রীতা রায় মিঠু:
দেশে পথ চলতে মানুষের গায়ে গা ঠেকে যায়, হাঁটতে গেলে পায়ে পা ঠেকে যায়। ধনীরা আকাশ ছোঁয়া দালান তোলে, রাস্তার জন্য পাঁচ ইঞ্চি জায়গা ছাড়ে না। খেলাধূলার জন্য এক চিলতে উঠোন রাখে না। দালানগুলো এমনভাবে গায়ে গায়ে লাগানো যে বাসিন্দাদের ঘরে দিনের বেলাতেও আলো ঢুকে না। দুই দালানের মাঝে আধ হাত পরিমাণ দূরত্ব,এই ফ্ল্যাটের পুরুষের ঘামে ভেজা শার্টের দুর্গন্ধ পাশের ফ্ল্যাটের তরুণীর নাকে ঝাপ্টা দেয়।
দম বন্ধ করা পরিবেশ চারদিকে। সব সময় আতঙ্ক লাগে, কখন না জানি একটু ভূমিকম্পেই দালান ঘর ভেঙ্গে দূর্ঘটনা ঘটে যায়। না জানি ঝড়ে সাইক্লোনে বন্যার তোড়ে সব ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দেয়। প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার দুশ্চিন্তা তো আছেই, সাথে থাকে রাস্তায় দুর্ঘটনা, বাড়ি ঘরে দুর্ঘটনা, হাটে বাজারে সিনেমা হলে নেমন্তন্ন বাড়িতে দুর্ঘটনার ভয়! এতো মানুষ, গায়ে গায়ে ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েও দুর্ঘটনা ঘটে যায়!
আওয়ামী লীগের বর্ষিয়ান নেতা, চট্টগ্রামের সর্বজন প্রিয় প্রাক্তন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী ইন্তেকাল করেছেন চার দিন পূর্বে। উনার কুলখানি উপলক্ষে মেজবানের আয়োজন করা হয়েছিল। মেজবানে চট্টগ্রামের সকলেই নিমন্ত্রিত ছিল। মেজবানে নাকি নেমন্তন্নেরও দরকার হয় না, মেজবানে যে কেউ অতিথি হয়ে আসতে পারে।
মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ আদিবাসী সকলের কাছে অভিভাবকের মতো। তাই উনার মৃত্যুতে পুরো চট্টগ্রামই শোকাভিভূত। উনার জানাজায় যেমনি লক্ষ লক্ষ মানুষ উপস্থিত হয়েছিল, মেজবানেও এসেছিল লাখ মানুষ। হিন্দু অতিথিদের জন্য আলাদা আয়োজন করা হয়েছিল।
মেজবানে আগত অতিথিদের উপচে পড়া ভিড়ে ঘটে গেছে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। প্রচণ্ড ভিড়ে পদদলিত হয়ে অনেকগুলো মানুষ মারা গেছে! হৃদয় বিদারক ঘটনাটি ঘটেছে যেখানে হিন্দু অতিথিদের জন্য খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। ফলে দেখা গেছে যারা মারা গেছে তাদের সকলে হিন্দু।
দেশে আজকাল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দুর্দিন যাচ্ছে। এমন দুর্দিনে জনপ্রিয় নেতার কুলখানি অনুষ্ঠানে ঘটে গেছে এমন দুর্ঘটনা! এই নিয়ে অস্বস্তিকর গুঞ্জন শুরু হয়েছে। শুরু হয়ে গেছে রাজনীতির প্যাঁচগোঁচ খেলা। এতো বড় এক হৃদয়বিদারক ঘটনা, যার গেছে তার তো গেছেই, যাঁর উপলক্ষে এই মেজবান অনুষ্ঠানের আয়োজন, তাঁদের পরিবারের মানুষগুলোর কী মানসিক অবস্থা হতে পারে!
অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সকল ধর্মের, সকল মতের মানুষ। যারা মারা গেছেন, তাঁরা হিন্দু না হয়ে মুসলমান হতে পারতো, বৌদ্ধ, চাকমা হতে পারতো। এতগুলো তাজা প্রাণ পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে মরে গেলো, কী কষ্ট পেয়েছিল প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার সময়, তা নিয়ে মাথা নিচু করে কেউ একটু ভাববার অবকাশ পাচ্ছে না। সরাসরি অভিযোগ, দেশে ভাতের অভাব, নীরব দুর্ভিক্ষ। তাই মেজবানে ফ্রি খাবারের লোভ সামলাতে না পেরে মানুষগুলো হুটোপুটি করতে গিয়ে পদদলিত হয়েছে।
আরেক দল বলছে, হিন্দুদের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ছোট সেন্টারের আয়োজন করেছে। কোনটা ইচ্ছাকৃত? ‘হিন্দুদের’ বেলায় ইচ্ছাকৃত অবহেলা? কেন? মহিউদ্দিন চৌধুরী কি হিন্দুদের শত্রু ছিলেন? তিনি কি হিন্দুদের কাছে প্রাণপ্রিয় নেতা ছিলেন না? এটা সত্য, অতিথির সংখ্যার তুলনায় কমিউনিটি সেন্টারের আয়তন ছোট ছিল। এটা তো নতুন কিছু নয়, এতো এতো মানুষ দেশে, বড় কোন সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গেলে স্থান সংকুলান হয় না বলে কি অনুষ্ঠান আয়োজন হয় না?হচ্ছে তো, এভাবেই চলছে দেশ। গায়ে গা লাগিয়ে মানুষ চলে, পায়ে পা লাগিয়ে মানুষ হাঁটে। যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে জেনেও এভাবেই চলে সবাই।
বিবাহ আকিকা অন্নপ্রাশন শ্রাদ্ধ কুলখানি– এসবই সামাজিক অনুষ্ঠান, এগুলোকে উপলক্ষ করে সমাজের সকলে একত্রিত হয়। মানুষে মানুষে যতই রেষারেষি থাকুক, সামাজিক এইসকল অনুষ্ঠান আয়োজনের সময় কেউ কারো অমঙ্গল চায় না, অমঙ্গল করেও না। তারপরেও দুর্ঘটনা ঘটে যায়। বিয়ের আসরে ডাকাত পড়ে, আগুন লাগে, আগত অতিথির শিশু সন্তান পুকুরে ডুবে মারা যায়!! এগুলো ঘটে, অহরহ ঘটে।
হিন্দু মুসলমান ব্যাপার নয়, দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। দুর্ঘটনা সব সময় ঘটে, যার ভাগ্য খারাপ সে দুর্ঘটনার শিকার হয়। মেজবানে যেমনি দুর্ঘটনা ঘটেছে হিন্দুদের জন্য নির্ধারিত কমিউনিটি সেন্টারের মাঠে।
আয়োজকগণ হিসেবে ভুল করেছেন হয়তো, উনাদের বুঝা উচিত ছিল, স্থান সংকুলানের অভাবে অতিথিদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হতে পারে, তাতে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হওয়া অসম্ভব নয়! যারা নেমন্তন্ন করবেন, অতিথিদের দেখভাল করার দায়িত্ব তাঁদের উপর বর্তায়। তাঁরা হয়তো ধারণাই করতে পারেননি, শোকের বাড়িতে আরও বড় শোক অপেক্ষা করছে। যাঁরা মেজবান আয়োজন করেছেন, তাঁদের কত বড় শোকের সময় চলছে, এর মধ্যে তাদের আয়োজিত মেজবানে এসে এতগুলো অতিথির মৃত্যু, এ যে কত বেদনার, কত লজ্জার, কত গ্লানিকর!
রাজনৈতিক কারণে, সাম্প্রদায়িক দূরভিসন্ধি থেকে নাসিরনগর ঘটানো হয়, রামু ঘটানো হয়। রাজনৈতিক কারণে নাসিরনগর ঘটেছে, রামু ঘটেছে, সাঁওতাল পল্লী ঘটেছে, রংপুর ঘটেছে—এমন আরও অঘটন ঘটানো হবে সংখ্যালঘুদের ভাগ্যে।
তাই বলে সকলের প্রাণপ্রিয় নেতার কুলখানি অনুষ্ঠানে কোন রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি থাকতে পারে না। দেশের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে ঠিকই, তাই বলে দেশের মানুষ এতটা নিচে নামেনি কুলখানি উপলক্ষ করে সাম্প্রদায়িক বৈরিতা ঘটাবে।
১৭ কোটি মানুষের দেশে এমন দুর্ঘটনা আরও ঘটবে।’মুখ দিছেন যিনি, আহার দিবেন তিনি’ বিশ্বাস বুকে নিয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকলে তো পদদলিত হবেই মানুষ। মানুষ পদদলিত হবে, দালান ভেঙ্গে চাপা পড়বে—
এবার আসি মূল কথায়। মহিউদ্দিন চৌধুরী স্বয়ং মেজবানের আয়োজন করতেন। পত্র-পত্রিকায় তা ছাপা হতো। আজ উনি নেই, চার দিন হলো তিনি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অনন্তলোকে চলে গেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন পরিবার, আত্মীয়স্বজন, রাজনৈতিক সাথী, রাজনৈতিক নেতা বন্ধুসহ লাখ লাখ ভক্ত জনতা। এমন জনপ্রিয় নেতার কুলখানি অনুষ্ঠান চাইলেও সাদামাটাভাবে করা যায় না। উনার কুলখানি উপলক্ষে তাই মেজবানের আয়োজন করা হয়েছে, যা সকলের কাছে যথার্থ মনে হয়েছে।
