বাঁচে মানুষ কতভাবে!

রীতা রায় মিঠু:

ক্রিসমাস সিজন, ওয়ালমার্টে কাস্টমারের ভিড়। কাজে ব্যস্ততা আমার ভালো লাগে, কিন্তু খারাপ লাগে যখন সহকর্মিরা ওদের দিক থেকে কাস্টমারদের আমার রেজিস্টার দেখিয়ে দেয়। খারাপ লাগাটুকু মনের ভেতর পুষে রাখি, কাস্টমার লক্ষ্মী, লক্ষ্মীকে অবহেলা করতে পারি না।
আজও আমার রেজিস্টারে প্রচণ্ড ভিড়, এর মধ্যেই লক্ষ্য করলাম পাশের সহকর্মির রেজিস্টারে একজন কাস্টমার লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।

কাস্টমারটিকে এর আগেও দুই একবার দেখেছি। তাকে দেখলেই আমার খুব অস্বস্তি হয়। আফ্রিকান আমেরিকান সে, বয়স কত বোঝা যায় না, তবে বুড়ো। গরীব বুঝা যায় পরনের পুরনো নোংরা পোশাক দেখে। আমার অস্বস্তি পোশাক দেখে নয়, দূর থেকে লোকটার কষ্ট দেখে অস্বস্তি হয়।

কষ্টটা কী রকম! প্রায় ছয় ফিট উচ্চতা, রোগা পটকা লোকটির মাথা লোহার খাঁচা দিয়ে আটকানো। খুব সম্ভবত লোকটি খুব ভয়ঙ্কর দূর্ঘটনায় পতিত হয়েছিল। তাতে তার বুকের খাঁচা, ঘাড়, মেরুদন্ড ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়ে যায়। কারণ খাঁচা শুধু মাথার সাথেই লাগানো নয়, তার বুকে পিঠেও লোহার খাঁচা আছে, তার শার্ট সামনের দিক, পেছনের দিক থেকে উঁচু হয়ে থাকে। মাথার খাঁচাটা বর্গাকৃতি, চারদিকে লোহার চওড়া পাত দিয়ে ট্রেনের জানালার মতো খোপ খোপ করা। খাঁচার ভেতরে মাথাটা খুব বেশি নড়াচড়া করতে পারে না মনে হয়, তা থেকেই ধারণা করি, ঘাড়ের হাড় ভেঙ্গে গেছে। দূর থেকে দুই একদিন মানুষটাকে দেখে এত জটিল অবস্থা বুঝিনি, আজ কাছে থেকে দেখে যতখানি বুঝলাম।

পাশের রেজিস্টারের সহকর্মি মহিলাটি সেই লোকটিকে আমায় দেখিয়ে দিল। তাতেই আমার মেজাজ খিঁচরে গেলো, মুখের ভেতর তেতো লাগলো। কারণ এর কিছু আগেই আরেক সহকর্মি আরেক মাথা খারাপ বুড়োকে আমার কাছে পাঠিয়েছিল। সেই বুড়োকে আমি সহ্য করতে পারিনা, ভীষণ ত্যাঁদড় বুড়ো। এত নোংরা হয়ে থাকে যে তাকে দেখা মাত্র মমতার বদলে গা ঘিন ঘিন করে। তার কোন কাজ নেই, সরকারি পয়সা পায়, খাবার ভাতা পায়। সে প্রতিদিন ফোন নিয়ে ওয়ালমার্টে আসবে। প্রতিদিন তাকে ফোন চালানো শেখাতে হয়, প্রতিদিন তার ফোন থেকে পিকচার কমপিউটারে ট্র্যান্সফার করে দিতে হয়। কথা বলতে গেলে তার মুখ থেকে থু থু ছিটকে বের হয়, মুখ থেকে বাচ্চাদের মত লালা ঝরে, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।

গতকালও সে এসেছিল, চলে যাওয়ার পর দেখি আমাদের রেজিস্টারের কাউন্টার টেবলে তার লালা। আমি নাক মুখ কুঁচকে ফেলেছি, আমার সিনিয়র সহকর্মি তাড়াতাড়ি পেপার টাওয়েল দিয়ে সেই জায়গা মুছে দেয়ার পর আমার শান্তি। আমার একটু এসব ব্যাপারে পিত পিতি আছে। আজও সেই খাটাশ বুড়ো এসেছিল, আজও লালা ফেলে গেছে। সেজন্য আমার মেজাজ আধ খিঁচরা হয়েই ছিল। তার মধ্যে সেই খাঁচার ভেতর মাথা থাকা বুড়োকেও আমার দিকে আসতে দেখে মেজাজ পুরোই খিঁচরে গেলো।

যাই হোক, কাস্টমার লক্ষ্মী, মেজাজ খিঁচরা খিঁচরি নিজের ভেতরেই রাখতে হয়। আমিও হাসি মুখে বুড়োকে জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে হেল্প করতে পারি। জিজ্ঞেস করেই ভড়কে গেলাম। বুড়ো কিছু বলার জন্য মুখ ফাঁক করতেই মুখ ভর্তি থুতু দেখলাম শুধু, কথা কিছু শুনতেই পেলামনা। বুড়ো নিঃশব্দে কথা বলছে, মানে কোন সাউন্ড হচ্ছেনা অথচ কথা বলছে। আমি বোবাদের কথা বুঝতে পারি, বোবাদেরকে কথা বুঝিয়ে বলতে পারি। এই বুড়োর কথাও বুঝতে পারতাম যদি তার ঠোঁট নাড়ানো দেখতে পারতাম। আমি বুড়োর ঠোঁটের দিকে তাকাতে পারছিলামনা, কারণ দুই ঠোঁট জুড়ে শুধু থুতু। এত অসহায় বোধ করছিলাম, সে কাস্টমার, তার কি প্রয়োজন আমাকে জানতে হবে। ঐ বজ্জাত সহকর্মি ইচ্ছে করে বুড়োকে লাইন ভেঙ্গে আমার কাছে পাঠিয়েছে।
বুড়োর দিকে তাকালাম, থুতু দেখিয়েই বুড়ো বলতে চাইলো, তার একখানা ফোন চাই।
জিজ্ঞেস করলাম, কোন কোম্পানির ফোন?

বুড়ো হাত উলটে বলে, সে জানেনা। তাকে নিয়ে গেলাম ফোনের কেইসগুলোর কাছে। সব দেখে বুড়ো একটা ফোন আঙ্গুল দিয়ে দেখালো, ফোন নিলাম। এরপর বুড়ো কি বলছে, বুঝতে পারছিনা। বুঝবো কি করে, আমি তার মুখের দিকে তাকাতেই চাইছিনা। তবুও বাধ্য হয়ে আবার তাকালাম। ঠোঁট নড়াচড়া দেখে জিজ্ঞেস করলাম, মিনিট কার্ড কিনতে চাইছো?
থুতুতে মুখ ভরিয়ে বুড়ো নিঃশব্দে উচ্চারণ করলো, হ্যাঁ মিনিট কিনতে চাই।

আমি তিন রকমের কার্ড এনে বুড়োকে দেখালাম, কোনটা চাও? বুড়ো ৩৫ ডলারের মান্থলি প্ল্যান কার্ড দেখালো। এবার দাম দেয়ার পালা। মূল্য হয়েছে ৭০ ডলার। বুড়ো তার নোংরা, বাঁকা কোমর থেকে নীচে নেমে আসা প্যান্টের পকেট থেকে খুবই নোংরা ওয়ালেট বের করলো। ওয়ালেট থেকে কুঁচকানো ৫ ডলারের কয়েকটা নোট বের করল। আমি নোটগুলো হাত বাড়িয়ে নিলাম, গুছিয়ে সাজালাম। গুনে দেখলাম ৩০ ডলার হয়েছে। আরও ৪০ ডলার লাগবে।

