ঈশিতা বিনতে শিরিন নজরুল:
পার্ল এস বাকের সেই কালজয়ী উপন্যাসটি পড়েছেন? দ্য গুড আর্থ? চৈনিক সমাজের জীবনপ্রবাহকে, মাটি যাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তাদেরই একজনের জীবন-প্রবাহের আবর্তনে নির্মিত ‘গুড আর্থ’। নারীর শ্রম এবং সংগ্রামকে সেসময়ের প্রেক্ষাপটে এতো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি!! যেখানে ঘরের সব কাজের পাশাপাশি স্ত্রীকে কৃষির জমির স্বামীর সঙ্গে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হতো; এমনকি গর্ভে সন্তান নিয়েও!! এমনও হয়েছে যে, কাজ করতে করতে ব্যথা উঠেছে, জমির একপাশে গিয়ে একাই সন্তান প্রসব করে, কিছুক্ষণ পর আবার তাকে কাজে নামতে হয়েছে। সময়টা পালটেছে ঠিকই; কিন্তু নারীর শ্রম বিভাজন একই রয়ে গিয়েছে। সবখানেই, তা পশ্চিমা প্রথম বিশ্বে হোক, কী প্রাচ্য বা পূর্বে তৃতীয়, উন্নয়নশীল বিশ্বেই হোক!
সম্প্রতি একটি গবেষণাতে উঠে এসেছে জার্মানিতে নারীর অবসরকালীন পেনশনের বৈষম্যটি! জার্মানিতে বৃদ্ধ বয়সে একজন নারীর তুলনায় একজন পুরুষ দ্বিগুণ পেনশন পেয়ে থাকেন!! গত সপ্তাহে প্রকাশিত ইকোনমিক এন্ড সোশ্যাল সায়েন্স ইন্সটিটিউট এর একটি গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে, প্রায় ৫৩% জেন্ডার পেনশন গ্যাপ বিদ্যামান! নারী ও পুরুষ-উভয়ের রাষ্ট্রীয়, করপোরেট এবং প্রাইভেট পেনশনের ওপর গবেষণাভিত্তিক বিশ্লেষণের পরই গবেষকরা এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন।
২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পুরুষ পেনশন থেকে প্রতি মাসে গড়ে ১,১৫৪ ইউরো পান, যেখানে নারীরা প্রতি মাসে পেয়ে থাকেন ৬৩৪ ইউরো, প্রায় ৪৫% এর মতো বৈষম্য!! গবেষকরা মনে করছেন জার্মানির প্রেক্ষাপটে সব অবসরপ্রাপ্ত নারীদের জন্য শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রীয় পেনশন কাঠামো থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়; কারণ অনেক নারীই আছেন যারা করপোরেট বা প্রাইভেট পেনশন অনেক কম পান, বা অনেকে কিছুই পান না। যখন কর্পোরেট পেনশনের প্রসঙ্গ আসে তখন এই পেনশনের তফাতটি আরও বেশি হয়ে যায়; পুরুষদের প্রতি মাসে ৫৮৩ ইউরো, যেখানে নারীরা পাচ্ছেন ২৪০ ইউরো!! ৫%পুরুষ এবং ২% নারী ব্যক্তিগত পেনশন থেকে মাসিক পান যথাক্রমে ৪৮৫ এবং ৩১১ ইউরো!! কেন বলুন তো?
বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে যে, পেনশন সিস্টেমের এই তিনটি ক্ষেত্রে এধরনের পার্থক্য শুধুমাত্র প্রথাগত শ্রমবিভাজনের কারণেই হয়ে থাকে। দেখা গিয়েছে যে, পুরুষের তুলনায় কর্মজীবী নারীদেরকে নিজের সন্তান বা পরিবারের সদস্যদের দেখাশোনা করার জন্য ছুটি বা ডে অফ বেশি নিতে হয়; বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদেরকে বাধ্য হয়েই পার্ট-টাইম জব করতে হয়, যে কারণে তারা ২০% কম বেতন পান। এসব কারণেই তারা পুরুষের চেয়ে অনেক কম পেনশন পেয়ে থাকেন নিজেদের যোগ্যতা, দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও!!
পশ্চিমা সমাজে তুলনামূলকভাবে বেশি পুরুষেরা ঘরের কাজ করে থাকে। স্বামী ও স্ত্রী দুজনে মিলেই সামলান সবকিছু, পার্কে মাঝে মাঝেই দেখতাম বাবারাও কী সুন্দর সন্তানের ডায়াপার বদলে দিচ্ছে, অথবা সকালে উঠে যে যার মতো ব্রেকফাস্টটা তৈরি করে খেয়ে নিচ্ছেন। সন্তানদেরও একইভাবে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন ঘরের কাজে সহায়তা করার, সে ছেলে হোক কী মেয়ে, সে ছোট হোক কী বড়।
অথচ, দেখুন এই সমাজেও নাকি নারীদেরই অন্য সব সমাজের মতোই পরিবারের সেবার, দেখাশুনা বা অন্যান্য দায়িত্ব পুরুষের তুলনায় নারীকেই বেশি পালন করতে হয়। ফলস্বরূপ দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও নারীর শ্রম যেন কর্মক্ষেত্রের চেয়ে বাড়ির জন্যই টেকেন ফর গ্র্যান্টেড!! সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিয়ে তবেই তাকে কর্মক্ষেত্র বা ক্যারিয়ারের কথা ভাবতে হয়!!
অনেকেই বলেন, প্রথম বিশ্বে নারীরা নাকি কোন বৈষম্যের শিকার হয় না। বিশেষ করে, কোন রাষ্ট্রপ্রধান নারী হলে তো কথাই নেই, সকলে ভাবতে থাকেন নারীকূলের ক্ষমতায়নের জোরের কথা। অথচ টানা চতুর্থবারের মতো জার্মান চ্যান্সেলর হয়েছেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল, তারপরেও এই অবস্থা!! আমাদের দেশে শুনতে হয় নারীদেরই তো যুগ নাকি এখন!! ক্ষমতায়নের যুগ,পার্লামেন্টে নারী, ঘরে নারী, বাইরে নারী…!!! নারীর ক্ষমতায়ন একটি অতি অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট ও অনিশ্চিত প্রপঞ্চমাত্র।
দিনশেষে মস্ত কর্পোরেট বসও নারী হিসেবেই চিহ্নিত হয়! দিনশেষে পরিবারের প্রয়োজনে নারীকেই কাজ করবে কী করবে না, এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়! দিনশেষে অফিসে কাজ করে এসে নারীকে বাড়ির সব কাজ সামলাতে হয়!
দিনশেষে প্রবাসী ছেলের খাওয়া দাওয়ায় যেন অসুবিধা না হয় এজন্য তড়িঘড়ি করে বউ পাঠানো হয়! দিনশেষে বাচ্চার হাগু মাকেই পরিস্কার করতে হয়; কারণ বাই ডিফল্ট কিছু কাজ নাকি মায়েদের ওপরেই! একজন বাবা ইচ্ছা করলেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে পারেন, একজন মা পারেন না; একজন বাবা ইচ্ছা করলেই অফিসিয়াল ট্যুর বা অফিস পার্টিতে এটেন্ড করতে পারেন, এমনকি যতক্ষণ ইচ্ছা, কিন্তু একজন কর্মজীবী মা সেটা পারেন না, পারলেও মনে হাজারটা ভয়ে থাকতে হয়….. এই বুঝি বাচ্চা কাঁদলো, এই বুঝি স্বামীর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এই বুঝি থেকে আর বেরোতেই পারে না…. আর বাই ডিফল্ট সব কাজই নারীর ঘাড়ে বর্তায়!!
আহা রে জীবন!! নারী জীবন!!