নারীর মুক্তি কীভাবে হবে

এন এন তরুণ:

নারীর মুক্তি দরকার- কথাটা বললে এটা স্বীকার করে নেয়া হয় যে, ‘নারী বন্দী’। এরপর প্রশ্ন আসে, নারী বন্দী কার কাছে? নারী কি শুধুই পুরুষের কাছে বন্দী? নাকি সে নিজের কাছেও বন্দী?

নারী নিজের কাছে কীভাবে বন্দী, তা আলোচনার আগে দেখা যাক, নারী পুরুষের কাছে কীভাবে বন্দী অর্থাৎ নারীর বন্দীত্বের রূপ বা ফর্মগুলো কী কী। নারী যে কারাগারে বন্দী, তার নাম ‘পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের ভাবনা বা কনসেপ্ট’। পুরুষের ধারণা, নারীর কর্মক্ষমতা বা শক্তি— এমনকি মেধাও তার চেয়ে কম। কেন এ ধারণা? নারীর কর্মক্ষমতা বা শক্তি ও মেধা পুরুষের চেয়ে কম- এমন ভাবনা পোষণের ক্ষেত্রে পুরুষ দুই দলে বিভক্ত: প্রথম দল, যাঁরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, তাঁরা মনে করেন, ঈশ্বরই নারীকে কম শক্তি ও মেধা দিয়ে সৃষ্টি করেছে।

নিরীশ্বরবাদী পুরুষদেরও অনেকে নারীকে পুরুষের চেয়ে কম শক্তি ও মেধার অধিকারী মনে করেন। তাঁরা মনে করেন, নারী জন্মগতভাবে এমন শারীরিক গঠন প্রাপ্ত যে, তা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, নারীকে মাসে একবার ঋতুমতী হতে হয় যখন তাঁর মন-মেজাজ, শরীর সব কাজের জন্য, বিশেষ ক’রে, ঋতুকালে তাঁরা যুদ্ধে যাবার জন্য যোগ্য নয়। নারীর যৌনাঙ্গের গঠন এমন যে, তাঁকে পুরুষ কর্তৃক ধর্ষণের ক্ষেত্রে অসহায় (vulnerable) করেছে।

কথাটা আরও একটু পরিষ্কার ক’রে যদি বলি, এভাবে বলা যায়, একজন পুরুষের পক্ষে নারীকে ধর্ষণ করা যতটা সহজ, একজন নারীর পক্ষে পুরুষকে ধর্ষণ করা অতটা সহজ নয়। অতএব, নারীর পক্ষে অসময়ে বা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় কাজে যাওয়া পুরুষের মতো নিষ্কন্টক নয়। পুরুষবাদীরা নারীকে কম শক্তিসম্পন্ন হিসেবে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে এ রকম যুক্তিই উপস্থাপন ক’রে থাকে।

পূর্বের আলোচনার বাকি অংশে যাবার আগে, পুরুষবাদীদের এই কুযুক্তিটা একটু খণ্ডন ক’রে নেই: একজন নারী বা পুরুষ আসলে একজন ব্যক্তি (personality/individual)— সে রাষ্ট্রের, সমাজের ও পরিবারের একজন সদস্য। রাষ্ট্রের, সমাজের ও পরিবারের বিবেচনায় সে একটি একক সত্ত্বা, একটা ইউনিট শুধু নয়, সে একটা লিগাল এনটিটি (legal entity)ও বটে এবং এই একক সত্ত্বার বা ইউনিটের বা লিগাল এনটিটির ধারণাটা জেণ্ডার-নিরপেক্ষ। একজন ব্যক্তিকে বিবেচনা করতে হবে holistic view থেকে অর্থাৎ কোন কোন কাজে পুরুষের শরীর বেশি উপযোগী আবার কোন কোন কাজে নারী বেশি উপযোগী।

কিছু গুণ নারীর মধ্যে বেশি মাত্রায় বিদ্যমান, যেমন ধৈর্য্যশক্তি যা সন্তান ধারণ, প্রসব ও পালনের ক্ষেত্রে বেশি প্রয়োজন, নারীর মূত্র ধারণের ক্ষমতা বেশি, নারী পুরুষের মতো অত দ্রুত যৌনতার তোড়ে উত্তেজিত হোন না, যা জ্ঞানচর্চার জন্য বা কোনো কাজে মনোনিবেশ করার জন্য সহায়ক। অতএব, দৈব চয়নের মাধ্যমে একজন পুরুষ ও একজন নারী এনে যদি holistic view থেকে দুই জনকে তাঁদের সমস্ত গুণ যোগ করে পরিমাপ করা হয়, দেখা যাবে দুই জনই ১০০ মার্কস পেয়েছেন। অতএব, নারী পুরুষের চেয়ে হেয়- এ চিন্তা অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক।

নারী কীভাবে নিজের কাছে বন্দী? ধর্মের শিক্ষা হলো, পুরুষ নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যদিও নারীকে অনেক অনেক সম্মান দেয়ার কথা বলা হয়েছে সব ধর্মেই, কিন্তু ঐ কথার আগে বা পরে বা অন্য জায়গায় অন্য প্রসঙ্গে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের কথাই বলা হয়েছে আরও উচ্চকণ্ঠে, আরও বেশি ক’রে। যেমন, সনাতন ধর্মে নারীকে দেবী রূপে কল্পণা করার কথা বলা হয়েছে। আবার অন্য জায়গায় বলা হয়েছে, ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তেঃ ভার্যা’ অর্থাৎ স্ত্রীর কাজ হলো পুত্র (কন্যা নয়) সন্তান জন্ম দেয়া। কারণও বলা হয়েছে। পুং নামক নরক থেকে একজন পিতা মুক্তি পেতে পারেন একমাত্র পুত্রের দ্বারা কৃত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মাধ্যমেই।

সনাতন ধর্মের পুরোহিত দর্পনে কোথাও মায়ের আত্মার উদ্দেশে বা তাঁর স্বর্গলাভের জন্য একটা মন্ত্রও নেই। মাতৃ বা মা শব্দটিই সম্পূর্ণ অনুপস্থিত পুরোহিত দর্পনে। কন্যা শব্দটিও অনুপস্থিত সেখানে কারণ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বা শ্রাদ্ধের অধিকার একমাত্র পুত্রের। স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ বলছেন, ‘স্ত্রীর কর্তব্য হবে স্বামীর কথা মতো ঘর-সংসারের কাজে মনোনিবেশ করা।‘ ইসলাম ধর্ম নারীকে কীভাবে দেখে, তা বহুল আলোচিত হয়েছে গত তিন দশকে, যা পাঠক নাস্তিক্যবাদী লেখক-ব্লগারদের কল্যাণে ভালভাবেই জেনেছেন, সন্দেহ নেই।

অতএব, ধর্মই ‘পুরুষ নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ’- এই ধারণা নারী, পুরুষ উভয়ের মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে রোপন করে দিয়েছে, যা নারীর বন্দীত্বের প্রধান কারণ। নারী নিজেও পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বকে মেনে নিয়েছেন। নারী ঘর-সংসারের কাজ করবেন, তা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেও যদি ঘরের বাইরে একই রকম চাকরিও করেন তবুও, নারী পুরুষকে সেবা করবেন, চা বানিয়ে হাতে তুলে দেবেন, রান্না করবেন, খাবার পরিবেশন করবেন, খাবারের থালা পরিস্কার করবেন, তার কাপড় ধুয়ে দেবেন, জ্বর হলে মাথা টিপে দেবেন, পা টিপে দেবেন; কিন্তু স্বামী এ কাজগুলো স্ত্রীর জন্য করবেন না, আবার কোনো স্বামী যদি করতেও চান, স্ত্রী তা করতে দেবেন না, কারণ তাতে পাপ হতে পারে, বা তিনি যদি নাস্তিক হোন, তাহলেও তিনি এটা মেনে নিতে পারেন না, কারণ তার মাইন্ডসেট তাকে বলছে, ‘ঐ সব কাজ নারীকেই মানায়।‘ এভাবেই নারী নিজের কাছে নিজে বন্দী।

