স্মরি মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান

সেলিনা শাহনাজ শিল্পী:

স্বাধীন দেশেই আমার জন্ম। সেই অর্থে আমি মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রজন্ম। মুক্তিযুদ্ধকে জানতে ও বুঝতে হলে এই প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ, চিত্রকর্ম, টিভি চ্যানেল কিংবা চলচ্চিত্রের উপর নির্ভর করতে হয়। এই নির্ভরশীরতার ফলস্বরূপ যা হয়েছে, তা হলো যুদ্ধের কথা ভাবলেই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে অস্ত্র হাতে এক বীরপুরুষের অবয়ব। অন্যদিকে নারীকে দেখতে চাইলে নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার এক নারীর মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলপত্র, নাটক, চলচ্চিত্র সর্বত্র বীরাঙ্গনা বা ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা এতো বেশি বলা হয়েছে যে, তার আড়ালে চাপা পড়ে গেছে নারীর অস্ত্র হাতে বীরত্বের কথা, সাহসিকতার কথা। অধিকাংশ গ্রন্থ, চিত্রকর্ম ও চলচ্চিত্রের প্রণেতা, নির্মাতাগণই বিষয়টিকে দেখেছেন প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে, যেজন্য সমানভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েও নারীরা নারীযোদ্ধা হিসেবে সমান মর্যাদা পায়নি।

আমি ভাগ্যবান এজন্য যে, আমি যে পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছি সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা হয়। ছোটদের সামনে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার ইতিহাস তুলে ধরবার চেষ্টা করা হয়। আমার মুক্তিযোদ্ধা কাকা, মামারা একসাথে হলে খাবার টেবিলে যুদ্ধদিনের গল্প করতে করতে খাবারের হাত শুকিয়ে যেত। তবুও তাঁদের গল্প যেন শেষ হতো না। আর আমরা ছোটরা ঢুলু ঢুলু চোখে অবাক বিস্ময়ে সেই গল্প শুনতাম। সেই গল্প শুনে আমার মায়ের ভূমিকাকে কখনই আমার বাবা, কাকা কিংবা মামাদের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হয়নি।

বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকাকে পর্যালোচনা করা যায়। পাকিস্তানের অপপ্রচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত ও সকল শ্রেণিকে উদ্বুদ্ধকরণ, বোমা তৈরি, অস্ত্রসংগ্রহ-সংরক্ষণ-সরবরাহ ও সংবাদ আদান-প্রদান, সাংস্কৃতিক প্রণোদনা, অর্থ-ওষধ-খাদ্য-বস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসা ও সেবাকার্য, খাদ্য ও আশ্রয়দান প্রভৃতি কাজই মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য অর্জনের জন্য অবশ্য করণীয় ছিল। বলা বাহুল্য, এর প্রত্যেকটি কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ছিল প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে। (তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ ও নারী, বিএনপিএস)

নারীরা পরামর্শক, নিয়ন্ত্রক ও সংগঠকের ভূমিকায় তৎপর হবার সুযোগ পেয়েছিলেন। কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেতৃবৃন্দ সারাদেশেই তৎপর ছিলেন। তাঁরা বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষকে বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত হবার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেছেন। এই তালিকায় আরও আছেন-বদরুন্নেছা আহমেদ, বেগম নূরজাহান মুরশিদ, সাজেদা চৌধুরী, প্রীতি রানী দাশপুরকায়স্থ, নাজিয়া ওসমান চৌধুরীসহ হাজারো নারী মুক্তিযোদ্ধা।

সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নারীরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এর উজ্জল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রটি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা এবং সক্ষম নারী-পুরুষদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা, তুলি-কলম-কন্ঠ ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক স্কোয়াডে কর্মরত নারী লেখক-সাংবাদিক-শিল্পী-অভিনেতা-কথক-আবৃত্তিকারদের কর্মকাণ্ড একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

