শেখ তাসলিমা মুন:
হিজাবের উৎপত্তি বিষয়ে অতি সামান্য আমি আমার আগের ছোট্ট লেখাটিতে উল্লেখ করেছিলাম। হিজাবের ভাগ্য তথা হিজাবের উত্থান এবং পতনের দিকগুলো বরং আজ দেখা যাক।
আমরা দেখেছি, শিক্ষিত নারীরা বা চিন্তাবিদরা মুসলিম বিশ্বের নারীদের পিছিয়ে থাকার কারণ নিয়ে ভেবেছে এবং লিখেছে। তারা বুঝেছে, পশ্চিম বিশ্বের নারীদের মতো তারা সামনে এগিয়ে থাকতে পারছে না। এখানে হিজাবের একটি বড় রোল রয়েছে।
হিজাব এখানে শুধু এক টুকরো কাপড় নয়। নারীর প্রতি এক ধর্মীয় আদেশ। যা তাকে স্বাভাবিক চলাফেরার পথে একটি বাঁধা হিসেবে কাজ করছে। কারণ হিজাবে রয়েছে কঠোরতার মেসেজ। যা নারীর মনস্তত্ত্বের উপর ভয়ানক চাপ সৃষ্টি করে। তাকে এখানে অন্যদের থেকে আলাদা করা হয়। তাদেরকে একটি মেসেজ দেওয়া হয় যে, তাদেরকে দেখে পুরুষের কামার্ত হওয়ার কারণ আছে, এবং সেটি তাদের উপর এবং সমাজের জন্য এক ভয়ানক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। তাদের শরীরে মাথায় চুলে হাতে পায়ে সকল জায়গায় সেটি দৃশ্যমান থাকে। তাদের সাবলীল চলাফেরায় এ ধরনের বাঁধা শুধু তাদের শরীরের গতিবিধিকেই সীমিত করে না, মানসিকভাবেও তাদেরকে জড়ো বস্তুতে পরিণত করে। নিজেদেরকে যৌন অবজেক্ট এবং সামাজিক ও ধর্মীয় অন্যান্য বিধানের কারণে তারা তাদের জীবন ও জীবনযাপনকে ঘরের ভেতর সীমাবদ্ধ করে ফেলে। পৃথিবীর অন্যান্য মেয়েদের থেকে মুসলিম নারীদের পিছিয়ে থাকার পেছনে হিজাবের এখানে একটি স্পষ্ট রোল রয়েছে।
এটিকে ভাঙার জন্য ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে লেখালেখি শুরু হয়। কিন্তু হিজাব বার বার মুসলমানদের কেবল ধর্ম নয়, রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। নারীর মাথায় এ কাপড়টি তুলে দিয়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব তাদের মুসলিম আইডেন্টিটিকে তুলে ধরে। নারীর মাথা তখন সারা মুসলিম জাহানের প্রতিবাদ।
কীভাবে বলি, ঊনিশ শতকে মুসলিম বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখবো সেখানে প্রচুরসংখ্যক নারী হিজাব থেকে বেরিয়ে এসেছিল। মেয়েরা সামনে চলে এসেছিল। ইজিপ্ট, ইরান, লেবানন, প্যালেস্টাইন, জর্ডান, মরক্কো, তুরস্কের মেয়েরা হিজাব ছাড়া বাইরে আসতে শুরু করে। বিশবিদ্যালয়ে আসে পাশ্চাত্যের মেয়েদেরই মতো। জিন্স বুটস পরে তারা বেরুতে পারতো। কিন্তু এ অবস্থার পতন ঘটে পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে। পাশ্চাত্য যখন তাদের আগ্রাসন নীতি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য এবং দরিদ্র দেশে অবতীর্ণ হয়েছে ,মধ্যপ্রাচ্য এবং মুসলিম দেশগুলো তখন তার প্রতিবাদ হিসেবে তাদের মুসলিম পরিচয়কে প্রদর্শন করতে নারীকে ব্যবহার করেছে। নিজেদের মুসলিম পরিচয়ের প্রতীকী রূপ হিসেবে তখন নারীকেই অবতীর্ণ হতে হয়েছে। নারীকেই মাথা ঢেকে প্রমাণ করতে হয়েছে তারা মুসলমান। এবং পাশ্চাত্যের আগ্রাসন ও সহিংসতার প্রতিবাদ হিসেবে হিজাব ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়ে।