নারীর মুক্তি কীভাবে হবে, তা বলার আগে বলে নেই নারীর মুক্তির লক্ষ্মণ কী অর্থাৎ কীভাবে বুঝবেন, নারীর মুক্তি ঘটেছে?
প্রথমতঃ পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে নারীর জন্য পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া মানে নারীর মুক্তি ঘটা। এই অধিকার দৃশ্যমান হতে পারে নারীর সম্পদে ও উৎপাদনযন্ত্রে মালিকনা লাভের মধ্যে, কাজে ও আয় উপার্জনে নারীর জন্য পুরুষের সমান অধিকারের মধ্যে। সম্পদে ও উৎপাদনযন্ত্রে মালিকানা লাভের প্রক্রিয়াটাও হতে হবে জেন্ডার নিরপেক্ষ।

দ্বিতীয়টি হলো, পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে সিদ্ধান্ত তৈরিতে ও নীতি প্রণয়নে নারী-পুরুষের সমান অধিকার। এই অধিকার প্রাপ্তিই হলো নারীর ক্ষমতায়ন। স্থুলভাবে, নারীর ক্ষমতায়নই নারীর মুক্তি। কিন্তু আসলে এই ক্ষমতায়নে কি নারীর পুরোপুরি মুক্তি ঘটে? ঘটে না। নারীর মুক্তি ঘটা মানে উপরেল্লিখিত ‘পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের’ যে মাইন্ডসেট নারী ও পুরুষ উভয়ই ধারণ করে, তা থেকে মুক্তি। নারীর মুক্তির জন্য ঐ মাইন্ডসেট থেকে শুধু নারী মুক্ত হলেই হবে না, পুরুষকেও মুক্ত হতে হবে। পুরুষের মুক্তি ছাড়া নারীর মুক্তি ঘটবে না।

এই মুক্তি কীভাবে ঘটবে? সংক্ষেপে উত্তর হলো, বিজ্ঞানের ও মনস্তত্ত্বের শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি ও মনস্তত্ত্বের জ্ঞানের অভাবে অর্থাৎ অজ্ঞতার কারণেই পুরুষ ও নারী উভয়েই পুরুষকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। এ জন্য দরকার একটা ধর্মবিহীন, বিজ্ঞান ও যুক্তি নির্ভর শিক্ষার ব্যবস্থা (লক্ষ করুন এখানে ‘শিক্ষা ব্যবস্থা’ বলা হয় নি, বলা হয়েছে ‘শিক্ষার ব্যবস্থা’) কারণ জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে পরিবার থেকে, পরিপার্শ্ব থেকে শিশু প্রথম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়ে থাকে যা তার মাইণ্ডসেট তৈরি করে দেয়, যা থেকে বের হওয়া কঠিন।

এমন একটা জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ও সর্বক্ষেত্রে একটা শিক্ষার ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়া ও সুযোগের জন্য চাই প্রগতিবাদী রাজনীতি কারণ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বা উদ্ভাবনের ও ভাল অর্থনৈতিক পলিসির সুফল মানুষের জীবনে পৌঁছুবে কিনা তা নির্ধারণ করে রাজনীতি। একটা প্রগতিবাদী রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে পারে এমন একটা শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষার প্রক্রিয়া চালু করতে।

অতএব, নারী যদি মুক্তি চায়, তাঁকে ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে হবে, বিরাজমান কোন দলে ঢুকে সেটাকে প্রগতির দিকে নিতে হবে অথবা নতুন দল গঠন করতে হবে এবং নারীবাদী নারী ও নারীবাদী পুরুষকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে হবে এবং সমতার দর্শনকে মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ ক’রে একটা জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গড়তে হবে কারণ সর্বক্ষেত্রে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা ছাড়া নারীর জন্য পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব।

*এন এন তরুণ: ইকোনোমিস্ট

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.