মুক্তিযুদ্ধে জাহানারা ইমামদের ভূমিকা অসামান্য। প্রাণ বিপন্ন হতে পারে একথা জেনেও যেসব মা-বাবা তাদের ছেলে-মেয়েকে, যেসব স্ত্রী তাঁর স্বামীকে, যেসব বোন তার ভাইকে যুদ্ধে যেতে অনুপ্রাণিত করেছেন-তাঁদের এই মহানুভবতা অবশ্যই দেশের মুক্তির জন্য। শুধু তাই নয়, গেরিলা যোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাদ্যদান, অস্ত্র সংরক্ষণ এবং আত্মগোপন করে থাকার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে নারীরা পাকসেনাদের বিরুদ্ধে অনেক সফল অপারেশন সংঘটিত হতে সহায়তা করেছেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন অনেক নারী। কাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, ফোরকান বেগম, আশালতা, রওশন আরার মতো অনেক নারী সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। নারীরা ব্যাপকহারে অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি শক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে নামুক, এতোটা চাননি আমাদের পুরুষ-শাসিত সমাজের নেতৃবৃন্দও। এ কারণেই তাদের যুদ্ধে অন্তর্ভূক্ত করার ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপকতর কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি। বরং তারা চেয়েছেন, সশস্ত্র যুদ্ধের বদলে নারীরা ভারতে গিয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বেচ্ছাসেবিকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পুরুষ যোদ্ধাদের সেবায় তাঁদের শক্তিসামর্থ্যকে সীমিত রাখুক।

যাঁরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছা পূরণ করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে, অস্ত্র হাতে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ধর্না দিতে হয়েছে, নির্ভর করতে হয়েছে পুরুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর। এতো বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও যেসব নারী সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরা তো কিংবদন্তি। শিরিন বানু মিতিলের পুরুষের পোশাক পরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ, নারী হিসেবে আমাকে গর্বিত করে।

মুক্তিযুদ্ধে বোমা তৈরি, অস্ত্র সংগ্রহ, সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বার্তাবাহকের ভূমিকায় নারীকে দেখা যায় বেশি। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে গোপনে অস্ত্রশস্ত্র সংরক্ষণ ও যথাস্থানে তা সরবরাহ করা এবং বিভিন্ন যুদ্ধস্থলের মধ্যে বার্তা আদান-প্রদানের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নারীরা সীমাহীন পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। নানা কারণেই পুরুষের মতো ব্যাপক সংখ্যক নারী সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। কিন্তু প্রাণবাজি রেখে যুদ্ধের যাবতীয় রসদ সংরক্ষণ ও সরবরাহ করে নারীরা মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধজয়ের নেপথ্যে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন।

যুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি নানা ধরনের সেবা করেও নারীরা অবদান রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধে। আহত সৈনিকদের বাঁচিয়ে তুলতে বহু ছাত্রী ও নারী চিকিৎসা সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ‘বাংলাদেশ নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্যাম্পে। ভারতে শরণার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অসংখ্য নারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সেবা করেছেন। যুদ্ধাবস্থায় প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে পুরো দেশটাই হয়ে উঠেছিল অনানুষ্ঠানিক হাসপাতাল, আর শত শত মহিয়সী নারী হয়ে উঠেছিলেন সেসব হাসপাতালের চিকিৎসক কিংবা সেবিকা, আর্তের আত্মীয়।

এছাড়াও সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চিকিৎসক নারীরা যে যেখানে কর্মরত ছিলেন, সেখানেই তাঁরা সেবার হাত প্রসারিত করে দিয়েছিলেন। তাঁদের সেবা শুশ্রুষায় অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল।

যুদ্ধ মানেই নারী নির্যাতন, যুদ্ধ মানেই ধর্ষণ। এদেশের মানুষের মনোবল ভেঙ্গে দিতে পাকিস্তানিরা ধর্ষণকেই যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল। তাইতো মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাসে সারা দেশে ১৪ লাখ নারীকে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত, লাঞ্ছিত ও স্বজনহারা নিঃস্বে পরিণত হতে হয়েছে। এই ১৪ লাখের মধ্যে ৪ লাখ (মতান্তরে ২ লাখ ৫০ হাজার) নারী বর্বর পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকর, আলবদর, আলশামস কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এদের অনেকেই শহীদ হয়েছেন, অনেকে মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করেও প্রাণে বেঁচে গেছেন। অনেকে পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যা করেছেন।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এদেশের গ্রামে, গঞ্জে, শহরে বন্দরে অসংখ্য নারী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। অথচ এই নারীরা তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি পাননি আজও। তাই কেবল দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর গল্প নয়, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ও অবদান আরও বড় পরিসরে দেখতে হবে। অনেকেই আক্ষেপ করেন ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে বলে। আসলে ইতিহাস কি লেখা হয়েছে কখনো? যে ইতিহাসে নারীর অবদান শুধুই নির্যাতিত কিংবা সেবায় অংশগ্রহণকারী ছাড়া আর কিছুই নয়!

ম্যানেজার, কমিউনিকেশন্স
ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচি

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.