মেজবানের মতো এতো বিশাল আয়োজন নিশ্চয়ই শোকসন্তপ্ত পরিবারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এমন এক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী, উনার মৃত্যুতে সকলেই খুব আন্তরিকতার সাথে উনার শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে থাকতে চাইবে। মেজবান আয়োজনেও নিশ্চয়ই পরিবারের বন্ধু স্বজনেরা ছিলেন।
আয়োজক যারা ছিলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই আন্তরিকভাবেই অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী মাথায় সব সময় নামাজী টুপি পরে থাকতেন। ধর্মপরায়ণ মানুষটি শুধু নিজ ধর্মের মানুষদেরই নয়, ভিন্নধর্মাবলম্বীদের কাছেও আপনার জন ছিলেন। এমন একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার ব্যক্তিত্ব ছিলেন যিনি, তাঁর জীবনবোধের প্রতি সম্মান রেখে এবং তাঁর জনপ্রিয়তার কথা বিবেচনায় রেখে মেজবানের খাওয়া দাওয়ার আয়োজন অনেকগুলো স্থানে করেছিলেন। খাদ্যাভ্যাসে হিন্দু মুসলমানে কিছু ভিন্নতা আছে বিবেচনায় আয়োজকগণ হিন্দুদের জন্য আলাদা স্থান নির্বাচন করেছেন, তাতে হিন্দু সম্প্রদায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই নিদর্শন দেখে নিশ্চয়ই প্রীত হয়েছেন।
এখন কথা হচ্ছে, হিন্দু অতিথিদের সংখ্যা নিয়ে। আয়োজকরা কি জানতেন না আশেপাশে, কিছু দূরে, নেতার গ্রামে কত হাজার হিন্দুর বসবাস? যে সেন্টারে হিন্দুদের জন্য আয়োজন করেছিলেন, তাতে দুই হাজার মানুষের জায়গা হয়। সেন্টারে হিন্দু অতিথি এসেছিল দশ হাজার। দুই হাজার আসনে দশ হাজার বসতে চাইলে হুটোপুটি ধাক্কাধাক্কি হবেই। কথা হচ্ছে, আয়োজকদের হিসেবে এত বড় গোলমাল হলো কি করে? আয়োজকদের ধারণা ছিলনা হিন্দু অতিথি কত হাজার আসতে পারে!
এমন বিপুল আয়োজনে হিসেবে গড়মিল কিছু হতে পারে, দুই হাজারের আয়োজনে দুই তিনশ কম বেশি হয়। তাই বলে দুই হাজারের স্থানে দশ হাজার? কার দোষ? যারা নিমন্ত্রণ করেছেন তাদের দোষ, নাকি নিমন্ত্রণ পেয়ে যারা এসেছিলেন তাদের দোষ?
ঠিক আছে, আর কোথাও বড় হল পাওয়া যায়নি, স্থান সংকুলান না হলে এক বেলার পরিবর্তে দুই বেলা খাওয়াবার ব্যবস্থা রাখতে পারতেন! আসল কথা হচ্ছে, আপনারা হয়তো ধারণাই করতে পারেননি মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানিতে হাজার হাজার হিন্দু অতিথি উপস্থিত হবেন। আপনাদের হিসেবের ভুলে ঝরে গেছে তরতাজা দশটি প্রাণ, ক্ষতি হয়ে গেছে দশটি পরিবারের। ভুল থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়, আপনারা যদি শিক্ষা নেন তাহলে দশটি প্রাণের বিনিময়ে হলেও আপনাদের বিবেক, জীবনের হিসেবগুলো শুদ্ধ হয়ে উঠুক, তাতে সকলের মঙ্গল হবে।
যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছে, যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বর্তমান দুর্দিনে সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য মেজবান অনুষ্ঠানে অনাকাঙ্ক্ষিত হৃদয় বিদারক ঘটনাটিকে ইস্যু বানাতে চাইছে, তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি, তিন বছর আগে নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে পূণ্যস্নান করতে গিয়ে হিন্দু পূণ্যার্থীদের ভীড়ে পদদলিত হয়ে মারা গেছিলো আটজন। দুই বছর আগে হজ্ব করতে গিয়ে শয়তানকে পাথর ছোঁড়ার সময় হজ্ব করতে যাওয়া লাখো মুসল্লীদের ভিড়ে পদদলিত হয়ে মারা গেছিলো কয়েকশ মুসল্লী। দুটো ঘটনার কোনটিতেই কিন্তু সাম্প্রদায়িক কোনো গন্ধ নেই, দুটো ঘটনার পেছনের কারণ ছিল জায়গার সংকীর্ণতা কিন্তু মানুষ বেশি। এবং অবশ্যই আয়োজকদের অবহেলা দায়ী ছিল।
তবে দুটোই ছিল দুর্ঘটনা, ঠিক তেমনি মেজবানের এই দুর্ঘটনাটিও দুর্ঘটনা, যদিও এখানেও আয়োজকদের কিছুটা দায় থেকেই যায়।
** বিশ্বের উন্নত দেশেও প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটে। উন্নত দেশে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর মানুষ সচেতন হয় যেন আর কোন দুর্ঘটনা না ঘটে। আমাদের দেশে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সবাই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করার পরিবর্তে মুখরোচক গল্প তৈরীতে ব্যস্ত হয়ে পরে, সচেতন হতে ভুলে যায়। ফলে কিছুদিন না যেতেই আবার দুর্ঘটনা ঘটে, আবার ঘটে, আবার ঘটে, আরও ঘটবে, ঘটতেই থাকবে।**