একাত্তরের এই দেশ এবং নতুন প্রজন্ম

আসমা খুশবু:

খুব এলোমেলো ঘুরি। আজ টিএসসি তো কাল ইডেন, পরশু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, তো পরের দিন গাজীপুর। বড্ড অস্থির জীবন। পত্রিকায় টুকটাক লেখালেখি করি, বাকি সময় ঘুরি। ঠিক ঘুরি বলা যায় না, আসলে মানুষ দেখি, দেখি প্রকৃতি – জীবন। দেখতে দেখতে বছর শুরু হয়, আবার শেষ হতে চলে। বছর জুড়ে থাকে নানা রকম বৈচিত্র্য। একজনের সাথে পরিচয় হয়, সেই সূত্র ধরে আরেকজন, এমনি করে পরিচয়ের পাল্লা ভারী হয়। জীবনে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়, সাথে গল্পের থলেতে সমৃদ্ধি।

ডিসেম্বর চলছে। সবকিছু কেমন অস্থির লাগে। অস্থির সময়ের একমাত্র আশ্রয় মা। ছুটে যাই সব ফেলে তাঁর কাছে। জানি এই মাস মায়েরও খুব অস্থিরতায় কাটে। তবুও মেয়েকে কাছে পেয়ে নিজেকে সামলে নেন মা। রাতের খাবারের পর মায়ের কম্বলের মধ্যে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকি। সব কাজ শেষে মা এসে যখন পাশে বসে, তখন হাজার বার শোনা গল্প আবার শোনার বায়না ধরি। মায়ের চোখে দেখা একাত্তরের গল্প। এই এক গল্প বলতে মা কখনো না করেন না, শুরু করেন। শেষ করার আগেই মা-মেয়ের চোখ জলে ভরে যায়।

মায়ের বয়স তখন খুবই কম। বাড়িতে বিনোদনের একমাত্র সম্বল রেডিওতে বাড়ির বড়রা লুকিয়ে লুকিয়ে খবর শোনেন। রেডিও শুনে শুনে কত দেশের গান মুখস্ত করে ফেলেছে মা। স্কুলে গেলে জাতীয় সংগীত গাইতে হয়, ‘পাক সার জমিন সাদবাদ’… সবার সাথে গাইতে গিয়ে শুধু ঠোঁট নাড়েন, পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত গান না। ছোট্ট মানুষ, বাড়িতে মা বাবাকে দেখেন দেশের খবর শুনতে, দেশের গান শুনতে। দেশ নিয়ে আলাপ শোনেন কাকাদের সাথে বাবার। এইটুকু শুনেই নিজে নিজে পাকিস্তানি জাতীয় সংগীত গাওয়া বন্ধ করেন।

একদিন খুব সকালে মায়ের ধাক্কায় ঘুম থেকে জাগেন। তখনই তাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি ভাই, আর ছোট দুই বোনকে সাথে নিয়ে মায়ের বাবার গ্রামে রওনা হোন। সাত দিন চিড়া আর পানি খেয়ে থাকেন নৌকায়। সাথে আরও অনেক মানুষ। বোরখায় মুখ ঢাকা এক নারী তার সাথে এক পুরুষ, আরেকটি পরিবার, সাথে পাঁচ সন্তান, তিন মেয়ে দুই ছেলে। বড় মেয়েটির বয়স চৌদ্দ কী পনের। সারা মুখে কালি মাখা। দাড়িওয়ালা দুই ভাই সারাক্ষণ আল্লাহকে ডাকছে। এক বয়স্ক লোক, সাথে তাঁর বউ আর মেয়ে জামাই। এমনি প্রায় বাইশ কী তেইশ জন মানুষে নৌকা ভর্তি। নৌকার মাঝি নিরাপদে নিয়ে যাবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সবাইকে। পথে নৌকা থামিয়ে মিলিটারিরা চেক করে একে একে সবাইকে। বোরখা পরা যে নারীটি সাথে ছিল তাকে এবং তার সাথের পুরুষটিকে, চৌদ্দ পনের বছরের কালিমাখা মেয়েটিকে আর দাড়িওয়ালা দুই ভাইকে মিলিটারিরা নৌকা থেকে নামিয়ে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় বোরখা পরা নারীটি নাকি মাকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেছিল কিছুক্ষণের জন্য। আর চৌদ্দ-পনের বছরের মেয়েটির মা বিলাপ করে কাঁদে, কিন্তু শব্দ নৌকার বাইরে যায়নি। যাদেরকে নামিয়ে নিয়েছে তারা নাকি হিন্দু ছিল, আর কালিমাখা মেয়েটি মুসলমান। এই মানুষগুলোর কথা মা আজও ভুলতে পারেনি।