ইরানে শাহের পতনের মাধ্যমে নারীদের ঘরে ঢুকানো হয় এবং সর্বাঙ্গ কালো বুরকায় আবৃত করে দেওয়া হয়। তার আগে ইরানের নারীদের অবস্থান যেকোনো পশ্চিমা নারীর মতোই ছিল। নারী এভাবে রাজনৈতিক অবস্থার শিকার হয়ে হিজাবে আবৃত হতে বাধ্য হয়েছে। এবং হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিরাট একটি অংশ পাশ্চাত্যে যুদ্ধ রিফিউজি হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। তারা শুধু নিজেরা আসেনি। সাথে নিয়ে এসেছে তাদের ধর্ম, আচার-আচরণ, প্রথা, ব্যবহার। এটি এ সমাজে একটি প্রকাশ্য কনফ্লিক্ট তৈরি করেছে। এ কনফ্লিক্টের প্রধান শিকার নারী। মেইনস্ট্রিম থেকে আলাদা থাকার একটি অস্ত্র নারীর মাথায় হিজাব। সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে বসবাসে সংখ্যালঘুদের অভিজ্ঞতা কোনকালেই কোনো দেশেই সুখকর হয় না। মেইনস্ট্রিমে মুসলিম কালচার একটি দৃশ্যমান কনফ্লিক্ট সৃষ্টি করেছে।
এখানকার অনেকেই মনোভাব প্রকাশ করেছে, ‘আমাদের দেশেও নারীকে মাথায় বিশাল বিশাল হ্যাট পরতে হতো সামাজিকভাবে এবং গির্জায় যাওয়ার সময়। এটাও এক ধরনের পর্দার মতো ছিল আমাদের প্রিমিটিভ পশ্চাদপদ সমাজে। আমাদের নারীদেরও তখন ঘরে থাকার নিয়ম ছিল। এর বিরুদ্ধে আমাদের সামাজিকভাবে লড়তে হয়েছে। পাদ্রীদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। আমরা একশত বছর আগে এগুলো থেকে মুক্ত হয়েছি। আমরা আমাদের সমাজকে লিবারেল করেছি। নারী এবং পুরুষের অবস্থান সমান করেছি। এখন একশ বছর পর আমাদের সমাজের এ চিত্র খুবই বেদনাদায়ক। আমরা আমাদের সমাজে নারীদের এ অবস্থান দেখতে চাই না।’
এখানে হিজাব বিষয়ে যে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে, সেটির প্রতিবাদ স্বরূপ এখানে হিজাবের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা মুসলিম এবং সেটি প্রদর্শনের জন্য তাদের নারীদের মাথায়, ছোট-বড় কন্যাদের মাথায় হিজাব তুলে দিচ্ছে, বলছে, ‘আমরা মুসলমান, এটি আমাদের আইডেন্টিটি’।
এভাবে হিজাব, নারী এবং মুসলিম আইডেন্টি একাকার হয়ে যাচ্ছে। বস্ত্রখণ্ডটি এখন সারা মুসলিম জাহানের আইডেন্টিটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ হিজাবের মেসেজ যে নারীর জন্য সীমাহীন অসম্মান, তাদের দেহকে ঢেকে রাখার এ নির্দেশনামা যে একটি অশ্লীল অন্যায় নির্দেশনামা, সেটাই আবার সমস্ত ধর্মের বর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ সব সময় হয়েছে, হবেও। পশ্চিমের অভিবাসী মুসলিমরা ডিস্ক্রিমিনেটেড অনুভব করে। তার প্রতিবাদ হওয়া অন্যায় নয়। লক্ষ্য করার বিষয়, সে প্রতিবাদে যে বস্ত্রখণ্ডটি ব্যবহৃত হয়, সেটি নিজেই একটি ডিস্ক্রিমিনেশন। সে ডিস্ক্রিমিনেশন নারীর বিরুদ্ধে, নারীর মুক্তির বিরুদ্ধে। নারীকে একটি মাংস পিণ্ড তথা সেক্স অবজেক্ট মনে করে তাকে আবৃত করার বিধান একটি অসম্মানজনক বিধান। যেকোনো নারীর জন্য এ আদেশ অসম্মানকর।
অথচ একজন নারীর শরীরের পর্দা বাধ্যতামূলক করে উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে হিজাব বুরকা পরেই নারী শীর্ষে যাচ্ছে। কিন্তু হিজাব না পরে যাতে সে শীর্ষে যেতে পারে সেজন্য সমাজ রাষ্ট্র আইন এবং পুরুষমনন তৈরি করা হচ্ছে না কেন? আপাদমস্তক না মুড়ে গেলেও তাদের উপর অপরাধ সংঘটিত হবে না, সে শিক্ষা পুরুষ এবং সমাজকে দেওয়া হচ্ছে না কেন? একটি কন্যা সন্তানকে জন্ম থেকে ভুল শিক্ষায় তার মাথা ওয়াশ করে বড় করা হচ্ছে।
এখানে তার স্বাধীনভাবে বড় হবার স্কোপ কোথায়? যে পাপ তার নয় সে পাপের জন্য তাকে কাপড়ের পুটুলি করে তোলা হবে কোন যুক্তিতে? এটি কিভাবে সঠিক এবং ন্যায়বিচারের প্রতীক? সে কেন তার শরীরকে তার একটি স্বাভাবিক অংশ হিসাবে নিয়ে বড় হতে পারবে না?
(লেখাটি শেখ তাসলিমা মুন এর ব্লগ থেকে নেয়া)