হয়।
ছেলেটা মেয়েটার জন্য তার বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে থাকতো, তাদের মধ্যে গভীর প্রণয় ছিলো। এতোই রোমান্টিক ছিলো ছেলেটি যে মাঝে মাঝে রাত গভীরে অজস্র মোমবাতি জ্বালিয়ে মেয়েটির নাম লিখে দিতো তাদের বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে, মেয়েটির মন ভরে যেতো তা দেখে। মোমবাতিগুলো বেশিক্ষণ রাখতে পারতো না, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়; – ঐ লুকোচুরিতেই আনন্দ। এরপর একদিন কি হলো, আমি ভালো জানি না। মেয়েটি ছেলেটিকে বলে দিলো “না, এই সম্পর্ক আমার পক্ষে রাখা আর সম্ভব হবে না”।
হয়তো ছেলেটির ভুল ছিলো কোথাও, হয়তো মেয়েটির, হয়তো দুই পক্ষেরই। ছেলেটির শুধুমাত্র মন ভাঙলে তার প্রতি মায়া থাকতো, কিন্তু প্রত্যাখ্যান সইতে না পেরে সে বেপরোয়া হয়ে উঠলো। মেয়েটির মনে একধরণের ভয় ঢুকে গেলো, – তার কোন ক্ষতি যদি সে করে! – সে বাড়ি থেকে অনেক দূরে সরে আর কোন শহরে চলে গেলো| কমপক্ষে বিশবছর আগের গল্প এটি, – আমার তরফ থেকে গল্পটি এখানেই শেষ, এর বেশি জানা নেই -আশা করি দুই পক্ষই ভালো আছে এখন।
আরেকটি গল্প, এটি আমার। এক যুবকের সাথে নিয়মিত কথা হতো এক সময়ে, তখন আমি নব্য তরুণী। ভার্চুয়াল জগতের বন্ধু ছিলো সে, অনলাইনেই ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতাম। দেশ, রাজনীতি, গান, সিনেমা; – আমি তাকে বন্ধুই ভাবতাম, গল্প করাটা এর বেশি কিছু হিসেবে দেখিনি। আর এটি আমার ভুল ছিলো। গল্প করা মন্দ না, আর বন্ধু থাকা তো দারুণ ব্যাপার। কিন্তু আমি ‘বুঝেও বুঝি নাই’ আমি তার চোখে বন্ধুর চাইতে বেশি কিছু হয়ে যাচ্ছি। এক ফাঁকে আমি নিজেও নিজেকে জিজ্ঞ্যেস করেছি, এই ছেলেটিকে কি আমি বন্ধুর চাইতে বেশি কিছু চাই? ভেবেচিন্তে মনে মনেই বলেছি, না, আমি চাই না, সে বন্ধুই ভালো।
– একদিন সে যখন তার মনের কথা বলেই ফেললো, আমি ‘না’ বলে দিয়েছিলাম। এবং বুঝেছিলাম, আমরা এখন আর বন্ধু থাকতে পারবো না, সম্পর্কটা এখন আর আগের মতো নেই। তার নিশ্চয়ই অভিমান হয়েছিলো, কষ্ট পেয়েছিলো, আর আমারও প্রবল অনুতাপবোধ হয়েছিলো। সেই সঙ্গে আমার অস্বস্তিও কাজ করেছিলো, – ভেবেছিলাম গল্প করে করে আমি উস্কে দিয়েছি হয়তো তার অনুভূতি; আবার এটাও মনে হয়েছে, তাকে বিভিন্ন কথা দিয়েও আমি আমার মতো করে বুঝিয়েছিলাম, আমি তার মতো করে ভাবছি না, তবুও কেন এমন করে বললো? আর ব্যস, সেই চ্যাপ্টারের সেখানেই ইতি। আমাদের কোন যোগাযোগ নেই, যতদূর জানি, সংসার সন্তান নিয়ে সে এখন একজন সুখী মানুষ।
শেষ আরেকটি গল্প শুনুন। ছেলেটি খুব সাধারণ একজন, অন্তত নিজেকে সে তা’ই ভাবতো, যতক্ষণ না তার উপর এক ভয়াবহ বিপর্যয় না নেমে আসলো। সেই বিপর্যয়টা কি? কৈশোর থেকে প্রেম করছে যার সাথে, সেই মেয়েটি এখন বলছে, “রাস্তা মাপো, আর ভালোবাসি না!” অথচ এই মেয়েটির জন্য সে কী না করেছে! নিজের ভালোমন্দের আগেও মেয়েটিকে আজীবন রেখেছে, বিনিময়ে কিছু চায়নি, কিন্তু চায়নি বলে কি এমন নিদারুণ মনভাঙ্গন প্রাপ্য হবে বুঝি!? ছেলেটি ভারী কষ্ট পেলো, আর তারপর খুব সাধারণ সেই ছেলেটি একদম বাংলা সিনেমার চিরন্তন নায়কগুলোর মতো সবকিছুতেই ‘ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট’ হয়ে গেলো। পার্সোনালিটি বলুন, ক্যারিয়ার বলুন, কাছের মানুষদের সাথে সম্পর্কগুলোর কথা বলুন – এই ছেলে এখন সবকিছুতেই একশোতে একশো। তা দেখে এখন মেয়েটি বলছে, “ফিরে চাই”, কিন্তু ছেলেটির পৃথিবী এখন পাল্টে গেছে, সে তার সত্যিকারের আপনজনদের চিনতে শিখে গেছে, মেয়েটির পানে ফিরে চাইবার মানসিকতা তার এখন আর নেই।
