লাল বৌ – সাদা মা

নমিতা দাশ:

ফারিয়া আসমানি, বয়স ১৬, বাবা – মোসলেক ফরিদ; ৫০,০০০ টাকা দেনমোহরে দীঘি গ্রাম নিবাসী আখলাক মিয়ার সৌদি প্রবাসী ছেলে; বয়স ২৬, নাম- আবদুল বাসেত এর সহিত বিবাহে রাজি আছেন?
কাজী: বলুন, কবুল…… ফাইরা কবুল কও, কও কবুল।
আসমানি: কবুল।
কাজী: বলুন, কবুল…।
আসমানি: কবুল।……… কবুল।

উঁচু দেয়ালের একধারে একলক্ষ তেলাপোকা মুখ হাঁ করে আসমানির দিকে তাকিয়ে আছে। হাসপাতালের ইনডোরে ছোট একটা কক্ষে অর্ধেক কাপড় হাঁটুর উপর তুলে; পা- দুইটা ফাঁক করে শুয়ে আছে সে। একজন সেবিকা এসেছেন তার গর্ভের বাচ্চা নিচে নামলো কিনা সেটা পরীক্ষা করতে। উপজেলা হাসপাতালের অন্ধকার ছোট্ট ঘরটিতে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে, ঝড়ের কারণে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। মোমবাতি ধরে আছে আয়া। রাত বাজে দেড়টা। একটা সিএনজি করে দুপুরেই সে আর তার শ্বশুর বাড়ির কয়েকজন এসেছেন এই হাসপাতালে। আসমানির এর আগেও চার বার গর্ভ হয়েছিলো। প্রথমবার ডাক্তার দেখাতে তার শাশুড়ি রাজিই হলেন না।
কর্কশ সুরে একদিন বললেন, আমরার হক্কলোর বাচ্চা হইসে, কই আমরার দেখি কুনো ডাকতর লাগলো না, অখন ইতা কিতা সব আদিলকানি?

বাড়ির আর কেউ এই বিষয়ে আর কোনো কথা বললেন না। আসমানির পা ফুলে উঠলে সেই মা বললেন, ইতা অইবওই। সেইবার আর কিছু ওর সমস্যা হলোও না, কেবল বাড়িতে দাই এসে অনেক টানাটানি করে যখন বাচ্চাটা বের করলো, তখন আর বাচ্চাটা কাঁদলো না, সারা রাত মরা বাচ্চাটার মুখ মনে করে আসমানি কাঁদলো।

নিজের পেটের ব্যথা, রক্তে ভেজা কাপড়ের স্যাঁতস্যাঁতে অনুভূতি, লজ্জার জায়গাটা অনেকটুকু ছিঁড়ে সেখান থেকে রক্ত পড়ছে; এর যন্ত্রণা, কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারলো না। পরদিন তার গায়ে জ্বর। সেই জ্বর কমলো উপজেলার এই হাসপাতালে ভর্তি হবার পর। প্রথম বাচ্চাটা মেয়ে ছিলো। যেহেতু মেয়েটা বাচ্চা ছিলো, তাই ওই বাচ্চার মরা মুখ কারো মনে কোন দাগ কাটেনি।

পরের বারও মেয়ে হলো, এর পরেরবারও মেয়ে। চিকিৎসকের পরামর্শেই পরের বাচ্চাগুলোর সময় তাকে ‘কম্পিউটার (আলট্রাসনোগ্রাফি)’ করানো হয়েছিলো, বলেছে, মেয়ে হবে। প্রতিবার শাশুড়ি তার সাথে যেতেন। ডাক্তার পরীক্ষা করার সময় একটাই প্রশ্ন করতেন, কিতা দেখলা, ছেলে না মেয়ে? আসমানিও এরপর বুঝে গেলো বাচ্চা নয়, শুধু একটা ছেলে দরকার। সেও অধির আগ্রহে চিকিৎসকের মুখের দিকে ‘ছেলে হবে’ এই কথাটা শোনার জন্য অপেক্ষা করতো।
বাড়িতে মেয়ে তিনটাকে রেখে এসেছে তাদের নানার কাছে। এবার তার ছেলে হবে। ডাক্তার বলেছেন, নরমাল করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু রোগীর শরীরে রক্ত নাই, তাই নরমাল হলেও রক্ত লাগবে অন্তত ২ ব্যাগ।

আসমানি, ১৬ বছরের কিশোরী ছিল বিয়ের সময়। তার স্বামীর বয়স তখন ছিল ২৬, আর আজকে আসমানির বয়স ২৬, যখন সে একটা পুত্র সন্তানের জন্ম দিবে। প্রথম যখন মা হয়েছিল, বয়স তখন ১৭। বাচ্চাটা ছিলো মৃত। স্বামী খবরটা পেয়েছিলেন পরের দিন। কথায় কথায় কেউ একজন তাকে বলেছিল খবরটা। ফোনে যখন আসমানি খুব কাঁদলো, তার স্বামী তখন চুপ করে ছিলেন কিছুক্ষণ। কিছুই বলেননি। একের পরের এক মেয়ে হলে একদিন তার স্বামী আর শ্বশুরের কথা আড়াল থেকে শুনে ফেলেছিল আসমানি।

শ্বশুর: ফুয়া না হইলে কিতা করবায় ইবার? দেখতাম নি? ছেলে সন্তান তো একটা দরকার।
স্বামী: ওই, দেখবানে। কিতা আর করার!

