শেখ তাসলিমা মুন:
নাম কেবল নাম নয়, তাঁর পরিচয়। এ পরিচয় পুরুষ সন্তান এবং নারী সন্তানের ক্ষেত্রে অবশ্যই একই অর্থ বহন করে না। ইসলাম নারীকে দানিয়াছে শ্রেষ্ঠ সম্মান। কিন্তু জন্মের সময় খুশির ক্ষেত্রে দুরকম বিধান করা হয়েছে। ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে আযান দেওয়ার বিধান থাকলেও কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে সেটি নেই। নামকরণ বা আকিকা অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ছেলে সন্তানের আকিকায় দুটো পশু, কিন্তু কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে একটি পশু জবাই করে আকিকার বিধান রেখেছে। খুব সরল উদাহরণ।
নারী এবং পুরুষ সন্তান আগমন ও নামকরণ এসব রিচুয়ালে নারী এবং পুরুষ সন্তানের পার্থক্য যথেষ্ট পরিস্ফুট। কিন্তু কেবল ইসলামেই এ মনোভাব সেটি কিন্তু নয়। এটি সকল ধর্ম এবং প্রিমিটিভ সমাজে দৃশ্যমান। কন্যা সন্তানকে আসলে বড় করা হয় অন্যের বাড়ির মানুষ হিসেবে। সে বাবার বংশের কেউ নয়, বিয়ের পর স্বামীর পরিবারের সন্তান ধারণ করে স্বামীর বংশ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে, এটাকে সামনে রেখেই একটি পরিবার একটি কন্যা সন্তানকে বড় করে তোলে। এ স্পষ্ট কারণেই তাদেরকে বাবার বংশ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক রাখা হয়। ঠিক একইভাবে মেয়েটির বাবার বাড়িতে আরেকটি মেয়ে আসে এ বংশের মানুষ উৎপাদন করতে। তার গর্ভের সন্তান পিতৃতান্ত্রিকতার রক্ষাকবচ। সেটাই তাঁর বড় পরিচয়। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজও কতো প্রিমিটিভ শুধু এটুকুন ভাবলেই স্পষ্টভাবে বুঝা যায়।
অথচ বিষয়টি বিপরীত হওয়ার কথা ছিল। যে বংশধর প্রবর্তনে পুরুষকে মুখাপেক্ষী থাকতে হয় অন্যের গর্ভের উপর, সেই গর্ভের মানুষটিকে কতো সুকৌশলে তার জন্ম পরিচয়কে পরিবর্তিত করে কনভারটেড করে নেওয়া হয়। সে হয় অধিনস্থ। পরিবর্তিত পরিচয়ের মানুষ। কিন্তু পুরুষের জন্ম থেকে পাওয়া পরিচয়কে পরিবর্তন করতে হয় না।
একটি পুরুষ সন্তানের নাম উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক আব্দুর রহমান মোল্যা। কন্যা সন্তানের নাম মোসাম্মৎ নাসিমা খাতুন। এসব নামের অবশ্যই ইতিহাস এবং মিনিং রয়েছে। মুসলিম এরিস্টক্র্যাট সৈয়দ এবং সৈয়দা দিয়ে নামকরণ করে থাকলেও অধিকাংশ পরিবারে মেয়েরা বাবার বংশ এবং উপাধি ধারণ করে না। সে নামেও তাদের আকিকা করানো হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খাতুন, খানম, পারভিন ইত্যাদি দিয়ে অলংকৃত করা হয়। এমনকি যাদের বংশ খান নয়, সে বাড়ির মেয়েদের খানম, খাতুন, মোসাম্মৎ, অনেকটা ‘মিস’ এর পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যখনই তারা বিবাহিত হয়, তাদের নামে বেগম ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে বেগম ‘মিসেস’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
শ্রেণি সমাজে মুসলিমরা আশরাফ এবং আতরাফে বিভক্ত। আশরাফ শ্রেণি মেয়েদের নামে কিছুটা পরিবর্তন আনে। এটা দিয়ে সামাজিক স্ট্যাটাস নির্ণয় করা হয়। তারা গালভারী শব্দ ব্যবহারে যত্নশীল হয়। যেমন সৈয়দা গুলমহল আখতার। ইত্যাদি ধরনের।
হিন্দু নারীদের অবস্থাও কম নাজুক ছিল না। মেয়েদের নামের পর দাসী যুক্ত করা খুব কমন ছিল।
এক সময় শিক্ষিত মুসলিম পরিবারে কিছু ঘটনা ঘটে। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের নকলে অনেক মুসলিম শিক্ষিত নারীর নাম বদলে যেতে থাকে। বিবাহিত মুসলমান নারীরা স্বামীর আফটারনেইম না, তাদের ফার্স্টনেইম যুক্ত করতে থাকে। যেমন আমার মায়ের নাম ছিল বেগম মনোয়ারা সালাম। আমার বাবার নাম ছিল শেখ আব্দুস সালাম। আমার মায়ের নাম বেগম মনোয়ারা শেখ হয়নি, হয়েছে বেগম মনোয়ারা সালাম। তিনি তাঁর স্বামীর ফার্স্টনেইম পেলেন। সে সময় সেটি ছিল নারীর জন্য বিরাট সম্মান। সোজা কথা? নারী এখন তাঁর নামে স্বামীর নাম পাচ্ছেন। বিপ্লব একেবারে। এরও পরে বিবাহিত কাপলকে সম্বোধন করা হয় স্বামীর আফটার নেইমে, যেমন মি. এন্ড মিসেস খান বা মি. এন্ড মিসেস আহমেদ। এ সম্বোধনগুলো ইংরেজি কালচারের প্রতিফলন হিসেবে প্রবর্তিত। এবং কেবলমাত্র শিক্ষিতদের ক্ষেত্রে।
প্রবাসে বাঙালি সমাজে আরও একটি বিশাল ঘটনা যোগ হয়েছে। মি. এন্ড মিসেস খান নয়। বা খান ভাবীও না। মহিলার পুরো নামটি গায়েব। ছেলের আফটারনেইমের সাথে ভাবী যুক্ত করে ডাকা হয়। যেমন মোশাররফ ভাবী। মোশাররফ আসলে তাঁর স্বামীর ফার্স্টনেইম। সেই নামটি ধরে তাকে ডাকা হয় ভাবী বা মামী যোগ করে। নিজের নাম যে তাঁর ছিল সে ভুলেই যায়। অন্তত বাঙালি সমাজে।
সন্তানের মায়ের পরিচয় যোগ করা এখনও সুদূরপ্রসারী। পশ্চিম ইউরোপ বিশেষ করে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো মেয়েরা বিয়ের পর ডাবল আফটার নেইম বহন করে। এবং সন্তানদের ক্ষেত্রেও বাবা এবং মা উভয়ের আফটারনেইম দিয়ে তাদের নাম রেজিস্ট্রি করা হয়। কেউই নাম বদল করছেন না। যে যার নাম বহন করছেন।
এক পরিবারের অন্তর্ভুক্তির একটি আকাঙ্ক্ষা, এমনকি উন্নত শিক্ষিত মানুষের ভেতরও কাজ করে। পরিবারের প্রাচীন কাঠামো থেকে মানুষ এখনও বেরুতে পারেনি।
মানুষ যত নিজের গুরুত্ব অনুভব করবে, সে বুঝবে নিজের পরিচয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আমি মিসেস আহমেদ হতে পারি। দুর্ভাগ্যবশত আহমেদ পরিবার থেকে ছিটকে যাওয়ার কারণ ঘটলে আমার আবার নাম বদল করার দরকার হয়ে পড়ে। এ পরিবর্তন এতো স্থুল মোটা দাগের লজ্জা হয়ে আসে, যা প্রতিটি নারীর জন্য পীড়াদায়ক হওয়া উচিত।
নিজের আপন পরিচয়কে আড়াল করতে সমাজ-ধর্ম-আইন-পদ্ধতি-তন্ত্র কত ব্যবস্থা সাজিয়ে রেখেছে। নারীকে অন্যের পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে। অথচ এর কিছুই একজন পুরুষের জন্য দরকারি নয়। শুধু এটি ভাবলেই নারীর কাছে নাম নিয়ে এ কারসাজির নির্লজ্জতা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হয় না।
আমি পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছি অনেক আগে। আমার বাচ্চারা আমার আফটারনেইম বহন করে। আমার আফটারনেইম আমার বাবার থেকে নেওয়া। বাবার ফার্স্টনেইম থেকে লাস্টনেইমকে আমি প্রিফার করেছি। বাবার বংশ শেখ। সেটি বহন করা তখন সহজ ছিল না। এটি নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছিল। মেয়েদের নামের আগে ‘শেখ’ কেন হবে? কেমন লাগে? মেয়েরা কোনদিন শেখ হতে পারে না। শেখ অর্থ গোত্র প্রধান। শেখ কেবল আরবে হয়। সেখানে কোন মহিলা শেখ নাই। ইত্যাদি। উত্তরে বলেছিলাম, কে গোত্রপ্রধান সেটা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমার ভাই যদি বাবার বংশের উপাধি নিতে পারে, আমিও পারি। জিদটা আমার সেখানে ছিল। বিয়ের পরও আমি আমার ছোটবেলার নামই রয়ে গেছে, যা আমার কাগজে কলমে সার্টিফিকেটে বহন করে গেছি।
আমি নিয়ম ভেঙ্গেছি আজ নয়। নব্বইয়ের দশকে। আমার বড় ছেলের বয়স ২৬ বছর। ২৫ বছর আগেই তার নামের আগে আমি আমার আফটারনেমও যুক্ত করেছি। পরবর্তীতে আমার ছোট ছেলের ক্ষেত্রেও তাই। আমার দু’ছেলেই তাদের বাবা এবং মা উভয়ের আফটারনেইম বহন করছে। মজার বিষয়, এর জন্য আমার মা এবং ভাই দুজনই প্রতিবাদ করেছে। আমার ছেলেদের তাদের বংশের করেছি, নিয়ম ভঙ্গ করার অপরাধে আমাকে অভিযুক্ত করেছে।
আমি তাঁদের শুধু বলেছি, আমার ছেলেরা তাঁদের বংশের না, তাদের মায়ের বংশের, কারণ তাদের মা পরিচয়হীন নয়। জানিয়ে দিয়েছি , এ নিয়ে আমি কোনো কথা বাড়াতে ইচ্ছুক নই। তারা অসন্তুষ্টি নিয়ে চুপ করেছে।
হায় নারী! তুমি, তোমার নাম ও তোমার পরিচয়!