– এইবার ঈশপের বাণীটা শুনুন, সব সম্পর্ক গড়ে না, আর সব সম্পর্ক গড়লেও টেকে না। মাঝে মাঝে এক পক্ষেরই অন্যায় থাকে, মাঝে মাঝে দুই পক্ষেরই ভুল বা বোকামি, আর মাঝে মাঝে শুরুতে যে নায়ক বা নায়িকা, সে পরে এসে ভিলেন হয়ে যায়। আপনার মন কেউ ভেঙে দিয়েছে? দোহাই লাগে, ভিলেন হবেন না। নায়ক হন, নায়িকা হন, কমিক রিলিফও হতে পারেন, ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্স্যার হওয়াও মন্দ না- কিন্তু ছ্যাবলামি করা ছোটলোক হতে যাবেন কোন দুঃখে!? এক দুই কি তিনবার তার মন পাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন, – কিন্তু সে যদি ‘না’ বলে চলে যায়, হোক সে ঠিক বা ভুল, আপনি আসলেই আপনার রাস্তা মাপুন। তারপর এমন একটা জগৎ তৈরি করুন, যেখানে কারো এপ্রুভালের তোয়াক্কা না করে আপনি নিজেই সে জগতের হিরো বনে যান, – আপনার পৃথিবীর আলো-আনন্দের চাবিকাঠি কেন এমন একজনের কাছে দিয়ে রাখবেন, যে সেটি নিতে চাচ্ছে না একদমই?
ফেসবুক থেকে দূরে সরে ছিলাম, এখনো ডুব মুডেই আছি, কিন্তু আজ একটু আগে ভেসে দেখলাম, “নাবিলা জানো?” করে করে এক যুবক পাগল হয়ে আছে, সেটিকেই সে প্রেম ভাবছে। মুখে বলছে এমনটা সে করছে মেয়েটির মন পাওয়ার জন্য, কিন্তু মেয়েটি যদি ‘না’ বলেই থাকে, পুরো ব্যাপারটি এখন হয়ে গেছে নিজেকে ছোট করা, আর সেই সঙ্গে, একধরণের প্রতিশোধপরায়ণতা: “আমাকে মন দিলে না? আমি জোর করতেই থাকবো তোমাকে”।
সত্যিকারের ভালোবাসা সবসময় ভালোবাসার মানুষটির ভালোমন্দ নিয়েই ভাবে, সে তার জীবনে থাক বা না থাক। অন্য মানুষটিকে ভালোবাসতে হলে এভাবেই বাসুন, আর নিজের জন্য বজায় রাখুন আত্মসম্মানবোধ।
– তিন নম্বর গল্পে যার কথা বলেছি, সেই ছেলেটি একা নয়, এমন চমৎকার উদাহরণ আপনার আশপাশেই আছে, অনুপ্রেরণা নিতে চাইলে সেখান থেকে নিন, শুভেচ্ছা দিতে চাইলে সেই মানুষগুলোকেই দিন।
দক্ষিণ ভারতীয় চিত্রনায়কদের আমি ঠিক চিনি না, নাম শুনলেও আমার মনে থাকে না, কিন্তু সেদিন একটি প্রতিবেদনে পড়লাম, তাদের মাঝে একজন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, – অনেক হয়েছে, আর না! যেখানে উক্ত্যক্ত করে প্রেম আদায় করা হয়, এমন সিনেমাগুলোতে তিনি আর অভিনয় করবেন না। আর এই টনকটি তাঁর নড়েছে তখনই, যখন তাঁর এক নারী সহকর্মীকে এক প্রণয়প্রার্থী দিনের পর দিন বিরক্ত করে গেছে, ধরা পড়ার পর সেটিকে সে ‘প্রেম’ বলে দাবি করেছে। সেই চিত্রনায়কটি তখন অনুশোচনায় ভুগেছেন, তাঁর সিনেমায় তো এমন দৃশ্য বহু আছে, – সত্যিকার জীবনে হলে একজন মেয়ে কতখানি হেনস্থার শিকার হয়, সেটি তিনি এখন স্বচক্ষে দেখেছেন।
আমরা যারা উপমহাদেশে ছোট বড় পর্দায় বা গল্প উপন্যাসের পাতায় এমন “প্রেম” দেখে অভ্যস্ত, আমাদেরও বুঝতে সময় লাগতেই পারে। কিন্তু, দেরিতে হলেও, শিখুন। আপনার জীবনের নাবিলা আপনাকে “না” বলতেই পারে, আপনি আত্মসম্মান আর নাবিলার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মানকে “হ্যাঁ” বলুন। আখেরে লাভ, – আপনারই!