আসমানির তিন ননদ, তাদের কারো বিয়ে হয়েছে, কারো হয়নি। বাড়ির সব কাজ আসমানি একা হাতেই সামলায়। চারটা গরু, তাদের খাওয়া দেয়া থেকে শুরু করে, রাখালের খাওয়া, শ্বশুরের খাওয়া, সবার শরীরের সব খবর রাখতে হবে তাকে। তার উপর শাশুড়ির মেজাজ কোনদিনই সে বুঝতে পারেনি। বাসন পুকুর ঘাটে নিয়ে দুই বার ধুয়ে আনলেও তার পছন্দ হতো না। রান্নাতে নুন, মসলা নাকি কোনদিনই আসমানির ঠিকমতো হয় না। ঘরের ময়লা নাকি সব ঘরেই থেকে যায়। এতোকিছুর পর স্বামী যে টাকা তার নামে পাঠায়, সেটাও সে হাতে পায় না।

স্বামীকে সেরকম কখনো কাছেই পায়নি। কেবল বিছানায় অন্ধকারে বাচ্চা জন্ম দেবার প্রয়োজনীয় কাজটুকু ছাড়া। তার স্বামী জানেন না, আসমানি কী খেতে ভালোবাসে, আসমানির প্রিয় ফুল কী, সে কী গান শোনে! কী সিনেমা দেখে, প্রিয় নায়িকা কে? এমনকি এই মেয়ের আসল জন্ম তারিখ কবে! কিন্তু আসমানি ওর স্বামীর সব জানে। গরুর মাংস ছাড়া তার স্বামীর মুখে ভাত উঠে না। লাল উনার প্রিয় রং, তাই এখন আসমানিও লাল পছন্দ করে।

সারারাত চেষ্টার পর সকালের দিকে আসমানির একটা ফুটফুটে ছেলে হলো। ছেলে কাঁদলো, সেই কান্না শুনে আসমানি হাসলও। রক্তে ভিজে যাচ্ছিল আসমানির বেড। লাল হয়ে যাওয়া বিছানার চাদরের দিকে তাকিয়ে আসমানি বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে।

ডাক্তার, নার্স বার বার ওর পরিবারের মানুষদের সাথে কথা বলছেন, রক্ত লাগবে, রক্ত চাই।
জোগাড় করুন, না হয় রোগী নিয়ে বড় হাসপাতালে যান। আমাদের হাতে আর সময় নেই। পরীক্ষার রিপোর্ট বলছে, চার ব্যাগ রক্ত লাগবে, তার উপর আপনাদের রোগীর জরায়ু এখনও নরম হয়ে আছে। কোনো এক জায়গা থেকে এক ডাক্তার রক্ত জোগাড় করলেন, আসমানিকে দুই দিনের পুরানো রক্ত দেয়া হচ্ছে। যে ঘরে বাচ্চা হয়েছিলো, সে এখনও সেখানেই শুয়ে আছে। পেটের মধ্যে কেউ একজন হাত দিয়ে চাপ দিছে, উফ! অসহ্য কষ্ট হচ্ছে। বাচ্চাটাকে ওরা নিয়ে গেছে।

চারপাশের মানুষের কথা এখন ওর কাছে ঝাপসা হয়ে আসছে। তার ঘুম পাচ্ছে খুব। শরীর কাঁপছে, ঠাণ্ডা লাগছে। অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ। লাল একটা বেনারসি শাড়ি পরে আছে আসমানি। হাতে সদ্যজাত শিশু পুত্র। ওর মুখে ঝকঝকে হাসি। কড়কড়ে সোনালী রোদ এসে পড়ছে মা আর সন্তানের মুখে। ওরা বোধহয় কোথাও যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে, বাচ্চাটাকে কোল থেকে কে নিয়ে গেলো? চারপাশটা লাল হতে হতে এতো কুটকুটে অন্ধকার হয়ে গেলো কীভাবে!

সেদিন আর কোনো রক্ত পাওয়া যায়নি। কিছু না ‘বি পজেটিভ’ রক্ত। খুব বেশি দামি কিছু না। হাসপাতালের কর্তব্যরত সবাই যখন রোগীর সাদা ফ্যাকাশে মুখ দেখে প্রথমেই বলেছিল – রক্ত ছাড়া এই রোগী আমরা ভর্তি করবো না, তখন আসমানির কোনো এক দেবর গোত্রীয় কেউ হাসপাতালের দালালের হাতে ১০০টা টাকা দিয়ে বলেছিলো, উপজেলায় ডেলিভারিটা করাও, রক্ত আমরা জোগাড় করবো। বন্ড নেয়া হলো, লিখা ছিল রোগীর মৃত্যু হলে হাসপাতাল দায়ী নয়। পরিবার তাতেও রাজি।

সুতরাং এরপর রোগী ভর্তি না করে কারো কোনো উপায় ছিলো না। আসমানি মারা গেলো শ্রাবণের ১৬ তারিখ। দুই মাস পর আসমানির স্বামী এসে নতুন টুপুর পরে তিন বার কবুল বলে ১৯ বছরের একটা মেয়েকে বিয়ে করলেন। দুই মাসের দুধের শিশু, আর কিছু না হোক, ওকে তো বাঁচাতে হবে।

বেশ ধুমধাম করে বিয়ের দেড় বছরের মাথায় নতুন বৌ‘কে নিয়ে আবদুলের মা হাসপাতালে এসেছেন। বৌ এর দুই মাসের গর্ভ ছিল, রাত থেকে রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছে মনে হয়। তিন বছরের মাথায় সেই নতুন লাল বৌটাও কেমন জানি সাদা সাদা হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

নমিতা দাশ
[email protected]

শেয়ার করুন: