আফরোজা চৈতী:
আজ ১৬ই ডিসেম্বর। ৪৭ বছরের যাত্রা শুরু। এমন একখানা সিনেমার নাম বলবেন, যেইখানে ধর্ষণের শিকার নারীর বদলে আমরা জাহানারা ইমাম বা সেলিনা পারভীনের মতো কোনও বিদূষী নারীর চরিত্র দেখতে পাইছি? অথবা নারী মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিলের মতন কোনও নারী চরিত্র কোনও চলচ্চিত্রকার ব্যাপক মমতা নিয়া আঁকছেন!
এর উত্তর, না, বানায়নি, আঁকেও নাই। স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ মানেই মাইয়াগুলান অসহায় এর মতন ঝাঁকে ঝাঁকে মিলিটারির জালে ধরা পড়ছে, আর তাগো রেপ কইরা কইরা ছাইড়া দিছে। অথচ সেলিনা পারভীনের মতো যারা ভয় না পেয়ে কলম দিয়ে যুদ্ধ করে গেছেন, তাদের কথা কি এসেছে?
জ্বী, কিছু আসছে এই ডিসেম্বরে যখন স্পেশাল অনুষ্ঠানের তোড়জোর শুরু হয়, তখন তারে নিয়া আমার মতো গাধাটাইপ প্রযোজকরা ততোধিক গাধা নির্বাহী প্রযোজকের তত্ত্বাবধানে এই নারীর ক্ষমতায়ন নিয়া কিছু অনুষ্ঠান মালার ফাঁকে-ফুঁকে আসছে। নাহ! ইনাদের নিয়ে পাঠ্যবইতেও তেমন কিছু নাই। ছোট্ট শিশুরা পাঠ্যবইয়ে পড়ে, যুদ্ধে মেয়েদের নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে, আর ছেলেরা বীরের মতো যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছে। আমাদের শিশুরা বইয়ে সেলিনা পারভীন, শিরিন বানু মিতিল এদের সাহসিকতার গল্প পড়ে না।
শৈশব থেকেই শিশুরা পুরুষতন্ত্রের শেখানো পাঠ শেখে। সে শেখে, মেয়েরা নির্যাতিত হয়, আর ছেলেরা বীর হয়। পেশিশক্তির চর্চা শেখে, মেধাশক্তির নয়। যেমন করে ১৯৭১ এর মেধাবী তিন বোন আসমা, রেশমা, সায়মাদের সেই লোমহর্ষক অভিযানের কথা আমরা দেখি না। দেখি না রুমি-জামির বন্ধুর এই বোনেরা কী অপার মমতায় তাদের মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের অস্ত্র রান্নাঘরের মেঝে খুঁড়ে তার ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলেন। এরকম আরও অসংখ্য গল্প, যা লুকিয়ে আছে আনাচে-কানাচে, সেগুলো খুঁজে সামনে আনার উদ্যোগটাও নেয়নি কোনো গণমাধ্যম। কিছু ব্যক্তি বা কোনও প্রতিষ্ঠান এই সংশ্লিষ্ট কোনো গবেষণাকর্ম করে হয়তো দুটো বা একটা প্রকাশনা বের করেছেন। ব্যস দায়িত্ব শেষ!
বা আমার মতো কিছু ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো স্টাইলে কিছু গল্প উদ্ধার করতে পারছি। আর সেই গল্প নিজের মেয়েরে শুনাই। আমার মেয়েরে বলি, এক মা দিনের পর দিন পনেরো জন মুক্তিযোদ্ধার জন্য রান্না করা খাবার দিনের পর দিন মাথায় বয়ে নিয়ে তিন মাইল রাস্তা হেঁটে পৌঁছে দিয়েছেন। বলি, ভারতে ছেলেদের সাথে অনেক মেয়েরাও গিয়েছিলো যুদ্ধে ট্রেনিং নিতে।
অনেক মা-বোন মরিচের গুঁড়া কমান্ডো স্টাইলে বানাতেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সাপোর্ট করতে। আমি তখন জন্মাই নাই, কিন্তু যারা এখনও বেঁচে আছেন, তারা কি জানতেন না এই ঘটনাগুলো? তারা কি উদ্যোগী হতে পারেন না ঘটনাগুলো জানাতে? যারা এই পোস্টটি পড়ছেন, তারা জানান মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের সেই অসাধারণ কাহিনীগুলো! আপনাদের ছোট ছোট লেখাগুলোই হয়তো প্রকাশ করবে ইতিহাসের একটি অনেক বড় সত্যকে। আর তা হলো নারী শুধু শারিরীক নির্যাতন সয়ে নয়, বরং তার মেধা তার সাহস দিয়েও অবদান রেখেছে আমার মুক্তিযুদ্ধে, আমার দেশ স্বাধীন হবার যুদ্ধে।