বুড়োর কাছে বোধ হয় আর টাকা নেই। এদিকে অনেক কাস্টমার লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে। আমি কি করি! বুঝতেও পারছিনা বুড়োর আরও কোন পকেট আছে কিনা, বুড়ো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দুই ঠোঁট ফাঁক করলেই এক দলা থুতু ঝুলতে থাকে, ভয়ঙ্কর দৃশ্য! ঠোঁট নড়িয়ে বুড়ো কি বলল বুঝলামনা, আমি তাকে বললাম, আরও ৪০ ডলার লাগবে যে। সে খাঁচার ভেতর থাকা মাথাটিকে একটু ঘুরিয়ে কাকে খুঁজলো মনে হলো। লাইনে দাঁড়ানোরা উসখুস করছে, আমি বুড়োর ট্র্যাঞ্জেকশান এবর্ট করে দিলাম। বুড়োকে বললাম, ফোন আর কার্ড আমার কাছেই আছে, তুমি যখন রেডি হবে আমি আবার চেক আউট করে দেবো। এখন আমি অন্য কাস্টমারদের হেল্প করি, কেমন?

অন্য কাস্টমারদের চেক আউট করছি কিন্তু মনের ভেতর খচ খচ করছে। মাথার ভেতর থেকে থুতুর ব্যাপারটা একেবারেই হালকা হয়ে গেছে, সেখানে ভর করেছে অন্য ভাবনা। একজন মানুষ, যার ঘাড়, মাথা, বুক পিঠ লোহার খাঁচার ভেতর বন্দী হয়ে আছে, এই খাঁচা সরে গেলেই সে ঝড়ে উপড়ে যাওয়া গাছের মত ভেঙ্গে পড়ে যাবে, যার কন্ঠস্বর হারিয়ে গেছে, ফিসফিস আওয়াজে কথা বলার সময় যার খুব কষ্ট হয়, কথা বলার সময় যার মুখে শুধুই থুতু দেখা যায়, হয়তো সে ঢোঁক গেলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, হয়তো থুতু ফেলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, তাই হয়তো তার ঠোঁটের আগায় কথা আসার পরিবর্তে থুতু এসে জমা হয়। দারিদ্র যার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ছাপ রেখে দিয়েছে, চলৎশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে, আপনজন বলতে হয়তো কেউ নেই। এরপরেও সে বেঁচে আছে, তারপরেও তাকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে।

সে থাকে হয়তো সরকারি ‘হোমে’, হোম থেকে সপ্তাহে গাড়ি আসে ওয়ালমার্টে, সেও আসে। তারও ফোন দরকার হয়, যে সামনাসামনি কথা বুঝিয়ে বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, তাকেও ফোন সাথে রাখতে হয়! কখন কাকে দরকার হয়, কখন পুলিশ কল করতে হয়, কখন ডাক্তার কল করতে হয়! নাকি তারও আপনার জন আছে, ছেলেমেয়ে আছে, হয়তো দূরে থাকে। তাদের কাছে ফোন করলে নিশ্চয়ই তারা হেলো বাবা’ বলে কথা বলে। বুড়ো এপাশ থেকে ঠোঁটের ভাঁজে থুতু জমা রেখেই ফিস ফিস করে ‘মাই চাইল্ড’ বলে, ওপাশ থেকে চাইল্ডরা বাবার কথা শুনতে না পাক, বাবাতো চাইল্ডের গলার আওয়াজ শুনতে পায়, চাইল্ডের মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে পায়! চাইল্ডেরাই বা কম কি পায়, বাবার নাম্বার থেকে কল এলেই বাবাকে পায়, বাবা বেঁচে আছে জানতে পায়, বাবা তাকে মনে করেছে জেনে নিশ্চিন্ত খুশি হতে পারে!

হঠাৎ করেই আমার মনের ভেতর জমে থাকা বিরক্তি চলে গেলো, সেখানে এসে ভীড় করতে লাগলো অসম্ভব এক ভালো লাগার অনুভূতি। বুড়োকে দেখতে পাচ্ছিলাম, কারো জন্য অপেক্ষা করছে। এবার আমি খুব বেশি বেশি বুড়োর মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম, থুতু টুতুর কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে দেখতে লাগলাম ভেঙ্গেচুরে গুঁড়ো হয়ে যাওয়া দেহটাকে লোহার খাঁচার ভেতর দাঁড় করিয়ে বেঁচে থাকার অদ্ভুত সাহসী এক যোদ্ধাকে।

মনে পড়ে গেলো আমার বাবার কথা। সেপ্টেম্বারে বাবা ভয়ানক অসুস্থ হয়ে প্রায় কোমাতেই চলে গেছিলেন। আইসিইউ থেকে পাঁচ দিন পর ডাক্তার সাহেব জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বাবা পরবর্তি ১৯ দিন হসপিটালে যমের সাথে যুদ্ধ করে টিকে গেছিলেন। অক্টোবারের মাঝামাঝি বাবাকে বাসায় নিয়ে আসা হলো, যে বাবা এক মাস আগেও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতেন, তিনি পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন। উঠে বসতে পারেন না, নিজ হাতে খেতে পারেন না, কথা বলতে পারেন না।

নভেম্বরের মাঝামাঝি যখন আমি আমেরিকা ফিরে আসি, বাবা তখন নিজে নিজে শোয়া থেকে উঠে বসতে পারে, নিজে হাতে ভাত খেতে পারে। কথাবার্তাও গুছিয়ে বলতে শুরু করেছে। আমাদের দুঃখ ছিল, বাবা যদি বিছানা থেকে নামতে পারতো তাহলে ডায়াপার ইউজ করতে হতো না। আমেরিকা ফিরে এসেও আমার মাথায় বাবার কথা ঘোরে। অন্য কিছু নয়, বাবা খুব ইনডিপেন্ডেন্ট ছিলেন, অসুস্থ হওয়ার আগেও ভাত খেয়ে নিজের থালা নিজে ধুতেন। সেই মানুষ এখন অন্যের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে, মনে মনে না জানি কত কষ্ট পাচ্ছে।

পাঁচ দিন আগে আমার মেজদা আমাকে ছোট্ট একটা ভিডিও ক্লিপ পাঠালো। ভিডিও দেখে আমি হতভম্ব। মেজদাকে লিখলাম, “মেজদা, তোমার উপর আমার যতো অভিমান জমা ছিল, এই ভিডিও দেখার পর সব ক্ষমা করে দিলাম”।

ভিডিওতে দেখলাম, বাবা জানালার পাশে চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা রেখে পা দোলাচ্ছেন আর পত্রিকা পড়ছেন। এরপর পত্রিকা ভাঁজ করে রেখে টেবিল ধরে কুঁজো হয়ে দাঁড়ালেন। টেবিলের প্রান্ত ধরে এক পা এক পা করে এগিয়ে এসে খাটের প্রান্ত ধরলেন। এবার খাটের প্রান্ত ধরে ধরে এক পা এক পা করে হেঁটে খাটে পা ঝুলিয়ে বসলেন। একটু দম নিলেন, পা দুটো নিজে নিজেই খাটে তুলে আসনপিঁড়ি হয়ে বসলেন। এমন দৃশ্য দেখবো কল্পনা করিনি, স্বপ্নে ভাবিনি, বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসে না।

গতকাল বাবাকে ফোন করেছিলাম, “বাবা, তুমি এখন নিজে নিজে খাট থেকে নেমে চেয়ারে বসতে পারো, দেখে যা খুশি লাগছে”।

বাবা বললো, “এটা তো কিছুই হলো না। আমি যদি হেঁটে বাথরুমে যেতে পারতাম, পায়খানা প্রস্রাবের মতো এমন একান্ত ব্যক্তিগত কাজ কর্মগুলি অন্যের সাহায্য নিয়ে করতে হয়, লজ্জায় মরে যাই আমি। আমি জীবনেও কল্পনা করি নাই, এই অতি ব্যক্তিগত কর্মগুলি অন্যের সাহায্য নিয়ে সারতে হবে। আমি যদি বাথরুম পর্যন্ত যেতে পারতাম, তবে হয়তো শতবর্ষী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারতাম”।
শতবর্ষী হওয়া একটা অভাবনীয় ব্যাপার! কিন্তু তা হবে না, তবে এটুকু বলি, আমি যে কয়দিন বাঁচবো, একেবারে হাত পা ছেড়ে দিয়ে বাঁচা নয়, লড়াই করেই বাঁচবো।

খাঁচার ভেতর থাকা বুড়োটিও লড়াই করে বেঁচে আছে, মনে মনে এই যোদ্ধাকে প্রণাম জানালাম।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.