সাতদিন পর গ্রামে পৌঁছে ভাত খেলেন লবণ ছাড়া। মাঝে মাঝেই সবার সাথে দৌড়ে ধানক্ষেতে লুকোতে যেতেন মা। একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়। বিছানা হাতড়ে নিজের মাকে না পেয়ে উঠে দেখে, মা রান্না করছে ঘরের ভেতরে চুলায় আগুন জ্বালিয়ে, আর তার ছোট মামা বসে আছেন, সাথে তার বন্ধু মামারাও আছেন তিনজন। ছোট মামা খুব বন্ধু ছিলেন মায়ের। তাকে দেখে কোলে নিয়ে অনেক আদর করলেন, জিজ্ঞ্যেস করলেন, বাংলাদেশের নাম শুনেছে কিনা মা, এ যুদ্ধের নাম জানে কিনা, এরকম আরও অনেক কথা। তারা যুদ্ধের জন্য ঘর ছেড়েছেন, তাদের কথা কাউকে জানাতে নিষেধ করলেন। সকাল হবার আগেই মামারা চলে গেলেন। পরের দিন গ্রামে মিলিটারি এলে সবার সাথে আবার ধানক্ষেতে আশ্রয় নিলো মা। ফিরে এসে দেখলো তাদের বাড়িটিতে আগুন জ্বলছে। আগের রাতে মামাদের আসার খবর তাদের কাছে পৌঁছেছে কোনভাবে, তাই এই প্রতিশোধ। বাকি দিনগুলি তাদের গ্রামের আত্মীয়দের বাড়িতেই কেটেছে।

যুদ্ধ শেষ হয়েছে। দেশ স্বাধীন, কিন্তু ফিরে আসেনি মায়ের সেই মামা। কোনো এক অপারেশনে ধরা পড়েন উনি, আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। শুনেছি মায়ের নানু যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিনই নাকি মধ্যরাতে দরজা খুলে চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে বসে থাকতেন ছেলের অপেক্ষায়!

অস্থির আমি কিছুটা শক্তি নিয়ে ফিরে আসি। নতুন কাজে নামি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু মিউজিয়াম নিয়ে একটা ডকুমেন্টরির জন্য তথ্য সংগ্রহের জন্য সেখানে যাই। পরিচয় হয় মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতাসহ আরও অনেকের সাথে। একজন বিপ্লব ভাই (আসল নাম নয়) আমাকে দেখে চমকে ওঠেন। তাঁর মেয়ে দেখতে নাকি আমার মতো ছিল। হাত ধরে অশ্রুসজল কন্ঠে বলেন, তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া একাত্তরের নির্মম ঘটনা। তাঁর পনের বছরের মেয়েকে এক রাতে পাকিস্তানি মিলিটারিরা উঠিয়ে নিয়ে যায়, তাদের সাথে ছিল এলাকার সামসু রাজাকার। সেই পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে তাদেরকে। এই মেয়েকে আর কোনদিন ফিরে পাননি বিপ্লব ভাই, তাইতো মেয়ের বয়স পনেরোতেই আটকে আছে। এই ঘটনার সপ্তাহখানেক পরে বিপ্লব ভাইয়ের বউকে উঠিয়ে নিয়ে যায় মিলিটারিরা, সাথে সেই সামসু রাজাকার। দুই ছেলে আর একটি ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে তিনি বউয়ের ফেরার অপেক্ষা করেন। এখানে-সেখানে খোঁজ নেন মেয়ে আর বউয়ের। কোথাও খোঁজ মেলে না। তিনি বাড়ি ছেড়ে কোথাও পালাননি, কারণ তার তো হারাবার আর কিছু ছিল না। দেশ স্বাধীন হয়। ক্যাম্প থেকে জীবন্মৃত বউকে ফিরে পান। অনেক চিকিৎসা করান। শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হয়তো হোন, কিন্তু নির্বাক মুখে আর কোনদিন একটি কথাও বলেননি। তার জরায়ুর এমন ক্ষতি হয়েছিল যেটা আর ঠিক হবার নয়।

ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। কোন সন্তানের শ্বশুরবাড়ির লোকেরাই জানে না যে তাদের মা একজন বীরাঙ্গনা, তাতে নাকি তাদের লজ্জা হয়, বিয়ে ভেঙে যেতে পারে! সামসু রাজাকার নাকি সংসদে এমপি পদে প্রতিনিধিত্ব করে!

ফিরে আসি একরাশ লজ্জা নিয়ে। বাসে আর উঠি না, হেঁটে চলি সন্ধ্যার ঠাণ্ডা হওয়ায়, এতো ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশকে এ প্রজন্মের এই আমরা কী দিতে পেরেছি!

শেয়ার করুন: